ছবি: পিটিআই।
রথযাত্রার অনুষ্ঠানে প্রতি বৎসরের ন্যায় ভিড় হইল না, তাহা সত্য। কৃতিত্ব ওড়িশার প্রশাসনের। নাগরিকেরও বটে। ভারতীয় সমাজে এই সংযম বিরল। তবে, রথযাত্রা একেবারে ভিড়হীনও হয় নাই। যাঁহারা উপস্থিত ছিলেন, প্রত্যেকেই অতিমারি-সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি পালন করিয়াছেন, সেই কথা বলিবারও উপায় নাই। কিন্তু, এই রথযাত্রায় শ্রীক্ষেত্রে কী হইল, মূল প্রশ্ন তাহা নহে। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট গোড়ায় জানাইয়াছিল, এই দফায় রথযাত্রার অনুমতি দিলে ‘জগন্নাথদেব মার্জনা করিবেন না’। তাহার পর আদালত মত পাল্টাইয়া শর্তসাপেক্ষে রথযাত্রার অনুমতি দেয়। সেই অনুমতির ভিত্তিতেই রথযাত্রা হইয়াছে। কেহ ভক্তদের আবেগের কথা উল্লেখ করিয়া বলিতে পারেন, রথযাত্রা না হইলে বহু মানুষের বিশ্বাসে আঘাত লাগিত। প্রশ্ন হইল, দেশে কোভিড-১৯ অতিমারি এখনও যে রূপ বেলাগাম, এবং আনলক প্রক্রিয়া আরম্ভ হইবার পর বিপদ বাড়িবার যে আশঙ্কার কথা বিশেষজ্ঞরা বারংবার জানাইয়াছেন, তাহার তুলনায় জগন্নাথ-ভক্তদের সেই আবেগ কম গুরুত্বপূর্ণ কি না, সমাজ সেই কথা ভাবিয়া দেখিয়াছে কি?
সনাতন ভারতের হৃদয়ে রথযাত্রার গুরুত্ব অস্বীকার করিবার কোনও প্রশ্ন নাই। এই দফায় ওড়িশার প্রশাসন যে ভাবে সব দিক সামলাইয়াছে, তাহাও প্রশংসনীয়। কিন্তু, এই রথযাত্রা একটি নজির সৃষ্টি করিল না কি? যে সময় দেশে সব ধরনের জনসমাবেশ নিষিদ্ধ, সেই সময় ধর্মের নামে সমাবেশ করা চলিতে পারে— এই নজিরটি, শুধু জনস্বাস্থ্যের প্রেক্ষিতেই, অতি বিপজ্জনক। পুরীতে প্রশাসন যাহা পারিয়াছে, দুর্গাপূজায় কলিকাতা পুলিশও তাহাই পারিবে, গণেশ চতুর্থীতে মুম্বই পুলিশও সমান দক্ষতার পরিচয় দিবে— এমন আশা করা চলিতেই পারে, কিন্তু শুধু সেই আশার উপর জনস্বাস্থ্য রক্ষার দায় চাপাইয়া দেওয়া যায় না। বিশেষত এই অবস্থায়, যখন সামান্য বিচ্যুতিও গোটা দেশের জন্য প্রবল বিপদ ডাকিয়া আনিতে পারে। মার্চ মাস হইতে একটি কথা ক্রমেই স্পষ্টতর হইয়া উঠিয়াছে— ভারতের মানুষ, সার্বিক ভাবে, বিধিনিষেধ মানিতে প্রবল রকম নারাজ। দেশের সিংহভাগ মানুষ এমনকি নিজের প্রাণসংশয়ের সম্ভাবনাও মানিয়া লইতে পারে, কিন্তু সামাজিক দূরত্ব তাহাদের সহে না। এই দেশে ধর্মীয় জনসমাগমকে ছাড়পত্র দেওয়া হইলে তাহার পরিণতি কী, ভাবিলেও আতঙ্কিত হইতে হয়।
এই অবস্থায় সমাজের আবেগকে সংযত করিবার, ধর্মীয় উৎসবে জনসমাগমের দাবির বিপদটি দেখাইয়া দিবার দায়িত্ব ছিল সমাজের অভিভাবকদের। প্রশাসনিক কর্তাদের, রাজ্য ও দেশের কর্ণধারদের। তাঁহারা সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। কেন, কারণটি অনুমান করা সম্ভব। অথচ, মাত্র এক মাস পূর্বেই প্রমাণ হইয়াছে, যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে বলিলে মানুষ কথা শুনে। ইদ উপলক্ষে জনসমাবেশ নিষেধ করা হইয়াছিল— আসমুদ্রহিমাচল সেই নিষেধাজ্ঞা পালিত হইয়াছে। কেহ বলিতে পারেন, তখন লকডাউন চলিতেছিল, এখন আনলক চলিতেছে, অতএব দুই ক্ষেত্রে ফারাক থাকিতেই পারে। এই (কু)যুক্তিটি দেখাইয়া দেয়, আনলকের অর্থ বুঝিতে খামতি থাকিয়া গিয়াছে। ইহা স্বাভাবিকতায় প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ মাত্র— স্বাভাবিক অবস্থা নহে। এখনও সামাজিক দূরত্ববিধি সমপরিমাণ পালনীয়। বস্তুত আরও বেশি, কারণ যে হেতু আনলক চালু হইবার পর জনপরিসরে ভিড় বাড়িয়াছে অথচ দেশে সংক্রমণ এখনও নিয়ন্ত্রণে আসে নাই, অতএব এখন সংক্রমণের আশঙ্কাও বেশি। এই অবস্থায় কোনও কারণেই জনসমাবেশের ছাড়পত্র দেওয়া চলিতে পারে না, ধর্মীয় কারণে তো নহেই। আশা ছিল, সমাজের অভিভাবকরা সাধারণ মানুষকে এই কথাটি বুঝাইয়া বলিবেন। দেখা গেল, অতিমারি নিয়ন্ত্রণ অপেক্ষা অন্য কিছু তাঁহাদের নিকট জরুরিতর।