এই বিভীষিকাময় ভাইরাস-পর্বে কতকগুলি কথা স্পষ্ট করে বলা ভাল। এই ভাইরাস চিনে দেখা দেওয়ার পিছনে চিনাদের সাপখোপ ইত্যাদি হরেক রকম প্রাণী খাওয়ার বদভ্যাসই দায়ী, ওরা বড় নোংরা ও আজব চিজ়, এমন একটা বক্তব্য চার দিকে ঘুরছে। এটা কিন্তু সঙ্গত নয়। আসলে এ সব বলে এই পরিস্থিতির জন্য আমাদের সকলের, সামগ্রিক ভাবে মানবসভ্যতার দায়িত্বই আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি। ‘আমি ভাল, ও খারাপ’ মনোভাবের (এবং তা থেকে আগ্রাসন, হিংস্রতার) অভ্যাসটাকেই বজায় রাখছি।
কোভিড১৯-এর মতো পশুবাহিত ভাইরাসের সংক্রমণ শুধু যে চিনেই দেখা গিয়েছে, তা তো নয়। বেশ কয়েক দশক ধরে নানা রকমের ভাইরাস পৃথিবীর নানা প্রান্তে থাবা বসাচ্ছে, এইচআইভি, পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা, ব্রাজিলের জ়িকা, মালয়েশিয়ার নিপা, পশ্চিম এশিয়ায় মার্স। আজকের সঙ্কটের জন্য উহানের জীবজন্তুর বাজারে বন্যপ্রাণী কেনাবেচার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করার সময়ে আর এক ধাপ এগিয়ে তো এমন প্রশ্ন করা যায় যে, সেই বাজার বসার কারণ কী? সে কি বিশেষ করে চিনা সংস্কৃতির প্রয়োজনে, না কি আধুনিক মানবসভ্যতার বহুমান্য ‘উন্নয়ন’-এর আদর্শের জন্য, যে আদর্শ চিন গ্রহণ করেছে তুলনায় সাম্প্রতিক কালে? ইতিহাস জানে, যে-কোনও আদর্শে যারা সদ্য শামিল হয় তাদের মধ্যে সেই আদর্শ রূপায়ণে উৎসাহ থাকে খুব বেশি। কয়েকশো বছর আগে থেকে ইউরোপ ও আমেরিকা এই পথ গ্রহণ করেছিল, দ্রুত শিল্পায়ন, নগরায়ণ, বিরাট সংখ্যায় শিল্পশ্রমিকের নিযুক্তি, বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক আগ্রাসন ও উপনিবেশ স্থাপন। সে সময়ে পশু থেকে মানুষে জীবাণু সংক্রমণের প্রক্রিয়া (জ়ুনটিক ট্রান্সফার) জোরদার হয়ে উঠেছিল।
ইতিহাসে প্রায় গোড়া থেকেই মানুষের ওপর মানুষের নিপীড়নের পাশাপাশি অন্য একটা প্রক্রিয়া চলে আসছিল— মনুষ্যেতর প্রাণীদের প্রতি মানুষের আগ্রাসন। যেন মানুষের প্রয়োজন মেটাতেই তাদের সৃষ্টি, এমন মনে করা। প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষের বৈরিতার মনোভাবই বাড়তে থাকে। প্রকৃতির ওপর তো সদম্ভে মাথা তুলতেই হবে মানুষের সংস্কৃতিকে, পশু তো প্রকৃতিরই অঙ্গ। শিল্পবিপ্লবের ফলে এই প্রক্রিয়া অভূতপূর্ব ব্যাপকতা ও তীব্রতা লাভ করে। শহরের জনসংখ্যা ও মাংসের চাহিদা খুব বেড়ে যায়। গবাদি পশু মানেই যেন মাংস, মাংস মানেই মুনাফা। তাই কৃত্রিম উপায়ে পশুদের সংখ্যাবৃদ্ধি, তাদের ওপর অকথ্য অত্যাচার। অলিভার টুইস্ট-এ (১৮৩৮) পাই লন্ডনের স্মিথফিল্ড মার্কেটের বীভৎসতার কথা।
আরও পড়ুন: পর্বান্তরের দায়িত্ব
সেই ষোড়শ/সপ্তদশ শতক থেকে বিশ্বব্যাপী যে ভোগবাদী অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া, সেই পথেরই পথিক মধ্য-চিনের হুবেই প্রদেশের উহান, যে জায়গা ইদানীং শিল্পায়িত হয়ে উঠে কোটিখানেকের ওপর মানুষের বাসস্থানে পরিণত। এশিয়ার দীর্ঘতম নদী ইয়াংসির তীরে অবস্থানের সুবাদে জায়গাটিতে বাণিজ্যের রমরমা ছিলই। ইস্পাত ও অন্যান্য শিল্পের ভিত্তিতে উহান হয়ে ওঠে চিনের সবচেয়ে বড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব। নরেন্দ্র মোদী ২০১৮-য় চিনে গেলে উহানই ছিল তাঁর ও শি চিনফিং-এর সাক্ষাতের স্থান। চিনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ঘটনাটিকে দুই দেশের মধ্যে ‘উহান স্পিরিট’-এর উদ্ভাসন বলে বর্ণনা করেছিল।
অর্থাৎ বলাই যায়, উহান আজকের দুনিয়ার ভোগবাদী অর্থনীতির অন্যতম প্রতীক। তার প্রধান শিল্প হল ইমারতি। সেই সব জমকালো ইমারতের ছবি দেখলে চোখ ঠিকরে আসে। আকাশ ফুঁড়ে ওঠা বিরাট বিরাট অদ্ভুত-দর্শন সব অট্টালিকা, প্রকৃতি-পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। মনে হয় মানুষ নয়, রোবটরা বাস করে সেগুলিতে। তার উজ্জ্বলতায় চাপা পড়ে যায় উহানের বায়ুদূষণ, দারিদ্র। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান বলেছেন, দুনিয়ার উৎপাদনের এক-চতুর্থাংশ যে চিনেই হয়, তার কুফলটাও লক্ষণীয়। প্রচুর কয়লার ধোঁয়া বাতাসে, অসংখ্য মানুষের হাঁপানি, ফুসফুসের ক্যান্সার। মাছ-মাংসের বাজারে ক্রমেই বেশি করে বন্যপ্রাণীর আমদানি, খাদ্য বা ওষুধ তৈরির উপাদান হিসেবে। চিনে ১৯৫৯-৬১-র কুখ্যাত মন্বন্তরের পর সত্তরের দশকে চিন সরকার ছোট চাষিদের বন্যপ্রাণী পালনের অনুমতি দেয়। দেং জিয়াওপিং-এর অর্থনৈতিক সংস্কারের দৌলতে তা বড় ইন্ডাস্ট্রি হয়ে উঠতে থাকে। চলতে থাকে চোরাগোপ্তা বেআইনি কারবার, সরকার চোখ বুজে থাকে। অধিকাংশ চিনা নাগরিক নিজেরা বন্যপ্রাণী খায় না। খায় কিছু ধনী মানুষ। তাদেরই স্বার্থে সরকার এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে না, পরিবেশগত ক্ষতির কথা তো ভাবেই না। এই প্রাণীদের স্বাভাবিক আবাস ধ্বংস হয়, তারা মানুষের বসতির কাছাকাছি চলে আসতে থাকে।
নিজেদের প্রয়োজনে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পশুদের ব্যবহার করার ফল মানুষকে অনেক দিন ধরেই অল্পবিস্তর ভুগতে হয়েছে। পশুশরীরে নানান অস্বাভাবিক হরমোন, অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ চলছে। পশুদের নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা এক একটি প্রজাতির জিনগত বৈচিত্র্যকে আঘাত করে তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে আরও বেশি করে তাদের থেকে মানুষে রোগসংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলছে। মানুষের সীমাহীন লোভের প্রভাব পড়েছে স্বাস্থ্যব্যবস্থাতেও। এক দিকে মনহীন উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় স্বাস্থ্যসঙ্কট তৈরি করা, অন্য দিকে জনস্বাস্থ্য নিয়ে থোড়াই চিন্তা। স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে তুলে দেওয়া হচ্ছে মুনাফালোভী ব্যবসাদারদের হাতে। চিনে জিডিপি-র ৫% মাত্র স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ (যেখানে ব্রাজিলে ৯%, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৮%, মেক্সিকোতে ৫.৫%। অবশ্য ভারতকে বোধহয় বেশি দেশ টেক্কা দিতে পারবে না, ১.২%!) চিনের প্রাথমিক ভাবে করোনা রুখতে না-পারা আর অসুখটির দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার এটাও একটা কারণ।
অর্থাৎ আজ যা ঘটছে, তা ক’দিনের সাময়িক সমস্যা নয়, হঠাৎ-খেপে-ওঠা একটা চিনা জীবাণুর সৃষ্টিছাড়া আচরণ নয়, এ হল সভ্যতার কাঠামোগত সমস্যা। গত বছর আমরা এক জন মানুষের দেড়শোতম জন্মদিন পালন করে এলাম, যাঁর বিখ্যাত উক্তি ‘দ্য ওয়ার্ল্ড হ্যাজ় এনাফ ফর এভরিওয়ানস নিড, বাট নট ফর এভরিওয়ান’স গ্রিড।’ করোনাভাইরাস এক দিন না এক দিন আমাদের রেহাই দেবে। কিন্তু আমাদেরই ভাবতে হবে, আগে যে ভাবে চলছিলাম, আবার কি সেই ভাবেই চলতে থাকব?
ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর দ্য হিস্ট্রি অব সায়েন্স, বার্লিন
আরও পড়ুন: অবারিত হোক কল্পনার আকাশ