প্রতীকী ছবি
সমাজে যখন প্রবল প্রলয়, চার পাশে নিবুনিবু আলোয় যখন শুধু শোনা যায় মৃত্যুর কলরব; তখন তাঁরা সব প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করে দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া বাতিস্তম্ভেও আলো জ্বালেন বাবুই পাখির ঘর সাজানোর মতোই। সেই অসম যুদ্ধের সৈনিকদের সমাজ সাধারণত মনে রাখে না। এটাই বাস্তব। এ যেন ওঁদের করারই কথা ছিল! শুধু আলো জ্বালানোই নয়, ঝড় থামানোর অলৌকিক ক্ষমতা কেন বা ওঁদের থাকবে না, দাবি করে সমাজ।
বিপুল প্রতিকূলতার মুখে দাঁড়িয়েও যাঁরা চেষ্টা করে চলেছেন আরও অনেক মানুষের প্রাণ বাঁচানোর— সেই চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীরা কেন লড়ছেন এই অসম লড়াই? শুধুই চাকরির দায়ে? জীবিকার বাধ্যবাধকতায়? না। দায়িত্ব পালনের নতুন ইতিহাস লেখার তাগিদ তাঁদের প্রাণিত করে।
চিকিৎসা-পেশার প্রত্যেকে ঠিক এই মুহূর্তে এক প্রবল মরুঝড়ের মুখোমুখি বুক চিতিয়ে লড়ছেন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে। এই লড়াইয়ের স্বরূপ আরও এক বার স্মরণ করিয়ে দিই: এখানে শত্রুর রূপ এখনও অদৃশ্য, তার চলন প্রায় অজানা, আর সৈনিকের টর্চের আলো এখনও অনুজ্জ্বল। লড়াইটা তাই একান্তই আদিম। অন্ধকারে, প্রায় খালি হাত-পায়ে শত্রুর নাক-চোখ-মুখ হাতড়ে, ঘ্রাণ নিয়ে যুঝে যাওয়ার মতো শক্ত কাজ এই লাইন অব কন্ট্রোলে দাঁড়িয়ে শিরদাঁড়া সোজা রেখে করে চলেছেন ডাক্তার, নার্স ও প্রতিটি সহযোগী স্বাস্থ্যকর্মী। যুদ্ধ জয়ের পদ্ধতি-প্রকরণ এখনও বিজ্ঞান পরিষ্কার অক্ষরে আমাদের হাতে তুলে দিতে পারেনি। যদিও প্রতি মুহূর্তে বিজ্ঞানের নানান প্রাঙ্গণে চেষ্টা চলেছে অক্লান্ত।
এই চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা নিয়মিত খবর পাচ্ছেন, মারণ-ভাইরাস কেড়ে নিয়েছে তাঁদের কোনও না কোনও সহকর্মীর প্রাণ। কেন, কারণটা তাঁরা বিলক্ষণ জানেন। তাঁদের মাথার উপরে বর্ষার মেঘের মতো শঙ্কা জমে আছে, কিন্তু তাঁদের পথচলা থেমে নেই। সব ক্লান্তি ভুলে, আত্মজন বিয়োগব্যথায় ভাঙা বুক আবার সাহসে বেঁধে নিচ্ছেন। কেন? পথের পাশে আর সামনে দুর্দশায় থাকা অসংখ্য মানুষ, আর তাঁদের কষ্ট লাঘবের লক্ষ্য এই চলার দিশা ও প্রেরণা। পথের যেটুকু আলেখ্য সামনে এসেছে, এখনও পর্যন্ত তা ভরে আছে শহিদের শিলালিপিতে।
সংবাদপত্রের পাতায়, টেলিভিশনের স্ক্রিনে যখন চোখে পড়ে এই চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের মৃত্যুর খবর, তাতে কি সেই মানুষগুলোর মুখ ফুটে ওঠে? না কি, আমরা শুধু রণক্ষেত্রে মৃত সেই জওয়ানের উর্দিটুকুই দেখি? ইউনিফর্মের আড়ালে ব্যক্তিমানুষটির অসহায়তা, নিঃস্ব হতে বসা পরিজনের ভবিষ্যৎ ভাবনা অনালোচিত থেকে যায়? কফিনবন্দি সহকর্মীর শবদেহে সম্মাননা জানানোর প্রথাগত সঙ্গীত আর প্রস্তাবনার সময় সৈনিকের শিরদাঁড়ায় যে গর্বের স্রোত বয়ে যায়, রক্তে যে ঢেউ ওঠে, তাতে পেশার মহান ঐতিহ্যে শরিক হওয়ার গর্বের দ্যোতনা থাকে। সেই ঝুরো মাটিতে ব্যক্তিগত শঙ্কার আবহ ঢাকা পড়ে যায়। এগুলি সবই যুদ্ধ জয়ের আবশ্যিক প্রেক্ষিত। এর সব কিছুই চিকিৎসা পেশার মধ্যেও আছে।
পাশাপাশি জনমানসের কয়েকটি অস্পষ্টতা এখনই খোলসা করা দরকার। করোনার বিরুদ্ধে যুঝতে গিয়ে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী থেকে সাধারণ মানুষ— সবাই প্রতি দিনই কম-বেশি জ্ঞানঋদ্ধ হচ্ছি। সময় যত এগোবে, জ্ঞান বহরে তত বাড়বে। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, প্রায় হড়পা বানের মতো এসে পড়া এই প্রলয়ের সামনে প্রস্তুতি এবং প্রতিরক্ষার নিশ্ছিদ্র বর্ম ছাড়াই লড়তে নেমেছিলেন চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা। অভিজ্ঞতা আর ক্রমশ পরিপক্ব হওয়া বিজ্ঞানের চশমায় সেই তুফানের চেহারা আগের চেয়ে স্পষ্ট হয়েছে। তা সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত জানা নেই যে সুনির্দিষ্ট ভাবে, শত ভাগ নিশ্চয়তার সঙ্গে কোন পদ্ধতিটির অবলম্বনে চিকিৎসা-কর্মীদের ব্যক্তিগত সংক্রমণের শঙ্কা একেবারে চলে যায়।
ব্যক্তিসুরক্ষার নির্দিষ্ট আবরণী বা পিপিই অবশ্যই নিরাপত্তা দেয়। কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তা এতটাই অস্বস্তিকর, ক্ষণিকের ভুলচুকের সম্ভাবনাও তাতে থেকেই যায়। ফলে ‘নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা’ শব্দবন্ধটা ব্যবহার করা এই মুহূর্তে প্রায় অসম্ভব। নানান ওষুধপত্র খেয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা নিজেদের সাহস বাড়াচ্ছেন লড়াইয়ে যাওয়ার আগে, কিন্তু প্রতিরোধী ক্ষমতার নিরিখে তার জোর কতটা, এখনও স্পষ্ট নয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, রোগীর সংখ্যা এবং রোগের প্রাচুর্যের চাপে এ দেশে বাস্তবজীবনে স্বাস্থ্যকর্মীদের বিধি মেনে চলার দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা প্রায়ই খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। একে অবিন্যস্ত ব্যবস্থা, তায় বোলতার চাকে হাত দেওয়ার অবস্থা। অনেকের জীবনের ভার কাঁধে নিয়ে চলতে থাকা এ দেশের চিকিৎসকের জীবনে সংক্রমণ না হওয়ার ভাবনাটাই অলীক হয়ে দাঁড়ায়।
মনে রাখা দরকার, করোনার আবহে সাধারণ মানুষ যেমন আতঙ্কিত, চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরাও তাই। বরং দমবন্ধ অন্ধকারটা তাঁদেরই বেশি ঘিরেছে। কারণ, বিজ্ঞানের অপরিণত অবস্থা, অনিশ্চয়তার খবরাখবর তাঁদের কাছেই সবার আগে আসে। পাশাপাশি তাঁদেরও তো সংসার আছে, আছেন পরিজন। তাঁরাও যে রক্তমাংসের মানুষ। এই বিপদের মুখে প্রতি দিন মা অথবা বাবাকে বেরোতে দেখলে ছোট্ট মেয়েটা তাঁর জামা টেনে ধরে, মা-বাবা দুরুদুরু বুকে ঈশ্বরকে ডাকেন, স্ত্রীর চোখে জল চলে আসে অজানতেই। চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের কাঠপুতলি বা মোম মিউজ়িয়ামের মানুষ বলে ভাবলে অবুঝ প্রত্যাশা তৈরি করা হবে। চোখের সামনে এক জনকে চলে যেতে দেখলে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীও কিন্তু শিউরে উঠছেন। ভাবছেন, আমারও তো এই পরিণতি হতে পারে। আর এই মুহূর্তে এ রকম ঘটনা ঘটছে প্রায় প্রতি তৃতীয় মুহূর্তে।
যদি কেউ এই মানসিক দুর্বলতাকে জয় করে উঠতে পারেন, তিনি অবশ্যই সেরা সৈনিক। কিন্তু তা না পারলেই তিনি ‘পাতক’, এ ভাবনাও যুক্তিগ্রাহ্য বা বাস্তবসম্মত নয়। সব মানুষের ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা, শঙ্কা যুঝবার ক্ষমতা সমান নয়। দায় ও দায়িত্বের প্রশ্নটা তো নিতান্তই আপেক্ষিক, তা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হলেও জোর করে তৈরি করা যায় না। অতএব এই সব কিছু নিয়েই চিকিৎসা পেশার সংসার। তার দ্বন্দ্ব, তার দুঃখ প্রত্যেক সাধারণ মানুষের অনুধাবন করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি এই সদয় বিশ্বাসটি যদি মানুষ রাখতে না পারেন, তা হলে তাঁদের কাজ কঠিনতর হয়। তখন শুধু ভাইরাসের বিরুদ্ধে নয়, লড়তে হয় মানুষের মনোভাবের বিরুদ্ধেও। এবং সেই মানুষের, যাঁদের বাঁচানোর শপথ নিয়েই এই বিপদেও প্রতি দিন কাজে আসছেন চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা।
মাস ছয়েক হয়ে গেল, যুদ্ধ চলছে। আশার আলো এখনও নেই। এমনকি, সেই লগ্নও কেউ নির্দিষ্ট করতে পারছেন না যে, কবে এই পেশার কর্মীরা একটু হাঁপ ছাড়তে পারবেন। এই প্রেক্ষিতে নিতান্তই মানবিক এক শঙ্কা জাগে, যূথের মধ্যে যেন ক্লান্তির আবেশ না এসে পড়ে। মাঝসাগরে প্রলয় উঠলে নাবিকদের কুর্নিশ করা ও সাহস জোগানোর কাজটা নৌকার যাত্রীদেরই করে যেতে হয়। নিজেদের স্বার্থেই আমাদের এখনই এই কাজটা করতে হবে। চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা নৌকা বাইছেন ভরা উজানে। অভিপ্রায় এবং দৃঢ় বিশ্বাস— সবাইকে নিয়ে তীরে উঠবেন অচিরেই। একটু প্রেরণা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা আর বিশ্বাসই এখন একমাত্র কাঙ্ক্ষিত।
সচিব, লিভার ফাউন্ডেশন