বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ একটি সাক্ষাৎকারে বলিয়াছিলেন: প্রধানমন্ত্রিত্ব সাময়িক ব্যাপার, কিন্তু এক বার প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিতে পারিলে একটি স্থায়ী পদ অর্জন করা যায়— ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রীর পদ। প্রাক্তনী পরিচিতিটি সত্যই বিচিত্র। এক দিকে তাহা অতীতের সূচক, যে অতীতের অন্য নাম ভূত, যাহা বিগত, মৃত। অন্য দিকে তাহা শাশ্বত, কারণ যিনি এক বার প্রাক্তন, তিনি চিরকাল প্রাক্তন, এমনকি ধরাধাম হইতে বিদায়ের পরেও। কলিকাতার সাউথ পয়েন্ট স্কুলের প্রাক্তনীদের একটি অংশ এই ধ্রুবসত্যটির ফাঁদে পড়িয়াছেন এবং কিঞ্চিৎ বেসামাল হইয়া সেই সত্যকে অস্বীকার করিতে চাহিতেছেন। তাঁহাদের বিড়ম্বনার কারণ স্কুলের প্রাক্তনীদের অপর একটি অংশ। এই দ্বিতীয় অংশের শরিকরা সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) প্রতিবাদে গত শনিবার একটি মিছিলে যোগ দিয়াছিলেন, সাউথ পয়েন্ট স্কুলের প্রাক্তনী হিসাবে নিজেদের পরিচয়ের নিশানও বহন করিয়াছিলেন। ইহাতেই প্রথম অংশটির উষ্মা উৎপন্ন হইয়াছে। তাঁহারা প্রবল আপত্তি জানাইয়া বলিয়াছেন, তাঁহাদের প্রাক্তনী সংগঠনের সহিত এই প্রতিবাদীদের কোনও সম্পর্ক নাই, এবং প্রতিবাদীরা নিজেদের প্রাক্তনী পরিচয় জাহির করিয়া ওই সংগঠনকে তথা সমস্ত প্রাক্তনীকে তথা স্কুলটিকেই এই রাজনৈতিক বিতণ্ডায় জড়াইয়া দিয়াছেন, ইহা ঘোর অন্যায়। অতঃপর গোল বাধিয়াছে। এবং যুগের নিয়মে, সেই গোল সমাজমাধ্যমে তুমুল সওয়াল-জবাবের রূপ লইয়াছে।
এই বিবাদ এক অর্থে ক্ষুদ্র এবং তুচ্ছ। কিন্তু ইহার একটি বৃহত্তর তাৎপর্য আছে। তাহা পরিচিতির রাজনীতি সংক্রান্ত। পরিচিতিকে কেন্দ্র করিয়া, পরিচিতির মালিকানাকে লক্ষ্য করিয়া বহু স্তরে বহু পরিসরে বহু ধরনের রাজনীতি অহরহ চলিতে থাকে। এ ক্ষেত্রে তাহাই ঘটিতেছে। যাঁহারা আপত্তি তুলিয়াছেন, আইন বা বিশুদ্ধ যুক্তির ভুবনে তাঁহাদের পায়ের নীচে শক্ত জমি নাই। সিএএ-র প্রতিবাদে কোথায়ও প্রাক্তনী সংগঠনের নাম বা অভিজ্ঞান ব্যবহার করা হয় নাই, প্রতিবাদীরা নিজেদের পরিচয় জানাইয়াছেন ‘কনসার্নড সাউথ পয়েন্ট অ্যালামনি অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’ অভিধায়। এই পরিচয় অবশ্যই বৈধ, সঙ্গত, অনস্বীকার্য। এই সহজ কথাটি সংগঠনের সদস্য বা সহমর্মীরা নিজেরাও নিশ্চয়ই বিলক্ষণ জানেন, তাঁহাদের নির্বোধ মনে করিবার কোনও কারণ নাই। কিন্তু প্রাক্তনী পরিচয়টির ছায়া তাঁহাদের উপরেও আসিয়া পড়িতেছে, তাঁহারা প্রতিবাদ আন্দোলনের ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ হইয়াছেন। তাঁহাদের অস্বস্তি বা (বি)রাগ অযৌক্তিক নহে। চাহিলে তাঁহারা ‘নট ইন মাই নেম’ বলিয়া পাল্টা মিছিল বা সভা আয়োজন করিতেই পারেন, চাহিলে কিছুই না করিতে পারেন, কিন্তু প্রাক্তনী পরিচয়টিকে নিজেদের তথা সংগঠনের দখলে রাখিবার আবদার করিতে পারেন না। রাজনীতিতে কোনও একটি জাতি বা গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের ‘সোল স্পোকসম্যান/পার্সন’ বা একমাত্র প্রতিনিধি হইবার দাবি সুপরিচিত— বিভিন্ন উপলক্ষে অনেক নেতা বা দলই সেই দাবি করিয়াছেন, অনেক সময় ছলে বলে ও কৌশলে দাবি আদায়ও করিয়াছেন। কিন্তু নীতি ও যুক্তি কখনওই সেই দাবির পক্ষে থাকে নাই। পরিচিতির বহুত্বকে বলপূর্বক দমন করা যায়, তাহার সত্যরূপকে অস্বীকার করা যায় না। সব মানুষ এক নহেন, সব প্রাক্তনী এক হইবেন কেন?