চলতি বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে (এপ্রিল-জুন) ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার ৫.৭ শতাংশে নেমেছে। তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। এই সংবাদ শুনে নিশ্চয়ই আহ্লাদিত হওয়ার কারণ নেই। আপাতত পরের রাউন্ডের চমকপ্রদ বক্তৃতার জন্য অপেক্ষা। তবে যেটা উদ্বেগজনক, তা হল রিজার্ভ ব্যাংকের ঘোষণাটি: ৫০০ এবং ১,০০০ টাকার নোটে বাতিল হওয়া ১৫.৪৪ লক্ষ কোটি টাকার ৯৯ শতাংশই জমা পড়েছে ব্যাংকের খাতায়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী এখন দুনিয়ার যে প্রান্তেই থাকুন, তাঁর মতামতটি শুনতে চাওয়া ভারতবাসীর অধিকার। নোট বাতিল করলে অর্থনীতির কী কী উপকার হবে, আমরা তাঁর মুখে শুনেছিলাম। এখন যেখানে দাঁড়িয়েছি, সে সম্বন্ধেও তাঁর মতামতটি জানা প্রয়োজন।
ইতিহাসে নিজের নামটিকে অমর করতে এক জন মানুষ কত দূর যেতে পারেন, নোট বাতিলের কুনাট্যে নরেন্দ্র মোদী তার মোক্ষম নমুনা পেশ করলেন। তবে, সম্মিলিত ভাবে প্রশাসনও কতখানি ব্যর্থ হতে পারে, এটা তার উদাহরণও বটে।
নগদ নিয়ে হয়রান হওয়া মানুষের যাবতীয় রাগ গিয়ে পড়েছিল বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর। তাদের হয়েছিল জ্বালা— সেই প্রবল ভিড় সামলানোর পাশাপাশি সম্পূর্ণ অপরিচিত সব নিয়ম মেনে কাজ করতে হচ্ছিল। দেশের ব্যাংকিং সচিব অবশ্য মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন। যা কিছু বলার, বলছিলেন রাজস্ব সচিব— গুজরাত থেকে বেছে আনা প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের আমলা। দুই সচিবের মধ্যে কেউই কি জানতেন না, রাতারাতি কী ভাবে এক দল নতুন নগদ টাকার দালাল তৈরি হয়ে গিয়েছে? না জানলে, দুর্ভাগ্যজনক। আর জানার পরেও যদি নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর নোট-বাতিলের যোদ্ধারা সেই দালালদের ঠেকাতে চেষ্টা না করে থাকেন, তবে সেটা আরও মারাত্মক।
জাতীয় স্তরে একটা বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে খানিক গোপনীয়তার প্রয়োজন হতেই পারে। কিন্তু, কাউকে কিচ্ছুটি না জানিয়ে, গোটাকয়েক বিশ্বস্ত লোকের ভরসায় নোট বাতিলের মতো সিদ্ধান্তে ঝাঁপিয়ে পড়লে তার পরিণাম এমনটাই হয়। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে জেতা হয়ে গিয়েছে— এখন কি নরেন্দ্র মোদীরা জানাবেন, সাধারণ মানুষকে এই বিপুল হেনস্তার সম্মুখীন না করে, এই নাটকীয়তা এড়িয়ে, মানুষকে নিজের হাতে থাকা টাকাকে ‘সাদা’ প্রমাণ করার মতো সুযোগ দেওয়া হল না কেন?
কেন্দ্রীয় সরকার নামক জিনিসটি গুটিকয়েক লোকের ভরসায়, গোপনীয়তার আড়াল রেখে রেখে চলতে পারে না। সব স্তরের মধ্যে সমন্বয় বজায় রাখা সুস্থ প্রশাসনিকতার প্রথম ধাপ। নোট বাতিলের ধাক্কায় ব্যাংক আর এটিএম-এর লাইনে কোটি কোটি মানব-দিবস নষ্ট হয়েছে, লাইনে দাঁড়িয়েই মারা গিয়েছেন শতাধিক মানুষ। এখনও কি সরকার জানাবে, কালো টাকার বিরুদ্ধে এই ঘোষিত জেহাদটি যাতে সফল হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ঠিক কার ওপর ছিল? নোট বাতিলের ঘোষণার পর কী ভাবে প্রায় প্রতি দিন নিয়ম বদলাচ্ছিল, মানুষের মনে আছে। বোঝা যাচ্ছিল, সরকার একেবারে অপ্রস্তুত অবস্থায় আছে। তার দায়িত্ব কার? মজার কথা হল, যে সব অসাধু ব্যাংক কর্মচারীরা কালো টাকা সাদা করায় সাহায্য করেছিলেন, এই প্রতি দিন বদলে যাওয়া নিয়মের কল্যাণে তাঁদের ধরা কার্যত অসম্ভব। অমুক দিন তমুক নিয়ম ছিল, তার পর বদলে অন্য নিয়ম হল— এই গোত্রের অজুহাত সাজিয়ে তাঁরা বিলক্ষণ পার পেতে পারেন।
নোট বাতিল-এর সিদ্ধান্তটিই হঠকারী ছিল। অর্থনীতির সমস্যা দূর করতে কী কী করা যায়, তার হরেক বিকল্প প্রধানমন্ত্রীর সামনে নিয়মিত পেশ করা হয়। অর্থনীতিবিদরা করেন, আমলারাও করেন। নোট বাতিল তেমনই একটি বিকল্প ছিল। কোন বিকল্পের ফলাফল কী হতে পারে, প্রস্তাব পেশ করার সময় তা নিয়ে কেউই খুব গভীরে ভাবেন না। সিদ্ধান্ত করার আগে যদি বিস্তারিত আলোচনা হত, অনুমান করা চলে, নিশ্চিত ভাবেই বিপরীত যুক্তিও শুনতে পেতেন প্রধানমন্ত্রী। নোট বাতিলের বিপদের কথা তাঁকে বুঝিয়ে বলতেন কোনও অভিজ্ঞ প্রশাসক। কিন্তু, বিরুদ্ধ মত শোনায় তাঁর অনীহা সর্বজনবিদিত। ফলে, ঘনিষ্ঠ পারিষদবর্গের সাগ্রহ সম্মতি ভিন্ন তাঁর কানে আর কিছুই পৌঁছয় না।
সরকারের নোট বাতিল আর রিজার্ভ ব্যাংকের বাজারে নতুন নোট ছাড়ার প্রক্রিয়া তাল মিলিয়ে চলেছে কি না, এবং বাজারে নগদ টাকার জোগান বে়ড়ে গেলে ব্যাংক স্বাভাবিক ভাবে যে পদ্ধতিতে তার মোকাবিলা করে, নোট বাতিলের পরেও সেই পদ্ধতিটি ঠিক মতো কাজ করেছে কি না, সেই হিসেব নেওয়া দরকার। ব্যাংকের হিসেব বলছে, ২০১৬ সালের ৩১ মার্চ বাজারে মোট নগদ ছিল ১৫.৯৭ লক্ষ কোটি টাকার। ৮ নভেম্বর রাতে নরেন্দ্র মোদীর ঘোষণার তিন দিনের মাথায় তা ৭০,০০০ কোটি টাকা কমে যায়। রিজার্ভ ব্যাংকের বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি অবধি বাজারে নগদের পরিমাণ কমে ৮.৯৯ লক্ষ কোটি টাকা। ফলে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলির হাতে বিপুল টাকা জমা হয়। এই টাকা তুলে নেওয়ার জন্য রিজার্ভ ব্যাংক বেশ কিছু ব্যবস্থা করে। ২৫ নভেম্বর রিভার্স রেপো রেট বাড়ানোর মাধ্যমে ৫.২৪ লক্ষ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়। তার পর ইনক্রিমেন্টার ক্যাশ রিজার্ভ রেশিয়ো বৃদ্ধি করে তুলে নেওয়া হয় আরও চার লক্ষ কোটি টাকা। তার পর ক্যাশ ম্যানেজমেন্ট বিল-এর মাধ্যমে জানুয়ারির ৪ তারিখ অবধি আরও ৭.৯৬ লক্ষ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়। এত নাটকের পর এখন আমাদের অর্থনীতি ফের সম্পূর্ণ ‘রিমনিটাইজড’ হয়েছে। মানে, আগে যত নগদ বাজারে ছিল, তার সবই বাজারে ফিরেছে। গত নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী যে বলেছিলেন, নগদ টাকা থাকলে তাতে শুধু কালো টাকার কারবারি আর সন্ত্রাসবাদীদের সুবিধে, সেই যুক্তিটার ঠিক কী হল? নোট বাতিলের পর্বে জনধন অ্যাকাউন্টগুলোর ভূমিকা ঠিক কী ছিল, সেটাও জানা দরকার।
কিন্তু, অর্থমন্ত্রী ফের গোলপোস্ট বদলে দিয়েছেন। জানিয়েছেন, টাকা বাজেয়াপ্ত করার জন্য নোট বাতিল হয়নি। ভারতীয় অর্থনীতির অতিরিক্ত নগদনির্ভরতা কমানোর জন্যই নোট বাতিল করা হয়েছিল। সে জন্য এই বিপুল তাণ্ডব প্রয়োজন ছিল, কেউ বিশ্বাস করবেন না। এবং প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর থেকে পরস্পরবিরোধী সব তথ্য আসছে, যাতে বোঝা যাচ্ছে, পারস্পরিক যোগাযোগ কতখানি কম ছিল। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, জমা পড়া ১.৭৫ লক্ষ কোটি টাকা সন্দেহজনক। আয়কর বিভাগ বলছে, না, সন্দেহজনক হল ২.৮৯ লক্ষ কোটি টাকা, ৯.৭২ লক্ষ লোক জমা করেছিলেন এই টাকা। খেয়াল করবেন, আগে যে শোনা গিয়েছিল, চার থেকে পাঁচ লক্ষ কোটি টাকা আর ফিরে আসবে না, ফলে রিজার্ভ ব্যাংককেও সেই টাকা মেটাতে হবে না, সেই হিসেব হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। নোট বাতিলের ফলে কোন কোন দুর্নীতিগ্রস্ত কালো টাকার কারবারি জেলে যান, গোটা দেশ তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে। এই যাত্রায় হবে, না কি তার জন্য ২০১৯ সালের নির্বাচন অবধি অপেক্ষা করতে হবে?