নায়কতন্ত্রের দিগ্বিজয়

টেরেসা মে-র বিলম্বিত বিদায়ের পরে বরিস জনসন যখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেন, তখন দেশের এবং দুনিয়ার বহু মানুষ বলিয়াছিলেন, অচিরেই তাঁহাকে বিদায় লইতে হইবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:৪৪
Share:

বরিস জনসন। —ফাইল চিত্র

মাত্র পাঁচ মাস আগে টেরেসা মে-র বিলম্বিত বিদায়ের পরে বরিস জনসন যখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেন, তখন দেশের এবং দুনিয়ার বহু মানুষ বলিয়াছিলেন, অচিরেই তাঁহাকে বিদায় লইতে হইবে— অস্থিরমতি, অবিবেচক, অশোভন আচরণের জন্য বরাবর কুখ্যাত এই রাজনীতিকের পক্ষে ব্রেক্সিট-তুফান সামলাইয়া দেশের জটিল রাজনীতিকে চালনা করা অসম্ভব। কনজ়ারভেটিভ পার্টির অন্দরমহলেও তাঁহাকে লইয়া আপত্তি কম ছিল না, প্রায় দুই ডজন সতীর্থ কার্যত বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়াছিলেন: বিনা চুক্তিতে ইইউ ছাড়িয়া যাওয়া তাঁহারা মানিবেন না। বরিস দলের মধ্যে ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্মম ভাবে ছাঁটিয়া দেন। ব্রেক্সিট নীতি লইয়া বিতর্ক এড়াইবার উদ্দেশ্যে পার্লামেন্টের অধিবেশন ডাকিতে না দিয়া সুপ্রিম কোর্টের কঠোর ভর্ৎসনা শুনিতে হয় তাঁহাকে। নির্বাচনী প্রচারের সময়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হইতে অস্বীকার করিয়া প্রভূত নিন্দা কুড়াইতে হয়। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও তিনি একটি অবস্থানে অবিচল ছিলেন— ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারির সর্বশেষ নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেই ব্রেক্সিট ঘটিবে, ইইউ-এর সহিত চুক্তি সম্পন্ন হউক বা না হউক।

Advertisement

এই ধনুর্ভঙ্গ পণই শেষ অবধি কৃতার্থ। মার্গারেট থ্যাচারের পরে এমন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লইয়া নির্বাচনে জয়ী হইবার স্বাদ কনজ়ারভেটিভ পার্টি পায় নাই। এই জয় আক্ষরিক অর্থেই ঐতিহাসিক। এই জয়ের পিছনে বিরোধী লেবার পার্টি, বিশেষত তাহার নেতা জেরেমি করবিন-এর অবদান অনস্বীকার্য। আর্থিক নীতি, বিশেষত সামাজিক সুরক্ষার প্রশ্নে ‘বৈপ্লবিক’ নীতির পশরা সাজাইয়া তিনি এক সময় ব্রিটিশ রাজনীতির মাঝমাঠ দখল করিয়াছিলেন, কিন্তু ব্রেক্সিট প্রশ্নে আগাগোড়া দোলাচলে থাকিয়া উত্তরোত্তর জমি হারাইয়াছেন, বিশেষত বরিস জনসনের জমানা শুরু হইবার পরে তাঁহাকে অস্বাভাবিক দুর্বল দেখাইয়াছে, নির্বাচনী প্রচারের শেষ পর্বটুকু বাদ দিলে তিনি জনসংযোগের উদ্যমও দেখাইতে পারেন নাই। তদুপরি ‘ইহুদি-বিদ্বেষ’এর অভিযোগ তিনি মুছিতে পারেন নাই, মুছিবার যথেষ্ট চেষ্টাও করেন নাই। লেবার পার্টির অস্তিত্বের লড়াই বুঝি শেষ হইবার নহে। রাহুল গাঁধী ও তাঁহার জননীর কথা ভাবিয়া করবিন হয়তো সান্ত্বনা পাইবেন।

এই ফল আরও এক বার বুঝাইয়া দিল, একটি বিষয়ে দুনিয়ার ভোটদাতারা এক হইয়াছেন— তাঁহারা শক্তের ভক্ত। নীতি, আদর্শ, সত্যনিষ্ঠা ইত্যাদি নিতান্ত গৌণ ব্যাপার, যে নেতা দাপটের সঙ্গে বলিতে এবং চলিতে পারেন, তিনিই জনগণেশ হিসাবে বন্দিত হইবেন। তাঁহার অনুগামী হইলে যদি সম্ভাব্য সুযোগসুবিধা হারাইতে হয়, এমনকি অজানা বিপদে পড়িতে হয়, তাহাতেও ক্ষতি নাই। বরিস জনসন শেষ অবধি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহিত চুক্তি সম্পাদন করিতে পারিবেন কি না, তাহা লইয়া ঘোর সংশয় আছে। চুক্তি না করিয়াই ইইউ ছাড়িলে ব্রিটেনের অর্থনীতিতে বড় রকমের সঙ্কট দেখা দিতে পারে। এই নির্বাচনে স্কটল্যান্ডে স্বাতন্ত্র্যকামী দল এসএনপি-র সাফল্য নূতন করিয়া সেই প্রদেশের স্বশাসনের দাবিকে উত্তেজিত করিবে। ভোটদাতারা এই সবই বিলক্ষণ জানেন। তাহার পরেও এই অ-স্বাভাবিক সাফল্য একটি বার্তা দেয়। গণতন্ত্রের পিঠে সওয়ার হইয়া নায়কতন্ত্রের দিগ্বিজয়ের বার্তা। বার্তাটি আশা দেয় না, উদ্বেগ জাগায়। গভীর উদ্বেগ।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement