আত্মতৃপ্ত: সুরাতে বিজেপি প্রার্থীর সাফল্যের পর বিজয়-মিছিল শহরের পথে পথে, ১৮ ডিসেম্বর। ছবি: পিটিআই
বো তলটা অর্ধেক খালি, না অর্ধেক ভর্তি? গুজরাত ভোটের ফল কি বিজেপির পক্ষে আনন্দের, না বিষাদের?
উত্তরটা সোজা নয়, বেশ প্যাঁচালো। যদি এক দিক দিয়ে দেখি, ৯৯টি আসন পেয়ে জেতা নিশ্চয়ই দুঃখের খবর হতে পারে না, ১৮২ আসনের বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হলে যত আসন পাওয়া দরকার, তার চেয়ে সাতটা বেশি: খারাপ কী! বিশেষত বাইশ বছর শাসন করার পরও লাগাতার ছয় নম্বর জয়— নিশ্চয়ই যে কোনও দলের পক্ষেই প্রভূত আত্মসন্তুষ্টির মুহূর্ত। শোনা যাচ্ছিল, এ বার নাকি বিজেপির কপালে দুঃখ আছে, অথচ দেখা গেল ২০১২ সালের বিধানসভা ভোটের তুলনায় এ বারে বিজেপির মোট ভোট বেড়েছে এক শতাংশেরও বেশি। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের থেকে কমেছে অবশ্য, কিন্তু লোকসভা-বিধানসভা এক মানদণ্ডে বিচার করাটা উচিত কি না সেটা ভাবার বিষয়। বিশেষত গত লোকসভা ভোট যেহেতু এমনিতেই নরেন্দ্র মোদীর নামে একটা ‘গণভোট’ হয়েছিল, তার সঙ্গে কি অর্থনীতি-রাজনীতির জটিলতা-জর্জরিত রাজ্য নির্বাচনকে এক করে দেখা যায়? কমলালেবুর সঙ্গে কমলালেবুই মেলানো সংগত, তাই বলতেই হয়, ২০১৭ সালের বিজেপির মোট ভোট যা (৪৯.১ শতাংশ), সম্প্রতিকালে তার থেকে ভাল ফল একমাত্র একটি বিধানসভা নির্বাচনেই ঘটেছিল, ৪৯.৮ ছুঁয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা এসেছিল— ২০০২-এর কালান্তক বছরটিতে!
আবার অন্য দিক দিয়ে, ভোট শতাংশে বেড়েও আসনসংখ্যায় বড় ঘা খেয়েছে বিজেপি। আগের বারের বিধানসভার চেয়ে এ বার ১৬টি আসন কম তাদের। ভোট শতাংশ বেড়েছে কিন্তু আসনসংখ্যা কমেছে— এর অর্থ যেখানে তারা জিতেছে, সেখানে বড় ব্যবধানে জিতেছে, আর পাশাপাশি, অনেক জায়গায় জিততে পারেনি! শহর-নগরের দৌড়ে তারা অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছে, আর অনেকখানি পিছিয়ে গিয়েছে গ্রামীণ গুজরাতে। যে যে গ্রামীণ আসনে জয় এসেছে, তার অনেকগুলিতেই জয়ের মার্জিন সামান্য। অঙ্কটা শুনতে জটিল, কিন্তু অঙ্ক দিয়ে একটা ছবি তৈরি করলে দেখব, ৩৯ নাগরিক আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ৩৩টি, ৪৫ মফস্সলি আসনের মধ্যে ২৬টি, আর ৯৮ গ্রামীণ আসনের মধ্যে মাত্র ৪০টি। গ্রাম-শহর-মফস্সল, তিনটি গোত্রেই বিজেপির মোট ভোট আগের চেয়ে বাড়লেও গ্রামীণ আসনে বাড়ার অঙ্ক অনেকটা নিচু। এই সব সংখ্যা-ছবি বলে দেয়— এ বার গুজরাতে কংগ্রেস নিজের ভোট যতটা বাড়িয়েছে (২০১৪ সালের তুলনায় আট শতাংশ, ২০১২ সালের তুলনায় তিন শতাংশ), সেটা কিন্তু রাজ্যের সব অঞ্চল জুড়ে অনেক বেশি ছড়ানো বৃদ্ধি। অর্থাৎ রাজ্যের সর্বত্র কংগ্রেস নিজের ভোটটা আগের চেয়ে বাড়াতে পেরেছে। কম কথা নয়। বিজেপির পক্ষে কম দুঃখের কথাও নয়।
তাই কংগ্রেস আনন্দিত হতেই পারে বোতল অর্ধেক খালি দেখে। বিজেপিও আনন্দ পেতে পারে অর্ধেক ভর্তির পক্ষ নিয়ে। কাউকেই ভুল বলা যাচ্ছে না। — খালি-ভর্তির সওয়াল জবাব চলুক। তার মধ্যে দুটি বিষয় ভাল করে বুঝে নেওয়া দরকার। দুই পক্ষের দুটি বিষয়।
প্রথমত, গ্রামের মানুষ বিজেপিকে একটা জোরদার বার্তা দিতে চেয়েছেন, কংগ্রেস সেটা কাজে লাগিয়েছে। ‘গুজরাত মডেল’ বলে কিছু ছিল বা আছে কি না, সেটা বহুবিতর্কিত, কিন্তু একটা জিনিস নিয়ে বিতর্ক নেই— গ্রামের মানুষ সেই মডেলে খুশি তো হনইনি, বেজায় চটেছেন। বিজেপির এক রাজ্য নেতা বেফাঁসে দুঃখটা প্রকাশ করে ফেলেছেন: ‘পাস’ (হার্দিক পটেলের নেতৃত্বে পাতিদার আন্দোলন সমিতি) তো নয়, ‘কাপাস’ আমাদের আসন নিয়ে নিল।— অর্থাৎ, রাজ্যের প্রধান কার্পাস উৎপাদক অঞ্চল সৌরাষ্ট্রে খারাপ ফল বিজেপির বড় ক্ষতি করে দিল। প্রসঙ্গত, ২০১২ সালে দশ কেজি তুলোর দাম ৭০০ টাকা হুড়মুড়িয়ে ২০১৭ সালে ৩০০ টাকায় নেমেছে। এ কেবল জিএসটির গল্প নয়, আরও বড় গ্রাম-অর্থনীতির সংকট। অর্থনীতির সেই অঘটনকে মোদী-রাজনীতি যে সামাল দিতে পারছে না, কথাটা গুরুত্বপূর্ণ বটেই।
গুরুত্বপূর্ণ এই জন্যও যে, এ কেবল গুজরাতের বাস্তব নয়, দেশের অন্যত্রও একই ধারা। ডিসেম্বরের গোড়ায় উত্তরপ্রদেশে পুর-নির্বাচনে এবং কয়েক দিন আগে রাজস্থানে উপনির্বাচনেও এর প্রমাণ মিলল। বিজেপি শহরের বড় আসনগুলিতে সফল, আর শহর-গ্রামের পরবর্তী ধাপগুলিতে— দস্তুরমতো বিধ্বস্ত। উত্তরপ্রদেশে মেয়র পদের বিজেপি প্রার্থীদের জয় ৪১ শতাংশ, আর নগর পঞ্চায়েত সদস্যদের মধ্যে মাত্র ১১ শতাংশ। অর্ধেক বিজেপি প্রার্থীর জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত। অথচ উত্তরপ্রদেশে বিজেপির জয়ের ঢক্কানিনাদ কতই শুনলাম। এই ক’দিন আগে রাজস্থানের টাটকা খবরটা তালেগোলে কেমন চাপা পড়ে গেল, কেননা ওখানে ঢাক বাজানোর সুযোগটাই পাওয়া গেল না। রাজ্য জুড়ে জেলা পরিষদের সব আসন এবং পঞ্চায়েত সমিতির অধিকাংশ আসনে জয়ী কংগ্রেস। সব মিলিয়ে তা হলে বিজেপির ‘গ্রামীণ’ সংকটকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত ঘটনা বলা যাচ্ছে না। একটা সামগ্রিক ছবিরই অংশ গুজরাত। গ্রাম এখন বিজেপির পথের কাঁটা।
দ্বিতীয়ত, মোদী-শাহদের মর্মে যে এই পথের কাঁটা ভালমতোই গেঁথে আছে, সেটার প্রমাণও গুজরাত ভোটে মিলল। প্রচার যত এগোল, পরিস্থিতি তত স্পষ্ট হল, আর তাই প্রচারের দ্বিতীয়ার্ধে দেখা গেল একটা সচেতন ‘অ্যান্টিডোট রাজনীতি’। লও ফিরে সে গ্রামাঞ্চল, দাও এ নগর: এই তো ছিল এ বার তাঁদের ‘প্রজেক্ট গুজরাত’-এর সারমর্ম। অবস্থা যথেষ্ট বেগতিক বুঝে তাঁরা, বিশেষত প্রধানমন্ত্রী মোদী, এই স্ট্র্যাটেজিতে নিজেদের উজাড় করে দিলেন, নগর-শহরের উপর সম্পূর্ণ মনোযোগ ঢাললেন, বিধানসভার মোট আসনের ‘মেজরিটি মার্ক’ পেরোনোটাকেই লক্ষ্য করলেন। মোদী যখন উদারা থেকে সোজা তারায় স্বর চড়াচ্ছিলেন, রাহুল গাঁধীর সঙ্গে আওরঙ্গজেব আর মনমোহন সিংহের সঙ্গে পাকিস্তানের যোগসূত্র ঘোষণা করছিলেন, সাম্প্রদায়িকতাকে জাতীয়তাবাদের মোড়কে মিছিলে মিটিং-এ ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন, তখন এই স্ট্র্যাটেজিই তাঁর মাথায় ছিল। মানতেই হবে, এই অ্যান্টিডোট রাজনীতি পদে পদে সফল।
প্রচারের যে পর্বে তাঁকে এই স্তরে উঠতে দেখা গেল, সে পর্বেই জিএসটি-র ‘কাটান’ প্রস্তাবসমূহও ঘোষিত হল। মোদীরা জানেন, শহর-নগরকে এই দুই ছক্কাতে জিতে নেওয়া যায়। ভোটের পর বহু ব্যবসায়ী সরাসরি জানিয়েছেন, তাঁদের ক্ষোভ থাকতে পারে, কিন্তু মোদী যখন বলেছেন, ক্ষোভের প্রতিকার নিশ্চয়ই হবে। সুরাতে হীরা-ব্যবসায়ীরা জিএসটি নিয়ে একাধিক প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন, কিন্তু ভোটটা শেষে ‘ঠিক’ জায়গাতেই দিয়েছেন। অমদাবাদ সুরাত বডোদরায় শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বিজেপির উপর অখুশি হলেও ভোট কাকে দেবেন তা নিয়ে দ্বিধায় ভোগেননি, কেননা কংগ্রেস কেবল চাষি-টাষিদের কথা বলে, কিন্তু মুসলিমদের যথাযোগ্য দাওয়াই দিয়ে ব্যবসাবাণিজ্য ভোগ্যপণ্য রাস্তাঘাট বিমানবন্দর এই সব দিক যে দেখতে পারে মোদীর সরকারই, গত বাইশ বছরে তার বিস্তর প্রমাণ মিলেছে।
নগর-ভারতের সাম্প্রদায়িকতা ও স্বার্থপরতাই এখন বিজেপির মূল ভরসা। ভোগ-বিনোদনপ্রেমী শহরবাসী তাঁদের সঙ্গে আছেন। তাই মোদীরা ‘ঠিক’ লাইনেই প্রচার চালাচ্ছেন। উত্তরপ্রদেশে শোনা গিয়েছে, বিজেপির জয় ‘সর্বাত্মক’। গুজরাতেও বিজয় উৎসব চলছে, চলবে, গ্রাম-শহরের ভোট-দূরত্ব তাতে বাদ সাধবে না। শহুরে মন ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের বড় সমঝদার, তাই সংঘ ঠিক সময় বুঝে রামমন্দিরের আশা ফেরাতে ইতিমধ্যেই সচেষ্ট।
গ্রাম যে তিমিরে থাক, শহরে শহরে পরদীপশিখা আজ পুরোপুরি প্রজ্বলিত। সেই আলোকবিভায় উদ্ভাসিত মোদীজির মুখ, অন্তত এখনও পর্যন্ত।