প্রতীকী ছবি।
ছয়টি ব্লক, মোট ১৩২টি গ্রাম। উত্তরাখণ্ডের এই গ্রামগুলিতে গত তিন মাসে মোট ২১৬টি শিশু ভূমিষ্ঠ হইয়াছে। তাহার মধ্যে কন্যাসন্তানের সংখ্যা শূন্য। প্রকৃতি এ হেন বৈষম্য করিতে অপারগ— এই কৃতিত্ব একান্তই মানুষের, তাহাতে কার্যত সন্দেহ নাই। লিঙ্গ-অনুপাতে দেশের রাজ্যগুলির মধ্যে উত্তরাখণ্ড মাঝারি গোত্রের। সেই রাজ্যের ছয়টি ব্লকে এমন অকল্পনীয় ঘটনা ইঙ্গিত করিতেছে, গত এক-দেড় বৎসরে স্থানীয় স্তরে নূতন কোনও ‘পরিষেবা’র ব্যবস্থা হইয়াছে। সম্ভবত নূতন আলট্রাসোনোগ্রাফি যন্ত্র বসিয়াছে, বা গর্ভপাতের কোনও সুলভ ব্যবস্থা হইয়াছে। এবং, তাহার এমনই বহুল ব্যবহার হইয়াছে যে তিন মাসের মধ্যে একটিও কন্যাসন্তান জন্মায় নাই। ইহাই বলিয়া দেয়, রাষ্ট্র যখন ‘বেটি বচাও, বেটি পঢ়াও’-এর বুলি কপচাইতেছে, সমাজের অভ্যন্তরে পচন কতখানি গভীরে। এক বিস্তীর্ণ জনপদের মানুষ কন্যাভ্রূণ হত্যার কোনও নূতনতর পন্থা পাওয়ামাত্র তাহার পূর্ণ ব্যবহার করিতেছেন। এ-ক্ষণে উল্লেখ্য, উত্তরাখণ্ডের এই ছয়টি ব্লক রীতিমতো দুর্গম অঞ্চলে। কন্যাভ্রূণ হত্যার প্রবণতা শহরের গণ্ডি ছাড়াইয়া গ্রামে পৌঁছাইয়াছে বেশ কিছু দিন। এখন তাহা দুর্গমতর অঞ্চলেও পাড়ি দিতে প্রস্তুত। ‘পরিষেবা’ পৌঁছাইবার অপেক্ষামাত্র— এক বার তাহা আওতার মধ্যে আসিলে আর কোনও বাধাই কন্যাভ্রূণ হত্যা ঠেকাইতে পারে না। বস্তুত, বাধা কি আর আছে কিছু? কুযুক্তি আসিয়া নৈতিকতাকে লইয়া গিয়াছে। প্রযুক্তি হত্যাকে নিতান্ত সহজ করিয়াছে— আঁতুড়ে সদ্যোজাতকে খুন করিবার প্রত্যক্ষতা নৈর্ব্যক্তিক গর্ভপাতে নাই। সমাজও এই হত্যাকে কার্যত বৈধতার স্বীকৃতি দিয়াছে। কাজটি ক্রমে বহুজনীন হইয়াছে বলিয়াই তাহা বৈধ হইয়া উঠিয়াছে, না কি বৈধতাই তাহাকে বহুজনীন হইতে সাহায্য করিয়াছে, সেই তর্কে ঢুকিবার প্রয়োজন নাই। মোট কথা, কেহ কন্যাভ্রূণ হত্যা করিলে সমাজ ভ্রুকুটি করে না। বরং, এক অর্থে তাহাকেই স্বাভাবিক বলিয়া মানিয়া লয়।
‘বেটি’ বাঁচাইতে হইলে, অতএব, ঢাক পিটাইবার অপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। প্রথমত, ভ্রূণহত্যার প্রকরণগুলিকে আটকাইতে হইবে। ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ণয় হইলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক, প্রযুক্তিকর্মী এবং গর্ভবতীর পরিবার, প্রত্যেকের কঠোর শাস্তি হওয়া বিধেয়। চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশন কাড়িয়া লওয়া, স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্রের লাইসেন্স বাতিলের ন্যায় কড়া শাস্তির ব্যবস্থা থাকিলে তাহাদের মনে ভীতির সঞ্চার হওয়া স্বাভাবিক। কেহ বলিতে পারেন, এই কড়াকড়ি হইলে লিঙ্গ নির্ণয় ও গর্ভপাতের প্রক্রিয়াটি আরও বেশি গোপনে চলিবে, ফলত তাহা আরও বিপজ্জনক হইয়া উঠিবে। যুক্তিটি একেবারে ভিত্তিহীন নহে। কিন্তু, সেই গোপন, কালো বাজারের লেনদেন থামানোও প্রশাসনেরই কর্তব্য। অবশ্য, শুধু শাস্তির ভয়ই যথেষ্ট নহে। কন্যাসন্তান যে কোনও অর্থেই অবাঞ্ছিত নহে, এই প্রাথমিক সত্যটুকু মানুষের মনে গাঁথিয়া দেওয়ার জন্য যত রকম সম্ভব, প্রচার চালাইতে হইবে। কন্যাসন্তানের ক্ষেত্রে এখনই বিবিধ প্রণোদনার ব্যবস্থা আছে। পশ্চিমবঙ্গের কন্যাশ্রী, ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী লাডলি যোজনার ন্যায় প্রকল্পগুলি যেমন। কেন্দ্রীয় স্তরেও প্রকল্প রহিয়াছে। যদি দেখা যায়, ইহাতেও যথেষ্ট হইতেছে না, প্রণোদনার পরিমাণ বৃদ্ধি করা বিধেয়। কিন্তু, কন্যাসন্তানদের বাঁচাইতে হইবে। ইহা রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্ব।