সহিষ্ণুতা একতরফা হয় না

নিজেদের মতাদর্শ ছাড়া অন্য সব মতই অশুভ, তাই মুণ্ডচ্ছেদ?

অতীতে ভারতের মুসলমান শাসকরা কিন্তু জানতেন, সমস্ত সম্প্রদায় ও ধর্মকে সম্মান করলে তবেই তাঁদের রাজত্বে সবাই শান্তিতে থাকতে পারবেন।

Advertisement

ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২০ ০২:৩০
Share:

দ্বেষাগ্নি: ইস্তানবুলে পোড়ানো হচ্ছে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ-র ব্যঙ্গচিত্র। ৩০ অক্টোবর, ২০২০। এএফপি

দশম শতাব্দীর শ্রদ্ধেয় সুফি সাধক হুসেন ইবন মনসুর আল-হাল্লাজ সর্বত্র ঈশ্বরকে দেখতেন, এমনকি নিজের মধ্যেও। এক বার নাকি সুলতান তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি কে। তাঁর জবাব ছিল: ‘‘আমি সত্য’’, কিংবা, ‘‘আমি ঈশ্বর।’’ সুলতান এই উক্তিকে ধর্মদ্রোহ বলে সাব্যস্ত করেন এবং তাঁর মুন্ডু কাটার হুকুম দেন। কট্টর ইসলামি বিশ্বাসের প্ররোচনায় মুণ্ডচ্ছেদের ঐতিহ্য যে সব ঘটনায় শুরু হয়েছিল, এটি তার অন্যতম।

Advertisement

রুমি, দুনিয়ার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ সুফি, হাল্লাজ সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘‘তিনি বলেন, ‘আমার কিছুই আর বাকি নেই/ আমি হলাম একটি পদ্মরাগ মণি, সূর্যোদয়ের সামনে যাকে মেলে ধরা হয়েছে।/ সে কি এখনও একটি পাথরমাত্র, না কি সে এক জগৎ/ যে রক্তিমা দিয়েই গড়া?/ সূর্যরশ্মিকে বাধা দিতে যে অক্ষম?’/ হাল্লাজ এই ভাবেই জানিয়েছিলেন, আমি ঈশ্বর।/ এবং তিনি সত্যবাক্যই উচ্চারণ করেছিলেন:/ চুনি এবং সূর্যোদয় অভিন্ন।’’

সত্যের মতো ধর্মীয় ধারণাগুলিও যে অনেক সময়েই বহুমাত্রিক হতে পারে, ধর্মান্ধরা তা মানতে নারাজ। যে কট্টরপন্থীরা চিরকাল হিংসায় উন্মত্ত প্রচার চালিয়ে যায় তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, তাদের মতাদর্শ ছাড়া অন্য সমস্ত মতই অশুভ। এরাই মুণ্ডচ্ছেদের প্রবক্তা। এদের তাণ্ডবই দুনিয়ায় চলছে, এখন দেখা যাচ্ছে ফ্রান্সে। কট্টরপন্থীরা একের পর এক মানুষকে হত্যা করেছে, কারণ তাদের বিচারে ওরা ধর্মবিদ্বেষী।

Advertisement

স্যামুয়েল প্যাটি প্যারিসের কাছে একটি স্কুলে পড়াতেন। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে বিশ্বাসী এই শিক্ষক গত মাসে ক্লাসে বাক্স্বাধীনতা বিষয়ে পড়ানোর সূত্রে নবির কিছু বিতর্কিত কার্টুন দেখিয়েছিলেন। সমাজমাধ্যমে তাঁর বিরুদ্ধে হিংস্র আক্রমণ শুরু হয়। সেই বিদ্বেষী প্ররোচনায় আঠারো বছর বয়সি এক তরুণ প্যাটির মুণ্ডচ্ছেদ করে তাঁকে হত্যা করে। পরে সে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়।

ফ্রান্সে, বা পৃথিবীর অন্যত্রও, মুসলমানরা সাধারণ ভাবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেনি। হত্যা যে অন্যায়, সেটা তাঁরা স্বীকার করেছেন বটে, কিন্তু অনেকেই বলেছেন, নবির অমর্যাদা করে ওই শিক্ষক তাঁর আততায়ীকে প্ররোচনা দিয়েছিলেন। প্যাটির স্মরণসভায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে জোরদার বক্তৃতা দেওয়ায় মুসলিমদের ক্রোধ আরও বেড়ে যায়। ফরাসি গণমাধ্যমে ও সরকারের উদ্দেশে সেই ক্রোধ আছড়ে পড়তে থাকে। এমনকি দু’টি মুসলিমপ্রধান দেশের রাষ্ট্রনায়ক— তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়িপ এর্দোয়ান এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান— মাকরঁ ইসলাম-ভীতিতে ইন্ধন জোগাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন। সৌদি আরব-সহ ইসলামি দুনিয়ার অনেক দেশে ফরাসি পণ্য বয়কটের ডাক দেওয়া হয়।

কয়েক দিন পরেই আর এক মুসলিম তরুণ দক্ষিণ ফ্রান্সের নিস-এ একটি গির্জায় হানা দিয়ে এক মহিলার মুণ্ডচ্ছেদ করে, আরও এক মহিলা ও এক পুরুষকে হত্যা করে। ধরা পড়ার পর জানা যায়, সেই তরুণ টিউনিসিয়া থেকে ফ্রান্সে ঢুকেছে। নিস-এর মেয়র এই ঘটনাকে ‘ইসলামি ফ্যাসিবাদ’ বলে অভিহিত করে জানান, ওই তরুণ উন্মাদের মতো ছুরি চালাতে চালাতে বারংবার ধর্মীয় স্লোগান দিচ্ছিল। একই সময়ে সৌদি আরবের ফরাসি দূতাবাসে এক প্রহরী গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর জখম হন। ফ্রান্সে আর এক সম্ভাব্য আততায়ী এক পুলিশের দিকে গুলি ছোড়ার আগেই পুলিশ তাকে গুলি করে হত্যা করে।

মুণ্ডচ্ছেদ ও হত্যাকাণ্ডের এই ধারা চলেছে ২০১৫-র গোড়া থেকে, যখন ব্যঙ্গ-পত্রিকা শার্লি এবদো-য় নবিকে নিয়ে কার্টুন প্রকাশের পরে দুই ইসলামি বন্দুকবাজ পত্রিকা অফিসে ঢুকে এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। বারো জনের মৃত্যু হয়েছিল। তার পর থেকেই ফ্রান্সে বার বার ধর্মান্ধদের আক্রমণ ঘটেছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর তাণ্ডবটি ঘটেছিল ২০১৫-র নভেম্বরে। হানাদারেরা একযোগে প্যারিসের একটি প্রেক্ষাগৃহ, একটি স্টেডিয়াম এবং একাধিক বার ও রেস্তরাঁয় আক্রমণ করে। ১৩০ জন নিহত হন, আহতের সংখ্যা ছিল কয়েকশো।

এই হিংসার স্রোত থেকে যেটা স্পষ্ট তা হল, ফ্রান্সের উদার জীবনাদর্শের উপর পরিকল্পিত আক্রমণ। নিহত স্কুলশিক্ষক বা অন্যদের বিরুদ্ধে কট্টর মুসলিমদের যে বিদ্বেষ, আততায়ীদের কার্যকলাপ তার একটা অংশ। বিভিন্ন ইসলামি গোষ্ঠী— তাদের মধ্যে সমাজমাধ্যমের নানা দলও আছে— এবং অন্যরাও বদলা চেয়েছে। পরিণামে দেখা যাচ্ছে কুৎসিত এক সংঘর্ষ।

সাম্প্রতিকতম এই আক্রমণের ঘটনাগুলি ফ্রান্স এবং ইউরোপের অনেক দেশেই পরিস্থিতির মোড় ঘোরাতে পারে। ইউরোপের উদারপন্থীরাও এ বার অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। ভারতীয় মনস্তত্ত্ববিদ রজত মিত্র তাঁর পেশায় নিযুক্ত এক ফরাসি বিশেষজ্ঞের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, যাঁর মতে, ‘‘এ বারের মুণ্ডচ্ছেদের ঘটনাটিকে ফরাসিরা আর নিছক এক ব্যক্তির অপকীর্তি হিসেবে দেখছেন না, দেখছেন একটা পরিকল্পিত অভিযানের অঙ্গ হিসেবে। ফরাসি সত্তা, জাতি ও অস্মিতা বলতে যা বোঝায়, তার ভিত্তিমূলে প্রবল আঘাত বলেই গণ্য হচ্ছে এটা। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সমস্ত ফরাসি নাগরিকের দায়িত্ব।’’ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, নবিকে নিয়ে বিতর্কিত ব্যঙ্গচিত্রগুলি কেন মুসলমানদের অনেককেই ক্ষুব্ধ করেছে তা তিনি বুঝতে পারেন, কিন্তু তার প্রতিক্রিয়ায় হিংসাকে তিনি কখনওই বরদাস্ত করতে পারেন না।

ইসলামের নামে হিংস্র আক্রমণের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলিকে ধিক্কার দিতে গিয়ে দ্বিধার কোনও স্থান নেই। এখানে কোনও ‘কিন্তু’ চলতে পারে না। ফ্রান্সে যা ঘটেছে, তার দায় ফরাসিদের উপরেই চাপানোর যে প্রবণতা বেশ কিছু মুসলিম দেশে দেখা যাচ্ছে, তা কেবল ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম-ভীতিকেই বাড়িয়ে তুলবে। ঘটনা হল, ইসলামবাদীরা (ইসলামিস্ট) যেখানে পারছে মুণ্ডচ্ছেদ ও অন্যান্য নৃশংস হত্যাকাণ্ড আকছার ঘটিয়ে চলেছে, বহু ক্ষেত্রে মুসলিমরাই তার শিকার— ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ থেকে শুরু করে ইউরোপের নানা দেশে। সিরিয়া ও ইরাকে ইসলামিক স্টেট-এর বিরোধী ইয়াজ়িদি, কুর্দ, শিয়া ও অন্যান্য গোষ্ঠীর অগণিত মানুষকে এ ভাবে হত্যা করা হয়েছে। প্রতিবেশী বাংলাদেশে ইসলামবাদীরা স্বদেশের বিস্তর মানুষকে হত্যা করেছে এই অপরাধে যে, তাঁরা ওদের কট্টরপন্থা মানতে রাজি হননি। পাকিস্তানে ধর্মদ্রোহের অভিযোগে ক্রমাগত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এমনকি, সে দেশের পঞ্জাব প্রদেশের গভর্নর সলমন তাসির-এর মতো উচ্চপদাধিকারীও দেশের ধর্মদ্রোহ আইনের প্রতিবাদ করে আততায়ীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। দুনিয়া জুড়ে বহু মানুষ এখন মনে করেন, নিজেদের ধর্মবিশ্বাসের প্রশ্নে কট্টরবাদী মুসলিমরা সম্পূর্ণ অসহিষ্ণু। ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে এই ভাবনা থেকেই, এ জন্য ফরাসি বা অন্য নেতাদের কথাবার্তাকে দায়ী করে লাভ নেই। কট্টরপন্থী মুসলমানরা যত ক্ষণ অন্যদের ধর্মীয় বা মতাদর্শগত আবেগকে মর্যাদা না দেবে, তত ক্ষণ অন্যরাও তাদের ধর্মবিশ্বাসকে মর্যাদা দেবে না।

অতীতে ভারতের মুসলমান শাসকরা কিন্তু জানতেন, সমস্ত সম্প্রদায় ও ধর্মকে সম্মান করলে তবেই তাঁদের রাজত্বে সবাই শান্তিতে থাকতে পারবেন। বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর অসহিষ্ণুতা ক্রমশ বেড়ে চলা সত্ত্বেও ভারতে সমন্বয়ী সংস্কৃতি আজও টিকে আছে। মানুষের ধর্মীয় আবেগে আঘাত করে, এমন কোনও আচরণকেই ভারতে সচরাচর সহ্য করা হয় না। ধর্মীয় নেতার ব্যঙ্গচিত্র, ধর্মগ্রন্থের অপমান ইত্যাদি ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে ধরপাকড় ও অন্যান্য ব্যবস্থা করা হয়। অর্থাৎ, নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা বলে কিছু এ দেশে নেই, থাকা কাম্যও নয়। মুসলমানদের নবিকে অথবা ইসলামের মূল নীতি বা ধর্মগ্রন্থকে যথেচ্ছ অপমান করার স্বাধীনতা কারও থাকা উচিত নয়। কিন্তু অন্য দিকে এ দেশে, বিশেষত উত্তর ও পশ্চিম ভারতে, যেখানে হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাস বিশেষ জোরদার, সেখানে তাদের সেই বিশ্বাসকে অনেক সময়েই যথেষ্ট মর্যাদা দেওয়া হয় না। একটা উদাহরণ দেওয়া যায়। ব্যক্তিগত ভাবে কেউ মনে করতেই পারেন, গোমাংস ভক্ষণে কোনও দোষ নেই, ঠিক যেমন কোনও ফরাসি মনে করতে পারেন নবির সমালোচনাতে কোনও অপরাধ নেই। কিন্তু এই ধরনের আচরণ কোনও সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দিলে তেমন আচরণে বিরত থাকা উচিত নয় কি? এই কারণেই তো সম্রাট বাবর বা আকবর গোহত্যা নিষিদ্ধ করেছিলেন। হয়তো এই কারণেই তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার তসলিমা নাসরিনকে রাজ্যে থাকার অনুমতি দেয়নি।

একটা সভ্য দেশে নিঃশর্ত স্বাধীনতা বলে কিছু হয় না। গভীর জনবিশ্বাস ও সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার সামঞ্জস্য বিধান করাই লক্ষ্য হওয়া উচিত। ফরাসিদেরও এই লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement