আগুন: নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল, ২০১৬-র বিরুদ্ধে গুয়াহাটির রাস্তায় প্রতিবাদ। জুন, ২০১৮। ছবি: এএফপি
ভারতীয় হওয়ার হকদার কে, নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল, ২০১৬ সেই প্রশ্নের জবাবে বড় রদবদল করতে চলেছে। বিল বলছে— আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা এ দেশে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া এলেও তাদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গণ্য করা হবে না। সাত বছর এ দেশে থাকলে তাঁরা স্বাভাবিকীকরণ (ন্যাচরালাইজ়েশন) মারফত ভারতীয় নাগরিক হওয়ার আবেদন করতে পারবেন। সংখ্যালঘু বলতে হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, পারসিদের কথা বলা হচ্ছে। ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকার লোকসভায় বিল পেশ করে। বিজেপি নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয় বলেছেন, ২০১৯ সালের ভোটের আগে বিল পাশ হয়ে যাবে।
হওয়ারই কথা। ২০১৪ সালের ভোটে বিজেপির ইস্তাহারে বলা হয়েছিল ‘‘অত্যাচারিত হিন্দুদের জন্য ভারত স্বাভাবিক আশ্রয়স্থল থাকবে। আশ্রয়ের জন্য তাঁরা এ দেশে আসতে চাইলে স্বাগত।’’ নাগরিকত্ব আইনে পরিবর্তন করে বিজেপি সরকার ইস্তাহারে দেওয়া কথা রাখছে। এই বিশেষ প্রতিশ্রুতিটির মূলে আছে বিজেপির রাজনৈতিক মতাদর্শ। সঙ্ঘ পরিবার যে জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের দোহাই দেয়, তা নাগরিক জাতীয়তাবাদ (সিভিক ন্যাশনালিজ়ম) নয়। এমনটা নয় যে দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেই বিজেপির জাতীয়তাবাদ আপনাকে তাদের রাষ্ট্রে জায়গা দেবে, বা সমান অধিকার দেবে। বিজেপির জাতীয়তাবাদ ধর্মভিত্তিক। বিজেপির রাষ্ট্রে ঠাঁই পেতে হলে ‘ঠিক সংস্কৃতি’র হতে হবে। অর্থাৎ, হিন্দু হতে হবে।
ভারতে হিন্দুদের অধিকার বেশি কেন? সভরকর ‘হিন্দুত্ব: কে হিন্দু?’ পুস্তিকাতে যুক্তি দিয়েছেন, ভারত হিন্দুদের পিতৃভূমি, পুণ্যভূমি। ভারতীয় মুসলমান বা খ্রিস্টানের সঙ্গে হিন্দুর এখানেই তফাত। মুসলমান বা খ্রিস্টানদের পুণ্যভূমি হিন্দুদের মতো ভারতে নয়। সে সব আরব দেশে, জেরুজ়ালেমে। সভরকরের মতে, অতএব ভারতের মাটির ওপর হিন্দুদের অধিকার বাকিদের তুলনায় এক কাঠি বেশি।
বিজেপির ইস্তাহারের ঘোষণা বা নাগরিক আইনে সংশোধনের পিছনে রয়েছে এই হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ। যাঁরা বিজেপিকে ভোট দিয়ে ভেবেছিলেন বলিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী মোদীর দৌলতে অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠবে, তাঁরা খেয়াল করেননি, বিজেপির রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ প্রবল ভাবে বিরাজমান। এক কোটি চাকরির ভগ্নাংশও তৈরি হয়নি, কিন্তু হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের কাজে ফাঁকি পড়েনি।
২০১৪-র নির্বাচনের সময়ে মোদী এক টিভি সাক্ষাৎকার দেন যেখানে ইস্তাহারের ঘোষণার কথা ওঠে। সাংবাদিক মোদীকে প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশে প্রায় দেড় কোটি হিন্দু বাসিন্দা আছেন। আপনারা ওঁদের ভারতে চলে আসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন না তো? মোদী প্রশ্নের সোজা জবাব দেননি। হিন্দু কোনও ধর্মই নয়, হিন্দু এক জীবনশৈলী, এ সব বলে এড়িয়ে গিয়েছেন। যদি সোজাসাপ্টা বলে দিতেন, হ্যাঁ আমরা মনে করি ভারত বাংলাদেশি হিন্দুদের আশ্রয়স্থল, ভোটে জিতলে সে রকম আইন বানাব, তা হলে অসম ও অন্য উত্তর-পূর্বের রাজ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হত। পরে ২০১৬ সালে বিল এল এবং অসমিয়া জাতীয়তাবাদী দলগুলো জোরালো প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে পড়ল। দেড় কোটি বাংলাদেশির ভয় তো আছেই, এই বিল অসম চুক্তিকে খারিজ করে দিচ্ছে বলেও অভিযোগ। অসম চুক্তি অনুযায়ী, ১৯৭১-এর পরে আসা বিদেশিদের জাতিধর্ম নির্বিশেষে সোজা বহিষ্কার করতে হবে।
অসমে বহিরাগত অভিবাসনের ইতিহাস ও পরিচিতিভিত্তিক রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত স্থানীয় গোষ্ঠীগুলোকে বহিরাগতদের প্রতি সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। নাগরিকত্ব বিলে রাজ্যের রাজনীতি তোলপাড়। অসমের জোট সরকারে বড় শরিক বিজেপি ও ছোট শরিক অসম গণ পরিষদ (অগপ)। খোদ মুখ্যমন্ত্রী-সহ বহু বিজেপি নেতা কিছু দিন আগে অগপ-তে ছিলেন, অসমিয়া জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ছড়ি ঘুরিয়ে এসেছেন। বিজেপির কেন্দ্রীয় নীতি যা-ই বলুক, তাঁদের পক্ষে চট করে বিল সমর্থন করা মুশকিল, কেননা তা হলে ভূমিপুত্র বা খিলঞ্জিয়াদের পিঠে ছুরি মারার অভিযোগ উঠবে। বাঙালি অধ্যুষিত বরাক উপত্যকায় বিজেপি অবশ্য হিন্দু বাঙালির রক্ষাকর্তা হিসেবে বুক ফুলিয়ে বেড়াচ্ছে। অন্য দিকে অগপ নেতারা বিলকে ‘জাতিধ্বংসী বিধেয়ক’ বলে তীব্র নিন্দা করছেন। সরকারের বাইরের জাতীয়তাবাদীরা আরও বেশি মারমুখী। বাম-ঘেঁষা ‘কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতি’ থেকে উগ্র জাতীয়তাবাদী ‘ছাত্র সংস্থা’— সবাই দেড় কোটি বাংলাদেশির জুজু দেখাচ্ছে।
বেশ কিছু বাঙালি সংগঠন বিলের ঘোর সমর্থক, বিলে যে হিন্দুদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব আছে, তা বুঝে বা না বুঝেই। বিজেপির লাভের খাতায় এরা আসবে। সীমানার অন্য পারে মিজ়োরাম, অরুণাচল প্রদেশেও বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে। মেঘালয় ও নাগাল্যান্ডে খোদ সরকার বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে। এই দুই সরকারে আবার বিজেপি শরিক দল!
বিজেপির দিক থেকে দেখলে বিলের অন্তত দুটো উপকারিতা। প্রথমত, মতাদর্শগত লাভ। ভারত হিন্দুদের ধাতৃভূমি পুণ্যভূমি, এই মৌলবাদী ধারণাকে বিলটি আইনি জামা পরিয়ে দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এনআরসি বা নাগরিকপঞ্জির কাজ এখনও চলছে। এনআরসি’র শেষ তালিকা বেরোনোর কথা ৩০ জুন। তার পর জানা যাবে ক’জন অসমবাসী জায়েজ, আর কারা বাংলাদেশি। যদি দেখা যায় হিন্দু অসমবাসীর বড় অংশের নাম তালিকায় নেই, বিজেপি নাগরিকত্ব বিলের মুলো ঝুলিয়ে বলবে, আমরাই হিন্দুদের পরিত্রাতা, বিল পাশ করিয়ে হিন্দুদের বাংলাদেশে বহিষ্কার হওয়া থেকে রক্ষা করব। খিলঞ্জিয়াদের বিরোধিতাকে ঠান্ডা করতে বলা হবে, এত হিন্দু রাজ্য ছেড়ে গেলে অসম মুসলমান শাসনে চলে যাবে যে! কাজেই, বিল সমর্থন করুন। বিজেপি নেতারা এ রকম বয়ান দিতে শুরু করেছেন। আবার, খিলঞ্জিয়াদের ক্ষোভে মলম দিতে বিজেপি নেতারা হিন্দু বাঙালিদের বাঙালিত্ব ত্যাগ করে অসমিয়া হওয়ার ডাক দিচ্ছেন। ত্রিপুরার রাজ্যপাল তথাগত রায় উপদেশ দিয়েছেন বাঙালি হিন্দুরা অসমিয়া হিন্দু সমাজের মধ্যে মিশে যাক, তাতে দুই হিন্দু ভাইই বাঁচবে।
অন্য দিকে, যদি কম সংখ্যক বাঙালি হিন্দু অসমবাসীর নাম এনআরসি তালিকার বাইরে থাকে, তা হলে বিল-বিরোধীদের আপনিই ধার কমে যাবে, কেননা কম লোককেই জায়গা দিতে হচ্ছে। সংক্ষেপে, বিজেপির কাছে নাগরিকত্ব বিল হিন্দু ভোট এক জোট করার হাতিয়ার।
অসমের প্রসঙ্গ ছেড়ে একটু বড় প্রশ্নে যাই। বিলটির মূল সুর ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে, ফলে সংবিধানের চতুর্দশ অনুচ্ছেদকে (আইনের সামনে সবার সমান অধিকার) লঙ্ঘন করছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, শুধু পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তানের মতো মুসলমানপ্রধান দেশের সংখ্যালঘুদের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা কেন? শ্রীলঙ্কা, মায়ানমারেও সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার হয়, অত্যাচারিতদের মধ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানরা আছেন। তাঁদের বিলের আওতায় আনলে মুসলমানরা ভারতের নাগরিক হয়ে যাবে, এই ভয়ে? আবার পাকিস্তানে শিয়া, আহমদিয়াদের ওপর অত্যাচার চলে আসছে বহু দিন। তাঁদের জন্য নাগরিকত্বের ব্যবস্থা নেই, তাঁরা মুসলমান বলে? বা ধর্মকেই সংখ্যালঘুতার ভিত্তি কেন ধরা হচ্ছে? রাজনৈতিক বিশ্বাস বা সমকামিতার জন্যও লোকে অত্যাচারিত হয়। সেই সংখ্যালঘুরা কি ঠিক সংখ্যালঘু নয়?
আশ্রয় পাওয়ার জন্য সংখ্যালঘুদের অত্যাচারিত হওয়ার প্রমাণ দাখিল করতে হবে না। ধরা যাক এক জন হিন্দু বহাল তবিয়তে বাংলাদেশে আছেন, অত্যাচারিত নন। তিনি কাগজপত্র ছাড়াই ভারতে আশ্রয় চাইতে পারেন, কেননা তিনি সংখ্যালঘু হিন্দু। অথচ যখন বিলের সপক্ষে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে বলা হচ্ছে সংখ্যালঘুরা অত্যাচারিত তাই আশ্রয়! সন্দেহ হয়, অত্যাচারিত হওয়ার যুক্তিগুলো নিছক কথার কথা। আসল কথা, ভারতে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে।
১৯৪৮ সালের জাতিসঙ্ঘের সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ বলছে, সব অত্যাচারিতের অন্য দেশে আশ্রয় চাওয়ার ও পাওয়ার অধিকার আছে। সনদে ভারতের সই আছে। কেউ মঙ্গলগ্রহ থেকে ভারতের নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল, ২০১৬-কে দেখলে মনে হতেই পারে, ভারত অত্যাচারিত সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়াচ্ছে।
মঙ্গলগ্রহ থেকে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি দেখতে পাওয়া মুশকিল যে!
আইআইটি, গুয়াহাটিতে অর্থনীতির শিক্ষক