সঙ্কটমোচন: ফুলের পাপড়ির বৃষ্টির দিকে দৃষ্টি রেখে চিকিৎসাকর্মীর দল, বেঙ্গালুরু, ৩ মে। ছবি: পিটিআই।
ফুলগুলো সরিয়ে নাও আমার লাগছে। মালা জমে জমে পাহাড় হয়, ফুল জমতে জমতে পাথর। পাথরটা সরিয়ে নাও আমার লাগছে।— গত রবিবার থেকে সেই কবে-পড়া সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার লাইনগুলোর একটা আলাদা অর্থ হঠাৎ করে বুঝতে পারছি। একই সঙ্গে, সমাজমাধ্যমে জানাশোনা কবি আর্যতীর্থের নতুন রচনাও কানে বেজে উঠছে— ‘একটু দূরেই বদ্ধ পাগলটা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, ভুল খরচের মহামারি, ভুল খরচের মহামারি-ই-ই-ই!’ আর এই সবের ভেতর, মনের কোণে, প্রাণপণ একটা ভরসাকে আঁকড়ে ধরছি, যে মানুষগুলি অভুক্ত অশক্ত শরীরে শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে মাইল বাড়ির দিকে হাঁটল, যে শিশু-জামলোরা ঘরে ফিরতে চেয়ে বাড়ি থেকে অনেক দূরে কাঠফাটা রাস্তায় নিজেদের প্রাণ ফুরিয়ে ফেলল, যে সব মানুষ হাসপাতালের চিকিৎসা না পেয়ে অকালে ঝরে গেল, যারা মাথা-গোঁজা কোটরে বন্দি হয়ে দু-বেলা সামান্য খাবার জোটাতে অক্ষম হল, অসুস্থ পরিজনকে ওযুধ-পথ্য-চিকিৎসা দিতে অপারগ হল, তারা সকলে নিশ্চয় এতই বিপর্যস্ত যে ঠিক খেয়াল করার অবস্থায় নেই যে— তাদের এই যন্ত্রণার দিনে কী রসিকতাটাই না চলছে দেশ জুড়ে।
ফলে দায়িত্বটা কিন্তু নিতে হবে আমাদেরই, যারা বাড়ির আশ্রয় এবং জমিয়ে রাখা খাদ্য-পানীয়ের নিরাপত্তায় থেকে সবটা দেখছি-শুনছি। আমাদেরই কতগুলো প্রশ্ন করতে হবে নেতাদের। এখনই।
এই যেমন, হেলিকপটার থেকে ফুল ছড়িয়ে কী লাভ তাঁরা আশা করছিলেন, প্রথমেই জানতে চাই সেটা। এমন একটা কিছু করলে ডাক্তার-নার্সদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো যাবে, সত্যিই কি তাঁরা তাই ভাবছিলেন? না কি, নিজেরা কত উদার এবং মহান, তার বিজ্ঞাপন বানাচ্ছিলেন? বাসন বাজানো, শাঁখ বাজানো ইত্যাদি নিয়েও প্রশ্ন তোলার ছিল, কিন্তু সেটা অনেকটা কম গুরুতর, পরে কখনও সে প্রসঙ্গ তোলা যাবে’খন। কম গুরুতর, কেননা, ও সব পরিকল্পনায় খরচের ব্যাপার ছিল না। কিন্তু বড় বড় শহরের আকাশে হেলিকপটার চালিয়ে পুষ্পবৃষ্টির এই বিপুল খরচটা আসছে কোথা থেকে? এটা কি সত্যিই মানুষের প্রাণ বাঁচানোর পথ? ফুল দিয়ে প্রাণ বাঁচানো যায় কি না, সেই দার্শনিক জিজ্ঞাসা না হয় পরে কখনও মিটবে। কিন্তু ফুল বিষয়ে অর্থনৈতিক জিজ্ঞাসাটা এই মুহূর্তে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ— বিশেষত যখন জানি যে এই বিরাট মহামারি-কালে অনেক কিছুই ভালমতো করে ওঠা যাচ্ছে না কেবল টাকার অভাবে। প্রচুর পরিমাণে পিপিই দরকার, জোগাড় করা যাচ্ছে না। ডাক্তার-নার্সদের সুরক্ষার আর একটু বেশি ব্যবস্থা, সামাজিক ভাবে তাঁরা নিগৃহীত হলে সেই সঙ্কট কাটানোর ব্যবস্থা— করা যাচ্ছে না। তাঁদের আত্মীয়-পরিজনদের নিরাপত্তা দেওয়ার নিয়মিত বন্দোবস্ত হতে পারত— কিন্তু হচ্ছে না। ওই টাকা দিয়ে এ সব করা যেত না? না কি, ফুল মাথায় পড়লেই ডাক্তাররা বেশি খুশি হন?
আরও পড়ুন: কে বলবে, খাদ্যের অধিকার নামে একটা আইন আছে এই দেশে
এ দিকে টাকার অভাবটা নির্ঘাত সাংঘাতিক হয়ে উঠেছে। না হলে শ্রমিকদের এত দিন পর বাড়ি ফেরানোর নিদান দিয়ে আবার তাদের কাছ থেকে টাকা চাওয়া কেন? শোনা গেল, তাঁদের টিকিটের টাকা তো দিতেই হবে, আবার পঞ্চাশ টাকা অতিরিক্তও দিতে হবে। রেলগাড়ির খরচ মেটানোর সাধ্য সরকারের নেই, এত হেলিকপটার চালানোর পর টাকা বাকি থাকে কী করে? রেল কোম্পানিরও খরচ বইবার ক্ষমতা নেই, যদিও পিএম কেয়ার ফান্ডে রেলওয়ে ইতিমধ্যে দেড়শো কোটি টাকা দিয়েছে। ফল যা দাঁড়াল, আকস্মিক সরকারি ঘোষণার শিকার হয়ে শ্রমিকরা এত দিন অকারণে— হ্যাঁ অকারণেই— বাড়ি থেকে বহু দূরে একলা প্রাণটি বাঁচিয়ে বসে ছিলেন কোনওক্রমে, তাঁদেরই এখন সরকারকে দিতে হবে বাড়ি আসার খরচ! কী অপূর্ব সমাধান। অ-পূর্ব। আমাদের এই অন্যায়-জর্জরিত দেশেও, এত সঙ্কট-ভারাক্রান্ত রাষ্ট্রেও, এর তুল্য হৃদয়হীন ঘটনা কখনও দেখেছি কি না আমরা, আজ তা ভাবতে হবে আমাদেরই, এই আমাদের, যারা ঘরের ঘেরাটোপে বসে ভাবার অবকাশটুকু পাচ্ছি।
আরও পড়ুন: একটি মৃত্যুর ধারাবিবরণী
পরিযায়ী শ্রমিকদের কষ্ট ‘অকারণ’ বললাম, কেননা যে সিদ্ধান্ত হঠাৎ আজ নেওয়া গেল, সেটা ২৪ মার্চ নিতে খুব কিছু অসুবিধে হত বলে মনে হয় না। নেওয়াই যেত। এঁদের বাড়ি ফেরানোর ব্যবস্থা লকডাউন ঘোষণার আগেই করা যেত। কিংবা দুই দিন হাতে রাখা যেত ঘোষণার পর। কিংবা লকডাউন হয়ে গেলেও আজ যে ভাবে তাঁদের ফেরার ব্যবস্থা হচ্ছে, ঠিক সে ভাবেই ব্যবস্থা করা যেত। মার্চে, কিংবা এপ্রিলেও, এই কাজটা করা গেলে তাঁদের দূর থেকে ফিরে আসার পর নতুন করে করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর ভয় কমত, এত দিন বিদেশ-বেঘোরে সংক্রমণের ভয়ে তাঁদের দিনরাত এক হত না, তাঁদের স্ত্রী-পুত্রকন্যারা বাড়ি ফিরতে না পারা ঘরের মানুষটির জন্য দুশ্চিন্তায় কালি হয়ে যেতেন না।
মানুষের উদ্বেগের বিষয়টা সরকারি নেতারা বোঝেন না, এমনও বলা যাবে না। নয়তো কি বিদেশ থেকে বিমানে চড়িয়ে প্রবাসী মানুষগুলোকে ফেরত আনতেন তাঁরা? আসলে ওটা তো ‘আমাদের’ মতো লোকের কথা— ‘ওদের’ মতো লোকেদের কথা ভাবার সময় কি তখন ছিল? তাই কোটা থেকে যে ছেলেমেয়েরা ফিরল, তাদের বেলায় এক নিয়ম, শ্রমিকদের বেলায় অন্য। এত ন্যক্কারজনক ভাবে আমাদের-ওদের ভাগাভাগির রকমটা এই জাতীয় সঙ্কটের দিনে বর্তমান সরকারের একটা ঐতিহাসিক অবদান হয়ে রইল। মনে রাখছি তো আমরা এ সব, নিজেদের ঘরের আরামে ঝিমোতে ঝিমোতে?
গত কাল সনিয়া গাঁধী ঝড় বইয়ে দিয়েছেন, শ্রমিকদের বাড়ি ফেরানোর টাকা কংগ্রেস দিয়ে দেবে বলে। বিজেপি নেতারা নড়ে বসেছেন। বেঙ্গালুরুতে নেতারা টাকা হাতে রেলওয়ে স্টেশনে ছুটেছেন। অনেকেই আবার ঠোঁটের কোণে ব্যঙ্গ ঝুলিয়ে বলছেন, যত্ত সব রাজনীতি! প্রশ্ন হল— সেটাই না হয় ভাল করে করুন আমাদের নেতারা! মানুষের জন্য কিছু করতে তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন কেন? তাঁদের হাতেই তো রয়েছে, মানুষের সুরক্ষার বন্দোবস্ত করে সুনাম কুড়নোর তাসটা। না কি, সত্যিই প্রধানমন্ত্রী ঠিক করে নিয়েছেন যে বাসন-বাজানো আর হেলিকপটার-মুগ্ধ সামাজিক শ্রেণির মধ্যে তাঁর সুনাম আবদ্ধ থাকলেই যথেষ্ট? তাই, দেশের অর্ধেক মানুষের ফোন কেনার পয়সা না থাকুক, আরোগ্য সেতু অ্যাপ-এর ব্যবস্থা হয়। কিংবা আকাশ থেকে ফুল ছড়ানোর ধূম পড়ে যায়, কিন্তু শ্রমিকদের জন্য ‘পি-এম কেয়ার’ ত্রাণ কমিটির সিন্দুক বন্ধ থাকে!
আসল কথাটা এখানেই। এ সব কিছুই প্রশাসনের ব্যর্থতা আর দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, এ কথা বলার মানে, আহ্লাদ করে আধখানা বলা। সত্যিটা হল, এই সবেরই পিছনেই একটা আলাদা রাজনীতি আছে, একটা আলাদা ছক, একটা আলাদা মূল্যবোধ। ফুল ছড়ানো কেন, এই প্রশ্নেরও আগে যে প্রশ্নটা তা হল— ফুল ছড়ালো কে। সেখানে ফিরে গেলেই রাজনীতিটা পরিষ্কার ঝকঝকে হয়ে যায়। কেন হঠাৎ সেনাবাহিনীকে দিয়ে এমন একটা অভ্যন্তরীণ নাগরিক বিষয় সম্পর্কে প্রেস কনফারেন্স করানো হল, কেন তাঁদের মানুষকে আশ্বস্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হল— এ সবই সেই রাজনীতির প্রশ্ন, এমনকি দেশের সংবিধানেরও প্রশ্ন। সুকঠিন পরিস্থিতিতে অনেক সময় ত্রাণকার্যে সামরিক বাহিনীকে কাজে লাগানো হয় তার সুব্যাপ্ত ও সুগভীর ক্ষমতার জন্য, এ ক্ষেত্রেও তার বিরাট একটা জায়গা ছিল। কিন্তু, না। সেনার জন্য কোনও ‘কাজ’ বেছে নেওয়া হল না, তাকে দেওয়া হল ‘উৎসব’-এর দায়িত্ব। ডাক্তার-নার্সদের অভিনন্দন জানানোর জন্য সামরিক বাহিনীকে মাঠে নামানো হল।
অথচ, স্বাধীনতার পরই পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছিল যে, এই দেশে সামরিক শক্তির কোনও অসামরিক ভূমিকা থাকবে না। আমাদের দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বারংবার কথাটা বলে গিয়েছেন, এমনকি কড়া পদক্ষেপও নিয়েছেন। বুঝতে পারছি কি আমরা— হঠাৎ-পাওয়া অবকাশে এলিয়ে-থাকা নাগরিকরা— কত দূর চলে যেতে বসেছি সাংবিধানিক গণতন্ত্রের চত্বর ছাড়িয়ে?
ফুল জমতে জমতে এ ভাবেই পাথর হয়। আমরা সাবধান থাকছি তো?
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)