—ফাইল ছবি
অক্টোবর মাসে লখনউ-দিল্লির মধ্যে চালু হয়ে গিয়েছে তেজস এক্সপ্রেস, বেসরকারি সংস্থা আইআরসিটিসি-র মালিকানায়। রেল বোর্ডের চেয়ারম্যানের ঘোষণা, অদূর ভবিষ্যতে দেড়শোটি ট্রেন চলবে বেসরকারি মালিকানায়, চোদ্দোটি রুটে।
কিন্তু যাত্রী পরিবহণের ব্যবস্থায় বেসরকারি সংস্থা ঢোকার অনেক আগেই রেলের বহু কাজ বেসরকারি হাতে গিয়েছে। ভারতীয় রেলের অধীনে ষোলোটি সাবসিডিয়ারি ও পাবলিক সেক্টর আন্ডারটেকিং সংস্থা আছে, যেখানে কর্মীদের একটা বড় অংশ ঠিকাদারদের মাধ্যমে নিযুক্ত হয়। রেলের তথ্য অনুযায়ী ঠিকা শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় নব্বই হাজার। কেন্দ্রীয় অডিট সংস্থার (‘ক্যাগ’) রিপোর্ট বলছে, এঁদের তেইশ শতাংশ ন্যূনতম মজুরি পান।
পূর্ব রেলের সদর কয়লাঘাটায় নিযুক্ত সাফাই কর্মী মনিরুল (নাম পরিবর্তিত) এগারো বছর কাজ করছেন বিভিন্ন ঠিকাদারের অধীনে। বীরভূমের ভূমিহীন চাষির সন্তান। পান দু’শো টাকা রোজ। মাসে আট হাজার টাকার দাবিতে আন্দোলন করছেন। ‘এ-ওয়ান’ শহরে ন্যূনতম মজুরি হওয়ার কথা দৈনিক ৫৫৩ টাকা। মজুর দাবি করলে ঠিকাদার বলে, এমন কোনও সরকারি নির্দেশ নেই। গত বছর ঠিকা শ্রমিকদের ইউনিয়ন তৈরি করেছেন তাঁরা। ঠিকাদার চোখ রাঙায়, চুক্তি শেষ হলে আর নেওয়া হবে না কাজে। ভারতীয় রেল এঁদের ব্যবহার করছে মানুষের মল বহন করতে। দিল্লি হাইকোর্টে এই নিয়ে ‘সাফাই কর্মচারী আন্দোলন’ মামলা করেছিল। রেল কর্তৃপক্ষ ‘ওটা ঠিকাদাররা করে’ বলে হাত ধুয়ে ফেলেছে। বায়ো-টয়লেট এলেও অবস্থা বদলায়নি। ‘ক্যাগ’ রিপোর্ট বলছে, সেপটিক ট্যাঙ্কের মতো, বায়ো-টয়লেট সাফ করতেও মানব-হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
২০১৭ সালে সরকারি অডিটের প্রস্তাব ছিল, শ্রমিক কল্যাণের বিধি মানছে না যে সব ঠিকাদার, তাদের রেল কর্তৃপক্ষ যেন টাকা না দেয়। সে কথা কে শোনে? মনিরুলদের নিয়োগকারী সংস্থাটি মুম্বইয়ে লাইসেন্সপ্রাপ্ত এক কোম্পানির সাব-কনট্রাক্টর। বোনাস, প্রভিডেন্ট ফান্ড, ইএসআই প্রভৃতি দাবি মানলেও, আইনি মজুরি দেওয়ার ধারকাছ দিয়ে যায় না। অধিকাংশ চুক্তি হয় ৮৯ দিনের, কারণ তার বেশি মেয়াদের চুক্তি করলে শ্রমিকের অধিকার বাড়ে। মহিলাদের মাতৃত্বকালীন ছুটি মঙ্গলগ্রহের বিষয়।
প্রায় সত্তর হাজার শ্রমিক কেন ন্যায্য মজুরি আদায় করতে ব্যর্থ? হাওড়ার পূর্ব ডিভিশনের কর্মীরা বলছিলেন, প্রায় সব কাজ, এমনকি একই কাজের ক্ষেত্রেও আলাদা ঠিকাদার রাখা হয়। যাত্রীদের খাবার সরবরাহ করতে বিভিন্ন ট্রেনে বিভিন্ন ঠিকাদার। ফলে ঠিকাদারি শাসনের বজ্র-আঁটুনিতে থাকা শ্রমিকদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা এতই বেশি যে, সংগঠিত ভাবে দাবি আদায় কঠিন। অসুস্থতার কারণে সবেতন ছুটি, কাজের নির্দিষ্ট ঘণ্টা, বা কাজের ফাঁকে বিশ্রাম— শ্রম আইন অনুযায়ী যা যা প্রাপ্য, একটিও মেলে না।
যে ভাবে ঠিকাদার মজুরির হিসেব করে, তা-ও দেখার মতো। ধরা যাক, ঠিকাদারের অধীনে কিছু কর্মী চাদর-কম্বল সরবরাহ করছেন দূরপাল্লার ট্রেনে। হাওড়া থেকে গন্তব্যে পৌঁছে আবার ফেরত আসা—চার দিনের ডিউটি। ঠিকাদার তখন তাঁদের দেবে চারশো টাকা দৈনিক। যদিও চব্বিশ ঘণ্টার হিসেবে পাওনা হওয়া উচিত বারশো টাকা, যে হেতু দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের চুক্তিতেই ঠিকাদার শ্রমিকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ, এবং ট্রেনে থাকাকালীন তাঁরা চব্বিশ ঘণ্টাই ডিউটিরত। এই বিপুল শ্রমচুরি একমাত্র পুকুরচুরির সঙ্গেই তুলনীয়।
তথ্য বলছে, ঠিকা শ্রমিকদের অনুপাত বাড়ছে। ২০০১-০২ সালে ঠিকা শ্রমিক ছিল পনেরো শতাংশ। ২০১৫-১৬ সালে তা দাঁড়ায় প্রায় আঠাশ শতাংশ। ঠিকা শ্রমিকের নিয়োগে বৃদ্ধি নীতিপ্রণেতাদের সমর্থন পেয়েছে— শিল্পকে লাভজনক করতে হলে সস্তা শ্রমের প্রয়োজন। অন্য প্রয়োজন, আইনকে পাশ কাটানো। জনকল্যাণকর, আধুনিক রাষ্ট্র হয়ে ওঠার শর্ত পূরণ করতে শ্রমিক-সুরক্ষায় যে সব আইন হয়েছিল, যেমন ফ্যাক্টরিজ় অ্যাক্ট (১৯৪৮), কনট্র্যাক্ট লেবার অ্যাক্ট (১৯৭০), মিনিমাম ওয়েজেস অ্যাক্ট (১৯৪৮), মাইনস অ্যাক্ট (১৯৫২), শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার অধিকার, সব অকেজো করে দিচ্ছে ঠিকাদারি। আজ ঠিকাদারের হাতে চাবুক হয়তো নেই— আধুনিকতা তাকে প্রশ্রয় দেয় না— কিন্তু লক্ষ শ্রমিকের অস্তিত্বের বিপন্নতা রয়েছে।
শ্রমের লাভের গুড় খেয়ে ঠিকাদাররা পুঁজিপতি হয়ে যাচ্ছে, তা নয়। কিন্তু তারা শ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা কমাচ্ছে। ন্যূনতম মজুরির ৩০ শতাংশেরও কম পেলে বাঁচাই দায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা কমছে কেন, তার একটা উত্তর হয়তো এখানেও।
ট্রেনের সাফাই কর্মী, কম্বল বিলি-করা, খাবার সরবরাহ করা কর্মীরা যখন বকশিশ চান, যাত্রী বিরক্ত হন। রেলের কর্মী টাকা চায় কেন? মনিরুলের মতো ঠিকাকর্মীদের রেল হাসপাতালে চিকিৎসা জোটে না। তাঁরা ট্রেন ধরে বাড়ি ফেরেন, বিনা টিকিটে। পাস নেই। চেকার ধরলে কর্মীর অস্থায়ী পরিচয়পত্র দেখিয়ে ছাড় পাবেন, এই আশাই তাঁদের সম্বল।