প্রবন্ধ ১

অভিন্ন বিধি: তিন দশকের অচলাবস্থা

স্বাধীনতার পর সংবিধান-রচয়িতারা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করতে পারেননি, তার কারণ ছিল। কিন্তু তার পর? সামাজিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক সচেতনতা আমাদের একটুও এগিয়ে দিতে পারল কি? ইলাহাবাদের বউ, কাশীপুরের মেয়ে সায়রা বানো। পড়াশোনা-করা। সমাজতত্ত্বে স্নাতক। ইচ্ছে ছিল স্কুলে পড়ানোর। বিয়ে হয়ে গেল বলে আর হল না। একের পর এক সন্তান, আর একের পর এক গর্ভপাত নিয়ে দিন কাটছিল, এমন সময় স্বামী রিজওয়ানের মুখে উচ্চারণ হল: তিন তালাক।

Advertisement

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৬ ০০:০০
Share:

ইলাহাবাদের বউ, কাশীপুরের মেয়ে সায়রা বানো। পড়াশোনা-করা। সমাজতত্ত্বে স্নাতক। ইচ্ছে ছিল স্কুলে পড়ানোর। বিয়ে হয়ে গেল বলে আর হল না। একের পর এক সন্তান, আর একের পর এক গর্ভপাত নিয়ে দিন কাটছিল, এমন সময় স্বামী রিজওয়ানের মুখে উচ্চারণ হল: তিন তালাক। সন্তানদের শ্বশুরবাড়িতে রেখেই বাপের বাড়ি ফিরে আসতে হল এক (তিন?) কথায়। ছেলেমেয়ের মুখ দেখার অধিকার রইল না, তিন মাস ইদ্দত (অপেক্ষা) কেটে গেলে খোরপোশ বলেও কিছু রইল না। তেমনই বিধান শরিয়তের, সকলে জানাল। সকলেরই নাকি এমন হয়।

Advertisement

সায়রা বানো ‘সকলের’ মতো নন। তিনি আদালতে গেলেন। এই মুহূর্তে তাঁর মামলা সুপ্রিম কোর্টে। এই মুহূর্তে সুপ্রিম কোর্ট দুশ্চিন্তা ও দ্বন্দ্বে গ্রস্ত, সরকারের কাছে মুসলিম উইমেন অ্যাক্ট (১৯৮৬) বিষয়ে রিপোর্টের প্রত্যাশায়, যার ভিত্তিতে মামলা এগোবে। এবং এই মুহূর্তে, তাঁর মামলার অভিঘাতে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড সরকারকে শাসানি দিয়েছে, কোনও ভাবে ইসলামি আইনের এক্তিয়ারে হস্তক্ষেপ চলবে না, মনে রাখতে হবে যে বিয়ে বা বিয়ে-বিচ্ছেদ মুসলিমদের নিজস্ব আইনের আওতায় পড়ে।

সায়রা বানো কিন্তু ঠিক মুসলিম পার্সোনাল ল’-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেননি, অভিন্ন দেওয়ানি বিধির জন্য আবেদন করেননি। তিনি কেবল নিজের জন্য সুবিচার চেয়েছেন। ভারতীয় নাগরিক হিসেবে দেশের সংবিধান অনুয়ায়ী তাঁর কোনও অধিকার আছে কি না, জানতে চেয়েছেন। যদি তেমন কোনও অধিকার থেকে থাকে, তবে কী ভাবে তা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে, তার দিশা পেতে চেয়েছেন। অর্থাৎ অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নিজের মামলাকে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বনাম ধর্মসম্প্রদায়ের নিজস্ব সংস্কৃতি ও বিধিবিধানের মধ্যে যে সংঘর্ষ, তার বাইরে রেখে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বনাম অধিকার-চ্যুত নাগরিকের প্রশ্নোত্তরে পরিণত করেছেন। এইখানেই তাঁর মামলার বিশেষত্ব। সুপ্রিম কোর্টকে এই ভাবেই তিনি আর একটা অগ্নিপরীক্ষার সামনে এনে ফেলেছেন।

Advertisement

অগ্নিপরীক্ষা, সন্দেহ নেই। সায়রা বানো যে ভাবেই মামলাটি দায়ের করুন না কেন, পার্সোনাল ল বোর্ড কিন্তু চিরাচরিত দ্বিপাক্ষিক যুদ্ধ হিসেবেই বিষয়টিকে দেখছে। এবং দুই পক্ষ বলতে তাদের কাছে ব্যক্তি বনাম রাষ্ট্র নয়, সোজাসুজি মুসলিম সমাজ বনাম রাষ্ট্রের সংঘর্ষ। তাদের বক্তব্য, মুসলিম আইন ডিঙিয়ে কোনও মুসলিম মহিলাকেই রাষ্ট্র তার ইচ্ছে মতো আইনের আওতায় আনতে পারে না। বিশেষ করে নিকাহ্ বা তালাকের মতো ব্যাপারে, যেখানে নাকি শরিয়তের গাইডলাইন আছেই। শরিয়তের মধ্যে নাক গলাতে গেলে ফল ভাল হবে না: সোজাসুজি শাসানি দিয়েছে ল’ বোর্ড। মনে আছে তো, কী হয়েছিল আজ থেকে ঠিক তিরিশ বছর আগে?

সে দিন যদি

মনে আছে বইকী। এ বার সায়রা বানো, সে বার শাহ বানো। ১৯৮৫ সালে শাহ বানোর খোরপোশ সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্ট প্রদত্ত রায়ে দেওয়ানি বিধি ১২৫ অনুযায়ী খোরপোশ পাওয়ার অধিকার বিবাহবিচ্ছিন্ন মুসলিম মহিলাকেও দেওয়া হল। অর্থাৎ ওই রায়ে মুসলিম পার্সোনাল ল’-এর বিরুদ্ধতা করা হল, যাতে বলা আছে, ইদ্দত পর্বের পর স্বামীর কোনও দায়িত্ব থাকবে না। রায় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পার্সোনাল ল বোর্ড ও অন্যান্য রক্ষণশীল মুসলিমদের হুঙ্কার। রাজীব গাঁধী প্রধানমন্ত্রী তখন, নির্বাচন ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে, জাতীয় অভ্যাস বলছে যে, মুসলিম লবি-কে চটানো যাবে না, পার্সোনাল ল’ পাল্টানো হবে না। যথাসাধ্য তড়িঘড়ি আইন পাশ হল: মুসলিম উইমেন’স (প্রোটেকশন অব রাইটস অন ডিভোর্স) অ্যাক্ট, ১৯৮৬, সেকশন ৩(১)(এ)। এক ধাক্কায় মুসলিমদের আলাদা আইনের স্বীকৃতি নতুন মান্যতা পেল। এ দেশে মুসলিম নারী তথা নারীর অধিকার আন্দোলনকে কতটা পিছিয়ে দিল এই আইন, তা নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে বহু দিন ধরে।

দু-একটা কথা তবু মনে করার দরকার আছে। এক, সুপ্রিম কোর্টের শাহ বানো রায়ের পর রাজীব গাঁধী কিন্তু প্রথমে সেটিকে বেশ জোরালো সমর্থন জানিয়েছিলেন। তাঁর দলের মুসলিম নেতা আরিফ মহম্মদ খানকে দিয়ে রায়ের সপক্ষে, শাহ বানো তথা বিবাহবিচ্ছিন্ন মুসলিম নারীর অধিকারের পক্ষে অসাধারণ বক্তৃতার ব্যবস্থাও করেছিলেন। ক’দিনের মধ্যেই এল ‘পাল্টি’। জিয়া-উর-রহমান আনসারি নামে আর এক কংগ্রেসি মুসলিম নেতাকে দিয়ে রায়টিকে আক্রমণ করিয়ে, পার্সোনাল ল’-এর তুমুল সমর্থনে সংসদে আর একটি বক্তৃতা দেওয়ালেন রাজীব। রাজনীতির হিসেব কষে রক্ষণশীলতা তোষণের এত নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত আমাদের দেশের ইতিহাসেও দুর্লভ। মুসলিম আইনের সংস্কার যে ভয়ানক রকমের কঠিন কাজ, সে তো কেবল মুসলিম রক্ষণশীলতার চাপে নয়, ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলির এই অত্যধিক ‘ভেড়াপ্রবণতা’র কারণেও বটে।

দুই, এক দিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকার, অন্য দিকে নারীর অধিকার, এই জাঁতাকলের মধ্যে পড়ে কেবল রাজনৈতিক দল নয়, নারী আন্দোলনের দিকপালরাও তাঁদের নিজেদের যুদ্ধটা ছেড়ে দিলেন। তাঁরা ভাবলেন, মুসলিমদের বেশি চটানো ঠিক নয়। মুসলিম বলতে যে মুসলিম নারীদেরও বোঝানো যেতে পারে, তাঁদের স্বার্থটাও কারও কারও বিবেচনার দরকার হতে পারে, এই সামান্য কথাটা বলার মতো কেউ রইল না। মুসলিম সমাজের ভেতর থেকেও একটা প্রতিবাদী আন্দোলন তৈরি করা সম্ভব ছিল, কেউ সে চেষ্টা করল না। যে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট এ দেশে চালু আছে, ইসলামি আইন মতে বিবাহের পাশাপাশি সেই আইনের দ্বারস্থ হলেও তালাক ও খোরপোশের যুদ্ধটা অনেকখানি পাল্টে যেতে পারে— এই মর্মে কোনও প্রচার হল না। বরং ফ্লেভিয়া অ্যাগনেসের মতো নারীবাদী আইনজ্ঞরা বললেন, আহা, ১৯৮৬ সালের আইনটা খারাপ কীসে, ইদ্দত পর্বেই না হয় বেশি করে এককালীন খোরপোশ দিয়ে দাও, সমস্যা মিটে যায়! ব্যাপারটা যে কেবল আর্থিক খোরপোশের পরিমাণ দিয়ে সমস্যা মেটানো নয়, একটা অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন— এই কথাটা যদি নারীবাদীরাই না বলেন, তবে আশা কোথায়! শাহ বানো ইতিবৃত্ত কেবল অভিন্ন দেওয়ানি বিধি পথ থেকেই কয়েক পা পিছনে সরে আসা নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। প্রগতিশীল ভারতের একটা বিরাট পরাজয় ১৯৮৬ সালের এই পশ্চাদপসরণ।

সায়রা বানো সমাজতত্ত্বের ছাত্রী, সচেতন নাগরিক। স্পষ্ট বলে দিয়েছেন তিনি: শাহ বানো ঘটনায় মুসলিম মেয়েদের যুদ্ধটা আরও কঠিন হয়ে গিয়েছে। সে দিন সরকার পিছনপানে না হাঁটলে আজ তাঁর মতো মেয়েদের এই অবস্থা হত না। মজা হল, সে দিন কংগ্রেস সরকার যা করেছিল, বিজেপি ত্রিশ বছর ধরে গলা ফাটিয়ে তার বিরুদ্ধে মুসলিম-তোষণের অভিযোগ করে এসেছে। কিন্তু আজ যে সায়রা বানোর মামলা চলছে, বিজেপি সরকার যে সাহস করে তা নিয়ে একটা অন্য রকম সিদ্ধান্তের দিকে এগোবে, সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। অনেক ক্ষেত্রের মতো এই ক্ষেত্রেও যে কংগ্রেস এবং বিজেপির ‘সরকার’-এর মধ্যে তফাত নেই, তা হয়তো এ বার প্রমাণিত হতে চলেছে। বিজেপির হিন্দুত্ববাদী হইচই সত্ত্বেও, গণতান্ত্রিক দেশে এমন একটা সংবেদনশীল বিষয়ে এত বড় সংস্কারের ছক্কা হাঁকানো সহজ নয়, বিশেষত যেখানে একটা বিরাট সংখ্যালঘু সমাজ নিজের রক্ষণশীল প্রবক্তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলে সহজে কিছু বলে না, আন্দোলন তো দূরস্থান! নীরবতা দেখে মনে হয়, এআইএমপিএলবি-ই যেন ভারতীয় মুসলিমদের একমাত্র প্রতিনিধি, তার বয়ানটিই যেন দেশের সব মুসলিমের বক্তব্য। ইতিমধ্যেই সরকারের উপর যত চাপ তৈরি হয়েছে মুসলিম সমাজের এই স্বঘোষিত অভিভাবকদের দিক থেকে, তাতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির আগুনখেকো সমর্থক বিজেপিও শেষ অবধি পিছু হটবে বলেই মনে হচ্ছে।

আশা একটাই

একমাত্র একটি দিক থেকে কিছু আলোর ইশারা আসতেও পারে। সেটা সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে বহু বার বলা হয়েছে, আইনের ভিত্তি নিয়ে আলোচনা দরকার, কেননা যে কোনও পার্সোনাল ল’র সঙ্গে সংবিধানের নীতি ও ভারতীয় আইনবিধির বিরোধিতা আছে। ব্যক্তির অধিকার সংবিধানে অলঙ্ঘ্য অধিকার। তাই, সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষা যেমন দরকার, সেই অধিকার যাতে ব্যক্তি-অধিকারকে দলিত-পিষ্ট না করে, সেটাও দেখতে হবে। যে কোনও ধর্মের পার্সোনাল ল’-এর ক্ষেত্রেই একই কথা প্রযোজ্য। আর যত দিন আইন না পাল্টায়, আইনের পরিসরের মধ্যে থেকেই মুসলিম নারীর অধিকার-সীমা বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট বর্তমান আইনের সীমার মধ্যে থেকেই বার বার নারীর অধিকারভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র আবেগপূর্ণ যুক্তির অবতারণা করেছে বিভিন্ন মুসলিম নারী-সংক্রান্ত মামলায়, ১৯৯৭, ২০০১, ২০১৫ সালে। বিবাহ বা বিবাহ-বিচ্ছেদে যেহেতু নারী অর্থাৎ ব্যক্তি বিপন্ন হয়, কোনও অজুহাতেই দেশে তা চলতে পারে না। দরকার হলে পার্সোনাল ল’ চালু রেখেও তার ক্ষেত্র সীমিত করতে হতে পারে, সে কথাও বলা হয়েছে। একই বক্তব্য হয়তো আবার শোনা যাবে ২০১৬-তেও।

ভারতের মতো বহু-আইডেন্টিটি অধ্যুষিত দেশে, প্রবল সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও সম্প্রদায়-বোধের পটভূমিকায় অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করা মুখের কথা নয়। স্বাধীনতার পর সংবিধান-রচয়িতারা যে তা করতে পারেননি, সেটা কেবল তাঁদের অতি-রক্ষণশীলতার জন্য নয়, বরং অন্যান্য ছোট সমাজ-গোষ্ঠী-সম্প্রদায়গুলিকে যাতে সংখ্যাগুরুর চাপ থেকে রক্ষা করা যায়, সেই অতি-প্রগতিশীল ভাবনার জন্যই। নেহরু যখন বলেছিলেন, ‘আমাদের এ বিষয়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে যাতে সংখ্যালঘু কখনওই বিপন্ন না বোধ করে, তাদের উপর কিছু চাপিয়ে না দেওয়া হয়,’ কত বড় উদারতা তার মধ্যে ছিল, সেটা যেন আমরা ভুলে না বসি। ওই উদারতার মধ্যে একটা বিপজ্জনক বোঝাপড়া ছিল ঠিকই, কিন্তু একটা ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাও খোলা রাখা হয়েছিল। সংখ্যাগুরুর উদারতার অবকাশে নানাবিধ পরিবর্তন, সংশোধন, সংযোজন, সংস্কার ইত্যাদির পথটা রাখা হয়েছিল।

সুতরাং সংবিধানের উপর দোষ না চাপিয়ে ভাবা দরকার, পরবর্তী কালে আমরা কী করলাম। সামাজিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক সচেতনতা আমাদের একটুও এগিয়ে দিতে পারল কি না। দুই রকমের আইনবিধির সংঘাতের মীমাংসার চেয়েও যে মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজটা বেশি জরুরি, সেটা আমাদের আইনসভায় আলোচনা হল কি না। ধর্মের সুরক্ষার কথা ভাবার আগে ব্যক্তির সুরক্ষার কথা ভাবা দরকার, সামাজিক পরিসরে এটা কেউ জোর দিয়ে বলল কি না।

উত্তরটা হতাশাজনক।

সায়রা বানো আমাদের আবার সেই হতাশার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement