—ফাইল চিত্র
১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি প্রজাতান্ত্রিক ভারতের সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ আদর্শ এবং লক্ষ্যসমূহ নিয়ে শুরু হয় এই উপমহাদেশের পথচলা। সংবিধানের সূচনাতেই ঘোষণা করা হয়েছে ভারত একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্র। বলা হয়েছে, রাজনৈতিক ন্যায়বিচার, চিন্তার অভিব্যক্তির, বিশ্বাসের, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা, প্রতিষ্ঠা ও সুযোগের সমতার কথা। ব্যক্তিমর্যাদা ও জাতীয় ঐক্য ও সংহতির স্বার্থে যাতে ভ্রাতৃত্ববোধ বর্ধিত হয়; সেই কারণে ২৬শে নভেম্বর ১৯৪৯ এই সংবিধান গ্রহণ করছি, এমন কথাও বলা হয়েছে।
অনেক ভারতবাসী দেশের নেতৃবৃন্দের উপরে আস্থা রেখেছিলেন। সকলেরই ধারণা হয়েছিল যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ১৯ নম্বর ধারা অনুসারে বাক্ স্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা রয়েছে। দেশবাসী অনুভব করেছিলেন, ভারতে ধর্মের সঙ্গে সরকারের বা নাগরিকত্বের কোনও সম্পর্ক নেই।
কিন্তু এখন কি সেই পরিস্থিতি রয়েছে? ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী আজকের বিক্ষুব্ধ ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ‘সাংবিধানিকতার ক্ষয়কাল’ বলে আক্ষেপ করেছেন। তিনি যথার্থই বলেছেন যে ‘সংবিধানের অনেক মূল কথাই আজ প্রশ্নের মুখে’।
ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে সংসদে এবং রাজ্য বিধানসভাগুলিতে চূড়ান্ত মতপার্থক্য এবং ধর্মীয় পক্ষপাতদুষ্ট সরকারি নানা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সকল ধর্মের মানুষের প্রতিবাদ আজ পথে নেমে এসেছে। কেন্দ্রীয় শাসক দলের নীতি পরিবর্তনের জন্য দেশের সর্বত্র আন্দোলন চলছে। কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় নাগরিকপঞ্জি চালু করতে উদগ্রীব। বিজেপি ব্যতীত প্রায় সব দল মনে করে যে, এ সবের একমাত্র উদ্দেশ্য ভারতকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন করে হিন্দু মুসলমানের দীর্ঘ দিনের সম্প্রীতিকে বিনষ্ট করা এবং রক্ষণশীল হিন্দুত্ববাদের বিস্তার করা। এই সরকারি অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে যখন দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, জামিয়া মিলিয়া, আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্র সমাজ বিক্ষোভ আন্দোলন করে তখন তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করে, রাতের অন্ধকারে চূড়ান্ত শারীরিক নিগ্রহ এবং সর্বোপরি অকথ্য পুলিশি নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের প্রতিবাদের কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। অধ্যাপিকা, ছাত্রীরাও এই নির্যাতন থেকে রক্ষা পান না।
কয়েক মাস ধরেই রাজ্যের ও কেন্দ্রের বিজেপি নেতৃবৃন্দ হুঙ্কার দিয়ে বলেছেন যে অনুপ্রেবেশকারীদের তাড়ানো হবে। প্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথাবার্তায় ধোঁয়াশা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্কের সৃষ্টি করছে। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারগুলিকে এই আইন রাজ্যে বাস্তবায়িত করতে চাপ সৃষ্টি করছে। কিন্তু কিছু রাজ্য এই সংশোধিত নাগরিক আইন বাতিলের প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীর তির্যক মন্তব্য—সংবিধানে বলা হয়েছে নাগরিকত্ব নিয়ে আইন তৈরির সম্পূর্ণ অধিকার সংসদের। তিনি আরও বলেছেন, ২৫৬ ধারা বলছে সংসদ প্রণীত আইন রাজ্যগুলি মেনে চলতে বাধ্য। সংসদের উভয় কক্ষে সংশোধিত নাগরিকতা বিল আলোচিত হয়েছে এবং অনুমোদিত হয়েছে। এই আইন বর্জনের অধিকার রাজ্যগুলির নেই। কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী মুখতার আব্বাস নকভি বলেন, ‘‘যারা সংবিধানের নামে শপথ নিচ্ছেন এবং তাকে ধ্বংস করছেন তারা দায়িত্বজ্ঞানহীন।’’
ধর্ম যে নাগরিকত্বের ভিত্তি হতে পারে না, সংবিধান প্রণেতারা জাতীয় আইনসভায় বিতর্কের মধ্যে দিয়েই তা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন। এর ফল স্বরূপ এদেশের সংবিধানে সমানাধিকার স্বীকৃতি পেয়েছে। অথচ বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ থেকে আগত অত্যাচারিত হিন্দু, শিখ, জৈন প্রভৃতি ৬টি ধর্মের মানুষকে নাগরিকত্ব দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে নতুন নাগরিকত্ব আইনে। কিন্তু ওই সব দেশের মুসলমানদের সেই সুযোগ প্রদান করা হয়নি। নাগরিকত্ব দেওয়ার শর্ত হিসাবে ধর্মকে বিবেচনা করা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্যের প্রতি অসম্মান এবং সংবিধানের সঙ্গে জালিয়াতি বলে সিপিআই-এর পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ আদালতে উক্ত আইন বাতিলের আবেদন করা হয়েছে। যদিও জাতিপুঞ্জে মানবাধিকার সনদের ১৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী জাতি, ধর্ম, নাগরিকতা, রাজনৈতিক মতামত পোষণের জন্য কেউ নির্যাতিত হয়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিলে তাকে অনুপ্রবেশকারী বলা যাবে না।
কেন্দ্রীয় সরকার নয়া আইনের স্বপক্ষে বলেছে যে নেহরু, গাঁধী, পটেল-মৌলানা আজাদ থেকে শুরু করে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ হিন্দু ও শিখদের ভারতে আশ্রয়ের কথা বলেছেন। তা হলে তাঁরাও কি সাম্প্রদায়িক? এ কথাও বিজেপি-র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, রাজস্থানে গত বিধানসভা নির্বাচনে (২০১৯) কংগ্রেসের ইস্তাহারে পাকিস্তান থেকে আসা মানুষদের নাগরিকত্ব ও পুনর্বাসন সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেখা হয়েছিল। অমুসলিম সংখ্যালঘুদের প্রতি বিভিন্ন দেশে নির্যাতনের ক্ষেত্রে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলির সহানুভূতিসূচক প্রতিক্রিয়া সে ভাবে দেখা যায়নি, এটাও বাস্তব সত্য। অনেক রাজ্যেই উদ্বাস্তুদের নাগরিকতা প্রদান না করায় তারা নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিজেপির কার্যনির্বাহী সভাপতি জেপি নড্ডা বলেছেন, আফগানিস্তানে থাকা ৫০ হাজার শিখ পরিবারের মধ্যে মাত্র হাজার দুয়েক এখন ওই দেশে রয়েছেন। পাকিস্তানে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টানদের সংখ্যা আগে ছিল ২৩ শতাংশ, এখন তা তিন শতাংশ। বাংলাদেশেও অমুসলিম জনসংখ্যা ২৩ শতাংশ থেকে নেমে ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারকত এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, ১৯৬৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাঁচ দশকে ১ কোটি ১৩ লক্ষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী বাংলাদেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছেন।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক বলেছে হিন্দু শরণার্থীরা সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের নাগরিকত্ব পাবেন। এই আইন নিয়ে কেন্দ্র পিছু হটবে না। রাজ্যসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, জাতীয় নাগরিকপঞ্জিতে সব ধর্মের মানুষ অন্তর্ভুক্ত হবেন, ধর্মের ভিত্তিতে বিভেদ করার কোনও প্রশ্ন নেই।
জাতীয় নাগরিকপঞ্জি, জাতীয় জনসংখ্যাপঞ্জি, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী এ রাজ্যে চালু করতে দেবেন না বলে ঘোষণা করেছেন। অন্য বেশ কয়েকটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীগণ তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবেন বলে জানিয়েছেন। নাগরিকত্ব আইনের প্রশ্নে রাষ্ট্রপুঞ্জের তত্ত্বাবধানে গণভোটের আহ্বানও করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে এই ঘোষণা সংবিধান এবং দেশের সার্বভৌমত্বের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করবে। পরে সেই ঘোষণা থেকে তিনি সরেও আসেন। সংশোধিত নাগরিকতা আইন প্রণয়নের প্রয়াস শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গত দু’মাস যাবৎ এ রাজ্যের উদ্বাস্তুদের জমির পাট্টাপ্রদানের জন্য রাজ্য সরকার এগিয়ে এসেছে।
জনগণনাপঞ্জির গুরুত্ব অপরিসীম। এতে সংগৃহীত হয় সামাজিক, অর্থনৈতিক তথ্য, যেমন—সাক্ষরতা, কর্ম নিয়োজন, ভাষা, বাসস্থান, দেশান্তর প্রভৃতি। এগুলি যেমন রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ, সরকারি বা বেসরকারি উন্নয়ন পরিকল্পনায় কাজে লাগে, তেমনই রাজনৈতিক তর্ক থেকে শুরু করে বিদ্যাচর্চাতেও ব্যবহৃত হয়।
দীপেশবাবুর কথায় ফিরে এলে বলতে হয়, সাংবিধানিকতার ক্ষয়কালে কিন্তু প্রশ্ন ওঠে পঞ্জির উদ্দেশ্য নিয়ে। জাতীয় নাগরিকপঞ্জি, জাতীয় জনসংখ্যাপঞ্জি চালু করার বিষয়ে বিজেপি-র কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার মোকাবিলা করার মতো কোনও সর্বভারতীয় দল বর্তমানে নেই, তবে সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদের শপথ নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলি, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের এবং সাধারণ মানুষ যে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ জানাচ্ছেন, তা নবীন প্রজন্মকে প্রেরণা জোগাচ্ছে। রাজ্য স্তরের দলগুলি বিরোধী জোট বাঁধলে নতুন রাজনীতি শুরু হতে পারে। কেন্দ্রীয় নীতির একবগ্গা নিয়মকানুন স্থানীয় পরিস্থিতির বিভিন্নতাকে স্বীকৃতি দিতে পারে না। অথচ রাষ্ট্রক্ষমতায় সিংহভাগ আজ কেন্দ্রের আওতায়। ইতিহাসবিদ পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের এরূপ যুক্তরাষ্ট্রীয় বিকল্প ভাবনা অবশ্য নেহরু, প্যাটেল, আবেথকরদের যুক্তরাষ্ট্রীয় মডেলের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সংবিধান প্রণেতারা দেশের সংহতির জন্য শক্তিশালী কেন্দ্রকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। সহযোগিতার ক্ষেত্র বজায় রেখেছেন।
শিক্ষক
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: ‘মুর্শিদাবাদে দ্বিজাতিতত্ত্ব ও দেশবিভাগের প্রভাব’/ বাসুদেব চট্টোপাধ্যায়। এবং আনন্দবাজার পত্রিকা