সম্পাদকীয় ১

দায়ভাগ

সনিয়া ও রাহুল গাঁধী এবং তাঁহাদের বরকন্দাজরা সম্ভবত বুঝিতে পারিলেন না, একটি অত্যন্ত বড় রকমের ঐতিহাসিক ভুল হইল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৭ ০০:৪৪
Share:

তি ন দিন কাটিয়া গেল, কেহ উত্তর দিল না। ধরিয়া লওয়া যায়, কেহ উত্তর দিবে না, উত্তর নাই। উত্তর থাকিলে চিত্রপরিচালক মধুর ভাণ্ডারকরের প্রশ্নের জবাব দিতে এত দিন লাগিত না। প্রশ্ন তো সামান্য। নূতন চলচ্চিত্র ‘ইন্দু সরকার’ দেখাইবার সময় পুণে ও নাগপুরে কংগ্রেস সমর্থক বলিয়া পরিচিত গুন্ডারা যে বিপুল অশান্তি ভাঙচুর করিয়া সিনেমা বন্ধ করিয়া দিল, দলীয় প্রধান হিসাবে সনিয়া বা রাহুল গাঁধী কি সেই গুন্ডাগিরির নিন্দা করিবেন? কোনও ভর্ৎসনাবাক্য উচ্চারণ করিবেন? পরিচালক ভাণ্ডারকর কি নিজের বাক্-স্বাধীনতার অধিকার দাবি করিতে পারেন? কংগ্রেস নেতৃত্বের অপার নৈঃশব্দ্য বলিতেছে, নিন্দার অবকাশ নাই, ভাণ্ডারকর মহাশয় বাক্-স্বাধীনতা ইত্যাদি আপাতত ভুলিয়া যাইতে পারেন! বাস্তবিক, গুন্ডারা যে দলের উচ্চ নেতৃত্বের অনুমোদন-সাপেক্ষেই এই কাজ করে নাই, এমনটাও কি জোর করিয়া বলা যায়? মহারাষ্ট্রীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব তো প্রথমেই বেশ জোরের সঙ্গে সিনেমাটি নিষিদ্ধ করার দাবি তুলিয়াছে। এখন আর কোন মুখে অশান্তির নিন্দা? নিষেধাজ্ঞা যাঁহারা চাহেন, তাঁহারা তো সাংস্কৃতিক গুন্ডাগিরিতেই বিশ্বাস করেন। তবে আর হাতেকলমে যাহারা গুন্ডাগিরি করিতেছে, তাহাদের আটকাইতে নেতারা কেনই বা আগ্রহী হইবেন। রাহুল গাঁধী নিজে কী চাহেন? ‘উত্তর’ নাই, সুতরাং অনুমান ভরসা। অনুমান বলিতেছে, পরিবারতন্ত্রের ধারক ও বাহক কংগ্রেস দলের প্রধান সভাপতি এই ছবি নিষিদ্ধ করিবার পক্ষেই থাকিবেন!

Advertisement

মহারাষ্ট্রের কংগ্রেস মুখপাত্র অতুল লোণ্ঢে বিশদ ভাবে দলের অবস্থানটি ব্যাখ্যা করিয়াছেন। বলিয়াছেন, বাক্-স্বাধীনতা ভালই জিনিস, তবে ইতিহাসের বিকৃতি ঠিক নয়, বিশেষত ইন্দিরা গাঁধীর জরুরি অবস্থার মতো গুরুতর একটি সময়কাল লইয়া ভ্রান্ত তথ্য পরিবেশন চলিতে পারে না। তাই নিষেধাজ্ঞার দাবি (এবং ভাঙচুর)। লোণ্ঢেরা অবশ্যই জানেন, ইতিহাসে নানাবিধ বিশ্লেষণের স্বীকৃতি আছে। এমনকী হলদিঘাটির যুদ্ধের বিজয়ী পক্ষ কে, সেই বিষয়েও আজকাল তথ্যবিরহিত দাবি আরএসএস-এর কল্যাণে ইতিহাস বলিয়া প্রচারিত হইতেছে! চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে তো শিল্পের অতিরিক্ত স্বাধীনতাও মান্য হইবার কথা। যে বাণিজ্যিক ছবি কোনও রকম হিংসা বা অসাংবিধানিকতাকে প্রশ্রয় দিতেছে না, তাহাকে কী যুক্তিতে নিষিদ্ধ করা? কংগ্রেসের মতের সহিত পরিচালকের মত মিলিতেছে না, কেবলমাত্র এই যুক্তিতে? ইহার পরও কংগ্রেসের নেতারা সহিষ্ণুতার দাবি তুলিবার দুঃসাহস দেখাইবেন? বিজেপির অসহনশীলতার বিরোধিতায় আগাইয়া আসিবেন? আসিলে, কে শুনিবে তাঁহাদের পবিত্র কথামালা?

সনিয়া ও রাহুল গাঁধী এবং তাঁহাদের বরকন্দাজরা সম্ভবত বুঝিতে পারিলেন না, একটি অত্যন্ত বড় রকমের ঐতিহাসিক ভুল হইল। বিজেপি যেখানে গোটা দেশ ধরিয়া একের পর এক অসহনশীলতার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করিতেছে, হিন্দু রানি ও মুসলিম শাসকের ইতিহাস লইয়া সহিংস আক্রমণের প্লাবন বহাইতেছে, সেখানে একই দোষের ভাগী হইয়া সমালোচনার নৈতিক জোরটিই কংগ্রেস হারাইয়া ফেলিল। কোন মুখে কংগ্রেস নেতানেত্রীরা সংসদে হিন্দুত্ববাদী সাংস্কৃতিক স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইবেন? অন্যের মুখ বন্ধ করিয়া যে কোনও ‘বাদ’-এর অসহিষ্ণু অগণতান্ত্রিক প্রবর্তনাই একই রকমের অপরাধ। ঘটনা হইল, ‘পরিবার’ বিষয়ক অসহিষ্ণুতা কংগ্রেসের বহু পুরাতন চরিত্র। তাই কেবল আজিকার ঐতিহাসিক ভুলটি নহে— হিন্দুত্বের সাম্প্রতিক অসহিষ্ণুতার আংশিক দায়ও কংগ্রেসকে লইতে হইবে। তাঁহারাই এই সংস্কৃতির বীজ ভারতীয় রাজনীতির মাটিতে প্রোথিত করিয়াছেন। সেই বীজ হইতে বিষবৃক্ষ ক্রমশ এবং অবিরত ডালপালা মেলিতেছে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement