Corona

একুশ শতকে মহামারির আক্রমণে বিপন্ন দেশ, মহাদেশ, মানবজাতি

এ পর্যন্ত কোভিড-১৯ এ অসুস্থ রোগীর সংখ্যা চার লক্ষেরও বেশি। মারা গিয়েছেন প্রায় ১২ হাজার মানুষ।

Advertisement

আলোলিকা মুখোপাধ্যায়

নিউ জার্সি শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২০ ১৯:৩০
Share:

করোনার কোপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ছবি— রয়টার্স।

কাঁচের স্বর্গে বাস করে যেদেশের মানুষ বিশ্বাস করে এসেছে দুর্ভিক্ষ, মহামারি হয় তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র অনুন্নত দেশগুলিতে, টিভি চ্যানেলে ‘ইবোলা’, ‘সার্স’-এর মতো মারণ ব্যাধিতে আক্রান্ত শিশুর ছবি দেখে ‘রেডক্রস’ এ কিছু সাহায্য পাঠিয়েছে, আজ সেই আমেরিকাতেই করোনা ভাইরাসের মতো মহামারির সংক্রমণে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত।

Advertisement

বিভিন্ন প্রদেশে এ পর্যন্ত কোভিড-১৯ এ অসুস্থ রোগীর সংখ্যা চার লক্ষেরও বেশি। মারা গিয়েছেন প্রায় ১২ হাজার মানুষ। নিউইয়র্ক আর তার প্রতিবেশী রাজ্য নিউ জার্সি আর কানটিকটে প্রতিদিন করোনায়ে আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কারণ কর্মসূত্রে হাজার হাজার লোক ট্রেনে, বাসে, সাবওয়েতে যাতায়াত করেন। ফলে নিউইয়র্ক এ ব্যাপক মহামারি এই দুই রাজ্যে প্রায় রাতারাতি ছড়িয়ে পড়েছে। এ রোগের ভরকেন্দ্র প্রধানত নিউইয়র্ক হলেও নিউজার্সির অবস্থাও আশঙ্কাজনক।

আমাদের বহুদিনের পরিচিত এক বাঙালি বন্ধু তিনদিনের জ্বরে ভুগে হঠাৎ প্রবল শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় উত্তর নিউজার্সির হাসপাতালে ভর্তি হলেন। করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ল। চার দিন ভেন্টিলেশনে থেকে মারা গেলেন। ভর্তি হওয়ার পর থেকে একটি দিনও তাঁর স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে হাসপাতালে দেখতে যেতে পারেননি। করোনা রোগীর সংস্পর্শে এসেছিল বলে দু’সপ্তাহ ধরে তারা গৃহবন্দি। জীবনের অন্তিম মুহূর্তে তার পরিবার পরিচিত জন কেউ কাছে ছিলেন না। দীর্ঘ প্রবাস জীবনে আমাদের এই নিজস্ব বাঙালি সমাজে এই প্রথম এমন ঘটল যে দুঃসময়ে কেউ তার পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পরলেন না। শহরে শহরে লকডাউন। হাসপাতাল, ফিউনারেল হোমে যাওয়া নিষেধ।

Advertisement

আরও পড়ুন: ইতিমধ্যে কাজ গিয়েছে ৯০ লক্ষের, অদূর ভবিষ্যতে ঘন অন্ধকার দেখছে সব সমীক্ষাই

সংক্রমক রোগে মৃত্যু বলে ফিউনেরাল হোমে শুধু তার পরিবারকে শেষকৃত্যে যেতে দেবে। নিজের বাড়ির আপাত নিরাপত্তা বলয়ে বসে থেকে যখন ফোনে ওই দুঃসংবাদ পেলাম, বহুদিন আগে লেখা কবিতা সিংহের কবিতার দুটো লাইন মনে পড়ল- “মানুষ যখন লড়ে তখন সবাই মিলে লড়ে, মানুষ যখন মরে তখন একা....।”

এ দেশে মানুষের মনে এখন অনেক প্রশ্ন। করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর মতো মারণ ব্যাধির সম্ভাবনার কোনও সংকেত কি পাওয়া যায়নি? কেনো পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না? কেনো দু’বছর আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের গ্লোবাল হেল্থ সিকিউরিটি ইউনিটকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন? কেনই বা মহামারির বিশেষজ্ঞদের গুরুত্ত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দিলেন? আসলে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মূলে ছিল অজ্ঞতা আর দূরদৃষ্টির অভাব। এই গ্লোবাল হেল্থ সিকিউরিটি ইউনিটের বিশেষজ্ঞরা যদি ক্ষমতায় থাকতেন চিনের করোনা সংক্রমণের মুহূর্তেই আমেরিকা প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়ার দায়িত্ব পালন করত। গ্লোবাল হেল্থ ইমার্জেন্সির সময়ে ওই বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন ইনস্টিটিউশন অর্থাৎ হেলাথ এজেন্সি, হাসপাতাল, স্টেট ও লোকাল গভর্নমেন্টের সাথে কোঅর্ডিনেট করে সংক্রমক রোগ প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

এই প্রশাসনে তাঁদের গুরুত্বও না থাকা সত্ত্বেও আমেরিকার স্বাস্থ্য দফতর কিন্তু চিনে করোনার প্রকোপ শুরু হওয়া মাত্র প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সতর্ক করছিলেন। তিনি তখনও একরকম নিশ্চিন্ত যে “চিনে ভাইরাস” আমেরিকায় হানা দিয়ে পারবেনা। ইতিমধ্যে এদেশের পশ্চিম উপকূলে করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। কাগজে কলমে প্রথম মৃত্যুর খবর পাওয়া গেল ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে। তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত নিউইয়র্ক শহরেই মৃত্যুর হার যে ভাবে বেড়ে চলেছে, ক্যালিফোর্নিয়া, ওয়াশিংটন স্টেট, ইলিনয়, লুইজিয়ানা স্টেট, নিউজার্সি, কানোটিকাট-সহ আমেরিকায় ২৫ টি স্টেট এখন মহামারির কবলে।

সময়মতো প্রস্তুতির অভাবে হাসপাতালে ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে মহামরির মোকাবিলা করার মত পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় মাস্ক, গ্লাভস, গাউন, সময় মতো সরবরাহ করা যাচ্ছে না। ডাক্তার, নার্স, হাসপাতাল কর্মী, অ্যাম্বুল্যান্স কর্মীরা সংক্রমক রোগের ঝুঁকি নিয়েও দিনের পর দিন কাজ করে যাচ্ছেন। কোভিড-১৯ প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য ওষুধ কোম্পানিগুলির গবেষণা চলছে। ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হলেও এফডিএ-র অনুমোদন পেয়ে বাজারে আসতে বছর শেষ হয়ে যাবে। আপাতত কোনও ডাক্তার পরীক্ষামূলক ভাবে ম্যালেরিয়ার ওষুধ ক্লোরোকুইন আর অ্যাজিথ্রমাইসিন দিয়ে চিকিৎসা করছেন।

ফলাফল স্পষ্ট ভাবে বোঝা যাচ্ছে না। তবে একটাই ভরসার কথা এরোগে ৮০% রোগীর ফ্লুয়ের মতো উপসর্গ হয় পরে ক্রমশ সুস্থ হয়ে যান। বাকি ২০% রোগীর যে সঙ্কটজনক অবস্থা হয় তার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে তাঁদের ক্রনিক অসুখবিসুখ এর সমস্যা থাকে। যেমন হার্টের রোগ, ব্লাডপ্রেসার, ডায়াবেটিস, আস্থ্মা, শ্বাসকষ্ট জনিত লাংসের রোগ এবং লুপাস, রিউম্যাটয়েড আর্থাইটিস ধরনের অটোইমিউন ডিজিজ। এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হওয়ার ফলে সহজে সংক্রমণ হতে পারে।

আরও পড়ুন: লকডাউনের সময়সীমা বাড়বে, সর্বদলীয় বৈঠকে ইঙ্গিত মোদীর

আমেরিকায় এখন প্রতিটি রাজ্যে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি বন্ধ হয়ে গেছে। স্কুলের ফার্স্ট গ্রেড থেকে শুরু করে ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরাও অনলাইনে ক্লাস করছে, পরীক্ষা দিচ্ছে। নিম্নবিত্ত পরিবারে স্কুলের ছেলেমেয়েদের ল্যাপটপ বিতরণ করে সাহায্য করছেন সরকারি স্কুল কর্তৃপক্ষ। অফিস, কাছারি, রেস্তরাঁ, সিনেমা হল, নিউইর্য়কের বিখ্যাত ব্রডওয়ে থিয়েটার, শপিং মল, দোকান সাময়িক ভাবে সব কিছু বন্ধ। অফিস এর কাজকর্ম চলছে অনলাইনে। চার্চ, মন্দির, মসজিদ, ইহুদিদের সিন্যাগগ কোথাও লোকজন নেই।

এ সপ্তাহে ইহুদিদের “সাবাথ” নামে ধর্মাচরণের সময়ে ভিডিয়োতেই রবাই আর ভক্তদের দেখা সাক্ষাৎ হলো। খোলা থাকছে শুধু সুপার মার্কেট, ডাক্তারের অফিস, ওষুধের দোকান আর টেক-আউট খাবারের জন্য ছোট বড় রেস্তরাঁ। সর্বত্রই ৬ ফিট দূরত্বও রেখে চলতে হচ্ছে। মাঝে দোকানে, বাজারে জিনিসপত্র ফুরিয়ে যাচ্ছিল। লোকজন মরিয়া হয়ে অতিরিক্ত পরিমাণে বাজার করছিল। তবে এখন শৃঙ্খলা ফিরে এসছে। আমরা সাতসকালে উঠে গ্রসারি শপে গিয়ে ফাঁকায় ফাঁকায় বাজার করে আনছি। সকলেই বিচ্ছিন্ন তবু ফোন আর সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগাযোগ থাকছে। যোগাযোগ না হলেই আশঙ্কা, দুশ্চিন্তা। সকলের একটাই প্রশ্ন ঠিক আছ তো?

আমাদের পাড়ায় নেবারহুড নেটওয়ার্ক আছে। কমবয়েসী স্বেচ্ছাসেবী ছেলেমেয়েরা অনলাইনে নিয়মিত খোঁজখবর নেয়। ওষুধপত্র সুপার মার্কেট থেকে প্রয়োজনীয় কিছু আনতে হবে কি না, জেনে নেয়। দরকার পড়লে ৬ ফিট দূরত্বে দাঁড়িয়ে বাড়ির দরজায় প্যাকেট পৌঁছে দেয়। এখনও প্রয়োজন হয়নি, তবু মনে একটু স্বস্তি পাই।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একটি মহৎ কাজ করছেন। কংগ্রেসের নতুন বিল ২.২ লক্ষ কোটি ডলার অনুমোদন করছেনে। এর ফলে ১৫ কোটি পরিবার সরাসরি অর্থ সাহায্য পাবে। এই বিল অনুযায়ী চার হাজার কোটি ডলার ছোট ব্যবসায়ীদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ এর জন্যে দেওয়া হবে। ২৫০ বীলিয়ন ডলার দেওয়া হবে বেকার ভাতা বাড়ানোর প্রয়োজন এ। পাঁচ হাজার কোটি ডলার দেওয়া হবে ক্ষতিগ্রস্ত বৃহৎ কোম্পানি গুলিকে। যেমন এয়রলাইন ইন্ডাস্ট্রি, বিমান নির্মাতা বোয়িং কোম্পানি, এছাড়া এই বিল থেকে বিভিন্ন রাজ্যের আর্থিক সঙ্কটের সমাধান করা হবে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ও হাসপাতালগুলিতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের ব্যবস্থা চলবে।

দেশের এই প্রতিকূল পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে জানি না। রোগের আতঙ্ক, আর্থিক অনিশ্চয়তা, সামাজিক ও পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা, একাকিত্বের ক্লান্তি দীর্ঘদিন বহন করা কঠিন। তবু এই অভিজ্ঞতাই হয়ত ধৈর্য, সহনশীলতা, মানবিকতার চেতনায় জীবনকে অনুপ্রাণিত করবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement