রাহুল সিংহ। ফাইল চিত্র।
দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্তে দৃশ্যত অখুশি পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির একাংশ। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দলের জাতীয় পদাধিকারীদের নাম ঘোষণা করিতেই বিরোধটিও প্রকাশ্যে আসিয়াছে। তাঁহাদের ক্ষোভের উৎস সন্ধান করিতে গেলে যাহা সামনে আসে, আপাতদৃষ্টিতে তাহা আদি ও নব-র বিবাদ। যে কোনও দলেই পুরাতনকে পিছনে ফেলিয়া তুলনায় নবীন কোনও নেতাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে তুলিয়া আনিলে তাহার কিছু অভিঘাত অনুভূত হয়। রাজ্যের শাসক তৃণমূলে যুব নেতার অভিষেক বা জাতীয় রাজনীতিতে বয়সে নবীনতর কংগ্রেস নেতার উত্থান লইয়াও এমন ক্ষোভ-অনুযোগের নজির আছে। বিজেপির ক্ষেত্রে এই ক্ষোভে একটি ভিন্নতর মাত্রা আছে— যাঁহাদের লইয়া বিতর্ক, তাঁহারা দলে ‘বহিরাগত’। তৃণমূল ছাড়িয়া বিজেপিতে আসা মুকুল রায়, অনুপম হাজরা, সৌমিত্র খাঁ প্রমুখ এই আপত্তির কেন্দ্রে।
জাতীয় দলে পদাধিকার হারাইয়া বাংলার প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ যাহা বলিয়াছেন, ইহাই তাহার সারমর্ম। সঙ্ঘ-শৃঙ্খলায় জারিত ‘আদি’ বিজেপির দৃষ্টিতে এ সবই ‘প্রতিপক্ষ’ শিবির হইতে আসা ‘নব’দের প্রতিষ্ঠাদানের সুচিন্তিত পরিকল্পনা। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এমন জেহাদ বিজেপির ন্যায় ‘রেজিমেন্টেড’ দলে কার্যত অভূতপূর্ব। কিন্তু, আদি বনাম নব-র এই দ্বন্দ্ব মূল সমস্যা নহে, তাহার একটি প্রকাশমাত্র। সমস্যা হইল, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিবেচনার সহিত রাজ্য স্তরের বিবেচনার ফারাক— সিদ্ধান্তগত বিরোধ। সর্বভারতীয় দলের ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্যের এই ব্যবধান কার্যত অনিবার্য। কংগ্রেস দীর্ঘ কাল এই সমস্যায় ভুগিয়াছে— সর্বভারতীয় রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে গৃহীত হাইকম্যান্ডের সিদ্ধান্ত প্রাদেশিক রাজনীতিতে দলীয় সংগঠনের ক্ষতি করিয়াছে। এমনকি, যাহাকে সর্বভারতীয় দল বলিয়া দাবি করিলে হয়তো এ কে গোপালন ভবনেও হাস্যরোল উঠিবে, সেই সিপিআইএম-ও কেরল বনাম পশ্চিমবঙ্গের দ্বন্দ্বে ভুগিয়াছে বিলক্ষণ। এই টানাপড়েনের বিকল্প মডেলটি হইল আঞ্চলিক দলের। তৃণমূল কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, ডিএমকে-এডিএমকে বা শিবসেনার ন্যায় আঞ্চলিক দলের ক্ষেত্রে রাজ্যই সর্বপ্রথম। কোনও সর্বভারতীয় সমীকরণই রাজ্যের স্বার্থের ঊর্ধ্বে ঠাঁই পায় না।
সর্বভারতীয় দল হিসাবে কংগ্রেস যে সমস্যায় জর্জরিত ছিল, সঙ্ঘ-শৃঙ্খলার জোরে বিজেপি বহু দিন তাহাকে পাশ কাটাইয়া চলিতে সক্ষম হইয়াছে। কিন্তু, সেই বাঁধনের গ্রন্থি শিথিল হইতেছে কি? পশ্চিমবঙ্গে রাহুল সিংহদের জেহাদ তাহার একটি উদাহরণ, কিন্তু একমাত্র নহে। মহারাষ্ট্রেও দলের কেন্দ্র-রাজ্য টানাপড়েনের ছাপ স্পষ্ট। বিহারের নির্বাচনের কথা মাথায় রাখিয়া সর্বভারতীয় বিজেপি যে ভাবে সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যুকে মরাঠি বনাম বিহারি দ্বৈরথে পরিণত করিয়াছে, তাহাতে বিহারে লাভ হইবে কি না, সেই উত্তর ভবিষ্যৎ দিবে— কিন্তু মহারাষ্ট্রে দল বিলক্ষণ সমস্যায় পড়িতেছে। শিবসেনার সহিত বিচ্ছেদের পর দেবেন্দ্র ফডণবীসের মরাঠি ভোটব্যাঙ্কের দখল লইবার তাগিদ থাকিবে, তাহাই স্বাভাবিক। সর্বভারতীয় রাজনীতি রাজ্যের সেই স্বার্থটিকে অগ্রাহ্য করিতেছে। মধ্যপ্রদেশেও জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে লইয়া দলের অভ্যন্তরে প্রশ্ন ও অসন্তোষ স্পষ্ট। অর্থাৎ, বিজেপি যত উল্কাবেগে সাম্রাজ্যবিস্তার করিতে চাহিতেছে, কেন্দ্র বনাম প্রান্তের বিভেদরেখাগুলিও ততই ফুটিয়া উঠিতেছে। দলীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে কংগ্রেস এই ফাটল সামলাইতে বহুলাংশে ব্যর্থ হইয়াছে, এবং তাহার মূল্যও চুকাইয়াছে। সিপিআইএম তাহার সমস্ত রাজনৈতিক তাৎপর্য হারাইবার ফলে দলের ক্ষেত্রে এই প্রশ্নটিও অবান্তর হইয়া গিয়াছে। বিজেপি কোন পথে এই দ্বন্দ্বের মোকাবিলা করে, এই মুহূর্তে তাহাই দেখিবার।