সপ্তাহে দুই দিন লকডাউন করিবার পরামর্শ দিয়াছিলেন যে বিজ্ঞানীরা, তাঁহারা হতবাক। লকডাউন উঠিলেই মানুষ যে আক্ষরিক অর্থেই প্রাণপণ ঝাঁপাইয়া পড়িবে বাজার করিতে আর চায়ের দোকানে আড্ডা মারিতে— বিজ্ঞানীদ্বয় জানাইয়াছেন, তাঁহাদের গাণিতিক মডেলে এই কথাটি ধরা ছিল না। কেহ হাসিয়া বলিতে পারেন, লোকসমাজ হইতে বহু দূরে গজদন্তমিনারে বসিয়া গবেষণা করিলে ইহাই হয়। কেহ রাগিয়া যাইতে পারেন— যে মডেলের প্রাথমিক অনুমানটিই ভ্রান্ত, তাহার অনুসরণে সপ্তাহে দুই দিন লকডাউন পালনের অর্থ কী? অগস্ট মাসের লকডাউন-সূচি দেখিয়া কেহ অবশ্য ভাবিতেই পারেন যে শনি-রবির সহিত শুক্র বা সোম জুড়িয়া দীর্ঘতর উইকএন্ডের ব্যবস্থা করিবার যে রেওয়াজ গত কয়েক বৎসরে রাজ্য সরকার চালু করিয়াছে, লকডাউনে তাহারই অনুশীলন হইতেছে। কিন্তু সে কথা নাহয় থাকুক। এক্ষণে ভাবা প্রয়োজন, সপ্তাহে দুই দিন লকডাউনের এই নিদানটি যদি ব্যর্থ হয়, তবে কি তাহা শুধু বিজ্ঞানীদের দোষে? অথবা প্রশাসনের দোষে? দেশের সর্বাধিক প্রয়োজনে নাগরিকরা রাষ্ট্রীয় নির্দেশ পালন করিতে অরাজি হইবেন না, এমন একটি অনুমান কি সত্যই অলীক? নাগরিকের নিকট এই সহযোগিতা কি সত্যই প্রত্যাশা করা চলে না? যদি তাহাই হয়, তবে দেশের মানুষ কি সত্যই ‘নাগরিক’ নামক সম্মানটির যোগ্য? না কি, তাঁহারা ‘প্রজা’ হইয়াই থাকিয়া গিয়াছেন, নাগরিকত্ব অর্জনের সাত দশক পরেও?
অতিমারির প্রথম প্রহরে যদি কেহ সামাজিক দূরত্ববিধি পালন, মাস্ক পরা বা ঘরে থাকিবার গুরুত্ব উপলব্ধি না-ও করিয়া থাকেন, গত চার মাসের ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করিবার পর সেই অজ্ঞতা দূর না হইবার কোনও কারণ নাই। এবং, মানুষ সচেতন না হইলে, সহযোগিতা না করিলে কোনও লকডাউনই যে কার্যকর হইতে পারে না, তাহাও একই রকম স্পষ্ট। দেশের সিংহভাগ মানুষের পক্ষে লকডাউন এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি— তাঁহাদের উপার্জনের পথ বন্ধ, অনেকেরই পাতে ভাতটুকুও নাই। এই অবস্থাকে অতিক্রম করিবার একমাত্র পথ যে কোভিড-১৯’এর বিরুদ্ধে জয়লাভ, এত দিনে তাহা দ্ব্যর্থহীন ভাবে স্পষ্ট। অনির্দিষ্ট কাল লকডাউন চালাইয়া এই যুদ্ধে জেতা যাইবে না, কারণ তাহাতে ভাইরাসের পূর্বেই মারা পড়িবেন বহু কোটি গরিব মানুষ। এই সম্পূর্ণ ছবিটি জানিবার পরও কেন নাগরিকরা লকডাউনের পরের দিন আপনহারা হইয়া পথে বাহির হইবেন, কেন ‘এই একটু বাহির হইয়াছি’ বলিয়া মাস্ক ছাড়াই ঘুরিবেন, এই মুহূর্তে সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা প্রয়োজন। জীবিকার তাগিদের কথা উঠিলে বলিতে হইবে, এই দায়িত্বজ্ঞানহীনতা যে তাঁহাদের জীবিকাকে আরও দীর্ঘতর সময়ের জন্য বিপর্যস্ত করিতেছে, এই কথাটুকু সাধারণ মানুষের বোঝা প্রয়োজন।
নাগরিক হিসাবে যে কিছু অনস্বীকার্য দায়িত্ব আছে, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই কথাটি ভারতের সিংহভাগ মানুষ বোঝেন না। বয়স যতই হউক, তাঁহাদের শৈশব আর অতিক্রান্ত হয় না। ফলে, তাঁহারা রাষ্ট্রের সহিত চোর-পুলিশ খেলায় নামিয়াছেন— প্রশাসনের চোখে ফাঁকি দিতে পারিলেই তাঁহাদের আনন্দ, পরিণতির কথা ভাবিবার অবকাশ তাঁহাদের নাই। কেহ সেই কথা স্মরণ করাইয়া দিলে রাগ গিয়া পড়ে তাঁহার উপর। সম্প্রতি এই রাজ্যেই এক প্রবীণ নাগরিকের মাথা ফাটাইয়া দিয়াছে কিছু দুষ্কৃতী— ভদ্রলোক তাহাদের মাস্ক পরিতে অনুরোধ করিয়াছিলেন বলিয়া। এই অপরাধীদের নাহয় জেলে পুরিয়া দেওয়া চলে। যাঁহারা শুধু নিয়ম ভাঙিতেছেন, তাহাদেরও যদি গ্রেফতার করিয়া, শাস্তি দিয়া নাগরিক কর্তব্য শিখাইতে হয়, তাহা অতি দুর্ভাগ্যের। কিন্তু, আপাতত তাহাই একমাত্র রাস্তা। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমেই এই অপ্রাপ্তমনস্কদের নাগরিকতায় উত্তীর্ণ করা হউক।