Sanjib Chattopadhyay

গৃহবন্দি প্রথম দিন: সঞ্জীবের রোজনামচা

এই করোনা কেমন সব তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছে। প্রচারটাও দেখছি ভয়ের প্রচার। একটু সাহসী প্রচার কি হতে পারত না?

Advertisement
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০২০ ২১:০০
Share:

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়।

কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক বৃহস্পতিবার নির্দেশিকা জারি করেছে, করোনা-সতর্কতার জন্য জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ৬৫ বছরের বেশি বয়সিদের বাড়ি থেকে না বেরনোই বাঞ্ছনীয়। শুক্রবার, প্রথম দিন কেমন ভাবে কাটালেন তিনি? লিখছেন সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়।

Advertisement

ভোর সাড়ে ৫টা

আজ গরম পড়বে। ভোর থেকেই চারদিক কেমন থম মেরে আছে। এই করোনা কেমন সব তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছে। প্রচারটাও দেখছি ভয়ের প্রচার। একটু সাহসী প্রচার কি হতে পারত না? আমরা তো প্লেগ, স্মল পক্স, বর্ধমান ফিভার, সোয়াইন ফ্লু, চিকুনগুনিয়া— সব দেখেছি। ডেঙ্গু তো এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে। করোনার সঙ্গে ডেঙ্গুর বন্ধুত্ব হলে কী হবে? আমরা কেউ ভাবছি? দু’জনে মিলে তো সৃষ্টি ধ্বংস করবে! তবে বাইরে যাওয়ার ব্যাপারটা এখন আর আমার হবে না, সেটা বুঝলাম। এখন কোথায়ই বা যাই? সভা বা কোনও মঠে। বাবা! সে দিন সিঁথির মোড়ে বইমেলায় গিয়েছি শুনে সকলের কী আতঙ্ক! আরে কিসের এত ভয়? বুক ফুলিয়ে দাঁড়াব করোনা এলে! দেখি, কেমন ঢুকতে পারে। সব মনের ব্যাপার। মনই তো সব করায়। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া-অণুক্রিয়া। ঈর্ষা, প্রেম, ভয়। তবে আমার ডাক্তার বলে দিয়েছে, বাড়িতে আমার অনেক জায়গা। মর্নিংওয়াক থেকে যোগব্যায়াম, লেখা, সব এখান থেকেই তো করতে পারি। একটা বিষয় কাল অদ্ভুত লাগল। কাল টিভিতে প্রধানমন্ত্রী করোনা নিয়ে এত কিছু বললেন। বললেন না কেন যোগের কথা? যোগের এমন কিছু বিষয় আছে যা থেকে ভেতরে আগুন জ্বালান যায়। রোগমুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পথ এই যোগ। যাক গে, যার যার বিশ্বাস তার তার কাছে। এ সব চাপানো যায় না। আর আধুনিক বাণিজ্যিক সভ্যতা এ সবের কী বা বুঝবে? যাই... যোগাসনের সময় হল।

Advertisement

ভোর ৬টা

আমি এখন ওপরের তলার ছাদে। এটা খুব মনের মতো জায়গা আমার। আজ শিবমন্দিরে দেখছি বড্ড গাছের পাতা পড়েছে। সব ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। ভাগ্যিস মন্দিরে স্ল্যান্টিং রেলিং দূ’টো করেছিলাম। আমার ডন-বৈঠকের কাজে লেগে যাচ্ছে এখন। কত লোকে বাইরে যেতে পারছেন না। আসনও করতে পারছেন না। প্রাণায়ামের মতো শান্তি কোথাও নেই। ভেতরের সব কালো বেরিয়ে গেল আজকের মতো।

সকাল সাড়ে ৭টা

শিশি ঢেলে মধু আর পিপুল চূর্ণ খেলাম। আমার ও সব চামচে ঢেলে খাওয়ার গল্প নেই। এই যে কণ্ঠ আর করোনা নিয়ে এত কথা, পিপুল খেলে করোনা পালাবে। কাশি অবধি হবে না। আমার এই মত বলে দিলাম। এর পর গরম চা, বিস্কুট। আজ বড় কিছু লেখা নেই। তবে না লিখে আর থাকতে পারি? আমার বাড়িতে অনেক গাছ। তাই দেখি বারো মাস মশা। আমি নিয়মিত এক এজেন্সিকে দিয়ে স্প্রে করার ব্যবস্থা করেছি। আমার মিউনিসিপ্যালিটিও ভাল। রাস্তা মাঝে মাঝেই ধূমায়িত করে চলে যায়। তবে ডেঙ্গু কিন্তু অনেক বেশি লোক মেরেছে। যাই হোক, ছোট কয়েকটা লেখা শেষ করেই এ বার বাবার ঘর পরিষ্কার করতে ছুটব। বাবার ঘরই আমার শয়নকক্ষ। আমার স্মৃতির মন্দির। ও ঘরেআমি কাউকে ঢুকতে দিই না। নিজের কাজ নিজে করাই ভাল। এই বইপত্র ঝাড়াঝুড়ি করার সময় এখন ডাক্তারের দেওয়া মাস্ক পরে নিচ্ছি। সব কাজ নিজে করার ক্ষেত্রে আমার বাড়ির লোক বয়স-টয়স নিয়ে কি সব বলে। ও সব মনের ব্যাপার। আজ ভ্যাক্যুয়াম ক্লিনার দিয়ে ওই ঘরের সব পরিষ্কার করার দিন। যাই।

‘দশ-পনেরো মিনিটের বিশ্রাম নিয়ে, এর পর লেখায় ডুব দিলাম’

সকাল ১০টা

এই পরিষ্কারে বড্ড সময় চলে যায়। শুধু বাবার ঘর? পুজোর জন্য তো ওপরের ছাদে আজ অনেক পাতা পরিষ্কার করতে হল। পুজোর জন্য সব রেডি করে রাখতে হয় আমায়। এ বার রুটি আর তরকারি খাব। হ্যাঁ, নাতির সতর্কবাণী আছে, হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুয়ে তবেই এখন মুখে কিছু দিচ্ছি। এ বার লেখার কাছে ফেরা। একটা পাতার অর্ধেক হয়ে আছে। নাহ... আজ আমার প্রিয় বারান্দা টানছে। চেয়ারে হেলান দিয়ে ‘কথামৃত’ আর ‘গীতা’ পড়লাম খানিক। নাহ... এ বার উঠে পড়ি। কাপড় কাচতে হবে।

বেলা ১২টা

বেশ রোদ আজ। শীত, বসন্ত, গ্রীষ্মের সব রোদ পোহাই আমি। এখন তো ডাক্তার ভিটামিন ডি খেতে বলছে। আমি সেই কবে থেকে রোদ খাই! আর গরমকালের দুপুরে নিঃশব্দে গাছ থেকে পাতা পড়া দেখি। রোদের তাপ থাকলে কোনও করোনা আসবে না আমি শুনেছি। নাহ, আমার সব অন্তর্বাস কাচতে হবে এ বার। অনবরত জলের কাজ করি। আমার শরীরে অনেক ডিটারজেন্টও কিন্তু বাসা বাধছে। ওহ! অনেক কথা লিখে ফেললাম আজ। আরে, যে জামাটা স্নান করে পরব সেটাও তো ইস্তিরি করতে হবে! তার পর স্নান। পুজোর বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে।

দুপুর ১টা

এ বার পুজোয় বসলাম। তিন তলায় নারায়ণ, চার তলায় শিবমন্দির। নারায়ণের পুজোর পর তর্পণ করলাম। তার পর শিবপুজো। উফফ! বড্ড দেরি হয়ে গেল আজ। সব কিছু ঘড়ির কাঁটা ধরে করলেও পুজোটা সময়ে শেষ করতে পারি না।

দুপুর ৩টে

খাওয়া হল। এ বার দশ-পনেরো মিনিটের বিশ্রাম। এর পর লেখায় ডুব দিলাম। আমার মনে হয়, আমাদের চিন্তার সঙ্গে ইমিউনিটি যুক্ত আছে। এটাও সকলের মনে রাখা উচিত। আমাদের ভেতরে অনেক কিছু প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আছে। আমরা চাইলে এই পরিস্থিতিতেও মন শক্ত করে ভাল থাকতে পারি।

সন্ধ্যা ৬টা

সূর্য প্রায় অস্ত যাচ্ছে। ছাদে এ বার একশো পাক মারব।

সন্ধ্যা ৭টা

এ বার নারায়ণ আর শিবকে শয়ন দিলাম। ঠাকুরঘর একেবারে ফিটফাট করে নীচে যাচ্ছি। এখন গান শুনব। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শুনি আমি রোজ। সারা দিন খবরের থেকে দূরে থাকলাম। যা সব চলছে! এক বার টিভি খুললাম। সেই ভয়ের প্রচার। আতঙ্ক। আরে! করোনা শরীরে ঢোকার আগেই তো মানুষ ভয়ে মরে যাবে। এই সম্বন্ধে ভাবনা যত কম করবে মানুষ তত ইমিউনিটি বেড়ে যাবে। আজ মনে পড়ছে আমার ঠাকুরদাদা-ঠাকুমার কথা। ওঁদের দু’জনের স্মল পক্স হয়েছিল। কেউ কাছে যেত না। আমার বাবা ছাড়া আর কেউ ওঁদের সেবা করেনি। আমার বাবা বলেছিল সে দিন, ‘‘আমার আর পক্স হবে না। আমি সেবা করে ইমিউনড হয়ে গিয়েছি।’’ এ সব কথা আজ কে শুনবে? বরং আমি শুনছি— এই জ্বর হল, কাশি হল, আমি মরে গেলাম। আরে, আমরা গঙ্গার ধারের মানুষ। হাঁচি-কাশি-ডাস্ট অ্যালার্জি তো হবেই!

রাত সাড়ে ৮টা

৯টায় পড়তে বসব। ১১টা বাজলে খাব। শুতে শুতে ১২টা হবে। জানি না, করোনা আসবে কি না আমার কাছে। তবে ‘মন্বন্তরে মরিনি আমরা। মারী নিয়ে ঘর করি’, এই লাইনটাই ফিরে ফিরে মনে আসছে আজ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement