ছবি: সংগৃহীত
রোগীর মৃত্যুর জেরে চিকিৎসকের হেনস্থা, এ যেন নিয়ম হইয়া দাঁড়াইতেছে। সম্প্রতি কলিকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে এক প্রসূতির অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর পর ফের এক সংঘাত বাধিল। পরিবারের অভিযোগ, রোগীর অবনতি সম্পর্কে কিছুই জানানো হয় নাই। চিকিৎসকের বক্তব্য, হৃৎপিণ্ড বা ফুসফুসে অবরোধ তৈরি হইবার কারণে মৃত্যু ঘটিয়া থাকিতে পারে, তাহা সর্বদা নিবারণযোগ্য নহে। বিতর্ক চলিতে পারে, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে উভয় পক্ষই। এমন সঙ্কট এই হাসপাতালটিতে পূর্বেও ঘটিয়াছে। অন্যত্রও। সমাধান খুঁজিতে কখনও দরজায় কড়া পাহারা বসিতেছে, কখনও চিকিৎসা-বিভ্রাটের দ্রুত বিচারের জন্য কমিশন বসিতেছে। কোনওটিই চিকিৎসাপ্রার্থীকে যথাযথ পরিষেবা পাইবার নিশ্চয়তা, বা চিকিৎসককে নিরাপত্তা পাইবার আশ্বাস দিতে নাই। তাই একই সমস্যার পুনরাবৃত্তি ঘটিতেছে। অতএব ভাবিতে হইবে, চিকিৎসাব্যবস্থার মধ্যেই সমস্যা রহিয়াছে কি না। আগে সেই মৌলিক সমস্যাকে চিহ্নিত করিতে হইবে।
একটি সমস্যা এই যে, মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নির্ধারণ করিতে ‘ক্লিনিক্যাল অটপ্সি’ অর্থাৎ শবব্যবচ্ছেদের রীতি এ দেশে নাই। মৃত্যু লইয়া পুলিশে অভিযোগ হইলে তবেই মেডিকো-লিগ্যাল অটপ্সি হইয়া থাকে। দ্বিতীয়টি বিষয়ে যাঁহার অভিজ্ঞতা আছে, তিনিই বুঝিয়াছেন যে মৃত্যুশোকের উপর পুলিশের হয়রানি যোগ হইলে তাহা কত দূর মর্মান্তিক হইয়া ওঠে। অনেকটা সেই ভীতির কারণে, এবং কিছুটা মৃতদেহের সম্মান-সম্পর্কিত বিবিধ ধর্মীয় সংস্কারের কারণে, ব্যবচ্ছেদে অনেকেই আপত্তি প্রকাশ করেন। হাসপাতালগুলিও তাহার প্রয়োজন সম্পর্কে রোগীর পরিবারকে অবহিত করে না। কিন্তু মৃত্যুর কারণ নির্ধারণ করিবার জন্য চিকিৎসকেরা হাসপাতালেই ব্যবচ্ছেদ করিয়া থাকেন, স্বল্প সময়েই তাহা করা সম্ভব। চিকিৎসকের রোগনির্ণয়ে এবং চিকিৎসাপদ্ধতিতে ভ্রান্তি ছিল কি না, তাহা নির্ধারণ করিবার সহজ উপায় ক্লিনিক্যাল ব্যবচ্ছেদ। দিল্লির শীর্ষ সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ‘এমস’ এবং চণ্ডীগড়ের স্নাতকোত্তর মেডিক্যাল কলেজে নিয়মিত ‘ক্লিনিক্যাল অটপ্সি’ হইয়া থাকে। রোগী ভর্তি করিবার সময়ে সে বিষয়ে অনুমতিদান বাধ্যতামূলক। ইহা যেমন ছাত্র ও শিক্ষানবীশ চিকিৎসকদের শিখিবার এক অতুলনীয় সুযোগ, তেমনই হাসপাতালে চিকিৎসার মান নিয়ন্ত্রণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। যে কোনও ‘অকস্মাৎ মৃত্যু’ বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরীক্ষিত হইবে, এই নিশ্চয়তা থাকিলে চিকিৎসকেরাও সতর্ক থাকেন।
অপর একটি ব্যবস্থাগত ত্রুটি, হাসপাতালগুলির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা। আধুনিক চিকিৎসা একটি দলবদ্ধ উদ্যোগ। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতোই গুরুত্বপূর্ণ তরুণ চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর ভূমিকা। বিশেষত অস্ত্রোপচারের পরে নিয়মিত রোগীর পর্যবেক্ষণের কাজটি এই কর্মীরাই করেন। সেই সঙ্গে, রোগীর পরিবারের সহিত সংযোগের জন্য, শোকের মুহূর্তে তাঁহাদের সহায়তার জন্য বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষিত কর্মীরও প্রয়োজন হাসপাতালে। কিন্তু দলবদ্ধ চিকিৎসার রীতি এখনও গড়িয়া ওঠে নাই এ রাজ্যে। সকল কাজের ভার চিকিৎসকের উপর চাপিয়াছে, ফলে তাঁহার বিপন্নতা বাড়িতেছে। উত্তম চিকিৎসা দিতে হইলে উৎকৃষ্ট ‘চিকিৎসা-দল’ তৈরি করিতে হইবে।