প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারতীয় সেনার টহলদারি— ফাইল চিত্র।
চিনের নীতি নির্ধারকেরা চান ‘মধ্যবর্তী সাম্রাজ্যের’ সেই পুরনো হিসেবের পথেই এগোতে (প্রাচীনকাল থেকেই চিনারা তাঁদের দেশকে ‘মধ্যবর্তী সাম্রাজ্য’ ডাকেন)। তাঁদের পাঁচটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে— আর্থিক বৃদ্ধি ও উন্নয়ন, ভরসা অর্জন, প্রতিকূলতার মোকাবিলা, সম্পদের বহুমুখী ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাইওয়ানকে কোণঠাসা করা। সুপারপাওয়ার হয়ে ওঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষাও চিনের রয়েছে। তারা মনে করে, আমেরিকা-সহ পশ্চিমী দুনিয়া এবং ভারত ও জাপানের মতো তাদের মিত্ররাষ্ট্রগুলি সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের পথে অন্তরায়। বিষয়টি তার না-পসন্দ। তাইওয়ানকে কব্জা করে নিজের বন্দরগুলি সুরক্ষিত করা, অধিকৃত তিব্বত ও শিনজিয়াংয়ের পাশাপাশি মঙ্গোলিয়ার মতো পড়শি দেশকে নিয়ে গড়া ‘বাফার জোন’-এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি চিনের স্বার্থের অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণ। যা তার বাণিজ্য ও কৌশলগত শক্তির উৎস। সেখানকার খনিজ সম্পদ নিয়ন্ত্রণও তার লক্ষ্য। সেই সঙ্গে রয়েছে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টিও।
করোনা অতিমারির উৎস চিনের উহান শহরে। এর ভয়াবহ প্রভাব সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এবং সে কারণে চিন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমালোচনা কুড়িয়েছে। তবে ইতিমধ্যেই অতিমারির ধাক্কা চিন সামলে উঠেছে। এখন তার লক্ষ্য, আগ্রাসী বিদেশনীতির মাধ্যমে নিজের দাবি প্রতিষ্ঠিত করা এবং যারা বিরোধিতা করছে তাদের সাজা দেওয়া।
ভারতের উত্তর এবং পূর্বে চিন অধিকৃত তিব্বতের সঙ্গে প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। সীমান্তবর্তী বড় অংশ চিন অবৈধ ভাবে দখল করেছে কিংবা দাবি করছে। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে চিন লাদাখ লাগোয়া আকসাই চিন দখল করেছিল। ওই অঞ্চলের আয়তন প্রায় ৩৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার। ১৯৬৩ সালের ২ মার্চ একটি বেআইনি চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান ৫ হাজার ১৮০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা চিনকে দিয়ে দেয়। এর পরেও চিনের দাবি পূর্ব লাদাখের বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
জওহরলাল নেহরু এবং চৌ এন লাই— ফাইল চিত্র।
লাদাখ বিতর্কের সূচনা ১৯৪৯ সালে। চিনা ফৌজ শিনজিয়াং এবং তিব্বত দখল করার পরে। ১৯৫৯ সালে চিনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই জওহরলাল নেহরুকে চিঠি লিখে আকসাই চিনের অধিকার দাবি করেছিলেন। তত দিনে তারা ওই এলাকার দখল নিতে শুরু করেছে। ১৯৬২ সালে চিন আরও অগ্রসর হয়। প্যাংগং লেকের একটি বড় অংশ, গালওয়ান নদী উপত্যকার একাংশ, দেপসাং সমভূমির আশপাশের এলাকা, চুমার, হট স্প্রিং, ডেমচক, দৌলত বেগ ওল্ডি-সহ বেশ কিছু এলাকাকে নিজেদের বলে দাবি করে। এই দাবি করা এলাকার সীমানাগুলি জুড়েই লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি)। সেখানে এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১,৫৯৭ কিলোমিটার। চিন এখন দাবি করছে পুরো লাদাখটাই তার। এমন দাবি পুরোপুরি অযৌক্তিক। কারণ, তার কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই।
লাদাখের পাশাপাশি চিন নেপালকে উসকে লিপুলেখ পাস লাগোয়া ট্রাইজংশন নিয়ে বিতর্ক তৈরি করছে। ভুটান-তিব্বত-সিকিম, ভুটান-তিব্বত-অরুণাচল এবং মায়ানমার-তিব্বত-অরুণাচল ট্রাইজংশন নিয়ে বিতর্কের কারণও চিন। উত্তরাখণ্ড-তিব্বত সীমান্তের বারাহোতি, উত্তর সিকিমের ফিঙ্গার এরিয়া, ডোকলাম উপত্যকা-সহ পশ্চিম, মধ্য ও পূর্ব ভুটানের বিভিন্ন অঞ্চল এবং পুরো অরুণাচল প্রদেশ রয়েছে চিনের দাবির তালিকায়। চিন কখনও ম্যাকমাহন লাইনের অস্তিত্ব স্বীকার করেনি। নির্বাসিত তিব্বতি সরকারও চিনের এই অবস্থানের বিরোধিতা করেছে। তাদের দাবি, তিব্বতের উপর আনুষ্ঠানিক ভাবে চিনের শাসন বা অধিকার কোনও দিনই ছিল না। ১৯১৩ সালে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে তাদের সঙ্গে ভারতের ব্রিটিশ শাসকদের আলোচনা শুরু হয়েছিল। যার পরিণতিতে ২০১৪ সালে সীমানা নির্ধারণের জন্য সই হয় শিমলা চুক্তি। ভারত ও তিব্বতের সীমানা নির্ধারক হিসেবে ম্যাকমাহন লাইনকে মেনে নেয় দু’পক্ষই।
ম্যাকমোহন লাইনের ভারতীয় ব্যাখ্যা নস্যাৎ করে চিনের পাল্টা দাবি, এটি কেবলমাত্র বৃহৎ প্রেক্ষাপটের মানচিত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাদের মতে, দুই বাহিনীর শারীরিক উপস্থিতির উপর নির্ভর করে এলএসি-র অবস্থান সংক্রান্ত খুঁটিনাটি স্থির করা উচিত। ১৯৫৯ সালে নেহরুকে লেখা চৌ এন লাইয়ের একটি চিঠিতেও এমন ব্যাখ্যাই দেওয়া হয়েছে। ১৯৬২ সালে কলম্বো প্রোটোকলে ফের এলএসি সংক্রান্ত বিষয়টির উল্লেখ করা হয়েছিল। সেখানে বলা হয়, সুনির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমা চিহ্নিত করে, বিতর্ক কমিয়ে দু’দেশের সমঝোতায় আসার বিষয়টিকেই প্রাথমিক গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। সেখানে পূর্ব সীমান্তে বিবাদের ক্ষেত্রগুলিকে চিহ্নিত হয়েছে এমন ভাবে—
লিপুলেখ পাস— ছবি বিআরও টুইটার থেকে।
১. তিব্বত-সিকিম-ভুটান সীমান্তের ট্রাইজংশনের অবস্থান। এখানে চিনের দাবি, ভারত নির্ধারিত সীমান্তের আরও দক্ষিণে। সাম্প্রতিক কালে ডোকলাম মালভূমির ঘটনা এবং পশ্চিম ভুটানের সারিথাংয়ে চিনা দখলদারির ঘটনা এমন দাবির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
২. তিব্বত-ভুটান-অরুণাচল প্রদেশ সীমান্তের ট্রাইজংশনের অবস্থান। এখানেও চিনা দাবি ‘দক্ষিণ-মুখী’। থাগ লা গিরিশিরা, খিনঝেমানে, তাওয়াং, বমডিলা-সহ বেশ কিছু এলাকা এমনকি পূর্ব ভুটানের সাকেতং এলাকাকেও চিন তার ভূখণ্ড বলে দাবি করে।
৩. মধ্য ভুটানের বেশ কিছু এলাকারও দাবিদার চিন। ভুটানের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তির কারণে এখানেও কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে ভারতের।
৪. অরুণাচলের সুবনসিরি সেক্টরের অন্তর্গত লংজুর উপরেও দাবি রয়েছে চিনের।
গালওয়ান উপত্য়কায় ভারতীয় বাহিনী— ছবি: এএফপি
৫. দিবাং সেক্টরের ‘ফিশ টেল’ ভারতীয় ভূখণ্ড হিসেবে সে মানতে চায় না।
৬. তিব্বত-অরুণাচল-মায়ানমার ট্রাই জংশনের লোহিত সেক্টর দাবি করার পরে আরও অনেকটা দক্ষিণের ওয়ালংকেও নিজেদের এলাকা বলে চিহ্নিত করেছে চিন।
এর পাশাপাশি, জমিতে নেমে এলএসি চিহ্নিত করতে গেলে নীচের ক্ষেত্রগুলি নিয়েও দু’দেশের বিরোধ দেখা দেবে বলে আমি নিঃসন্দেহ—
উত্তরাখণ্ডের বারহোতির পাশাপাশি তিব্বত-হিমাচল প্রদেশ সীমান্তের কিছু এলাকা। যেখানে চিনা অধিকারের বার্তা রয়েছে।
অতীতে তিব্বতে দখলদারি কায়েম করার পরে যে অঞ্চলগুলিতে নির্দিষ্ট দাবি জানিয়েছিল চিন—
ক. তাওয়াং এলাকা। এর মধ্যে রয়েছে অরুণাচল প্রদেশের তাওয়াং এবং পশ্চিম কামেং জেলা। সপ্তদশ শতকে ষষ্ঠ দলাই লামা জন্মেছিলেন এই অঞ্চলে। চিনেক দাবি এটি আদতে তিব্বতের টোসনা জেলার জংপেনের অঞ্চলের অংশ। যদিও দলাই লামা এবং নির্বাসিত তিব্বতি সরকারের মতে ম্যাকমাহন লাইনের দক্ষিণের এই অঞ্চল ‘ভারতীয় ভূখণ্ড’।
খ. সুবনসিরি উপত্যকার আসাফিলা এবং সুবনসিরি ও তার উপনদী সারি চুর অববাহিকায় পোটরং রিজের (অন্য নাম, ক্রিস্টাল মাউন্টেন) উপরেও চিনের দাবিদাওয়া রয়েছে। যদিও এটি প্রাচীনকালের তীর্থপথ। অদূরের লংজু এবং বিসা কানে ব্রিজ আশির দশকে অবৈধ ভাবে চিন কব্জা করেছে।
ডোকলামে ভারত ও চিনা সেনা— ফাইল চিত্র।
গ. ‘ফিশ টেল’-এর কৈলা পাস এবং আশপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকেও ‘চিনের এলাকা’ বলে চিহ্নিত করে সে দেশের সরকার। অবশ্য, প্রাথমিক পর্যায়ে ভারতের তরফে ‘মানচিত্রগত ত্রুটি’ (কার্টোগ্রাফিক এরর) এর অন্যতম কারণ।
ঘ. লোহিত সেক্টরের জলবিভাজিকা (যে উঁচু ভূখণ্ড দুই বা তার বেশি নদীর গতিপথকে পৃথক করে) ডিচু পাসকেও নিজেদের এলাকা বলে চিন মনে করে।
আরও পড়ুন: এখন বিজেপির কাছ থেকেও আমরা গণতন্ত্র শিখব?
তবে দাবিদাওয়ার এই দীর্ঘ তালিকা সত্ত্বেও চিন ১৯৫৯ সালে এমনকি আশির দশকের শেষেও অরুণাচল সীমান্তের বিবাদ সমাধানের লক্ষ্যে একটি প্রস্তাব দিয়েছিল। পশ্চিম সেক্টরে তার দখলে থাকা আকসাই চিনের সঙ্গে অরুণাচলের ওই অংশগুলি বদলাবদলি করতে চেয়েছিল সে দেশের সরকার। কিন্তু নয়াদিল্লি সেই প্রস্তাব মানতে রাজি হয়নি। এর পরে দু’দেশের প্রতিনিধিদের ধারাবাহিক বৈঠক হলেও সীমান্ত সমস্যা সমাধানের কোনও সূত্র মেলেনি। তবে দু’দেশের শীর্ষনেতৃত্বের আলোচনার প্রেক্ষিতে সীমান্তে শান্তি ও সুস্থিতি বজায় রাখার জন্য ১৯৯৩ এবং ২০০৫ সালে দু’টি চুক্তি সই হয়। বস্তুত, ২০০৩-’০৪ সালে পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হয়েছিল। সে সময় মনে হয়েছিল সীমান্ত বিতর্কের সমাধান হতে পারে। ২০০৫ সালে মনমোহন সিংহ-ওয়েন জিয়াবাও বৈঠক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। সেখানে জনবসতি স্থানান্তর না করেই সীমান্ত বিতর্কের সমাধানের বিষয়ে ঐকমত্য হয়।
লাদাখ, সিকিম, ভুটান এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চিনের দাবি এবং দখলদারি প্রসঙ্গে এই নিবন্ধের প্রথম অংশ এখানেই শেষ। দ্বিতীয় অংশে গালওয়ান উপত্যকা ঘিরে ভারত-চিন সম্পর্কের অবনতির কথা আলোচনা করব।
আরও পড়ুন: অক্সফোর্ডের করোনা টিকা অক্টোবরেই? সেই চেষ্টাই চলছে, বলছেন বিজ্ঞানীরা