রক্তক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে জন্ম নাগাল্যান্ডের

১৯৪৬ সালে ‘ওখা’ তে গড়ে ওঠে নাগাদের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন। সেটি নাগা ন্যাশনাল কাউন্সিল (এনএনসি) নামে পরিচিত হল। তারা চাইল স্বায়ত্তশাসন। প্রধানমন্ত্রী নেহরুও চাইলেন উত্তর-পূর্ব ভারতের আদিবাসীদের জন্য আলাদা নীতি হোক। লিখছেন গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়১৯৪৬ সালে ‘ওখা’ তে গড়ে ওঠে নাগাদের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন। সেটি নাগা ন্যাশনাল কাউন্সিল (এনএনসি) নামে পরিচিত হল। তারা চাইল স্বায়ত্তশাসন। প্রধানমন্ত্রী নেহরুও চাইলেন উত্তর-পূর্ব ভারতের আদিবাসীদের জন্য আলাদা নীতি হোক।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০১৯ ০১:০৭
Share:

নতুন রাজ্য নাগাল্যান্ড। উপস্থিত রাষ্ট্রপতি সর্বেপল্লি রাধাকৃষ্ণণন। ফাইল ছবি

“নাগাল্যান্ড ভারতের নয়। না ছিল এটা ভারতের কোন অংশ বিশেষ, না ছিল উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া”, বলে ছিলেন ফিজো( Phizo)। অনেকে মনে করেন, একাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে নাগাদের পূর্বপুরুষেরা চীনের ইউনান প্রদেশ থেকে পাটকি এলাকা অতিক্রম করে ‘মাখেল’, যার অর্থ ‘গোপন জায়গা’য় এসে বসতি স্থাপন করেন।

Advertisement

১৮৩২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মণিপুর রাজ্যের ভিতর দিয়ে ‘আঙ্গামি’ অঞ্চলে এসে উপস্থিত হয় এবং ১৮৬৬ সালে ‘নাগা হিলস’ জেলা গঠন করে অসমের সঙ্গে জুড়ে দেয়। এর মুখ্যালয় হয় ‘সামাগুটিং’। পরে ১৮৭৬ সালে মুখ্যালয় ‘ওখা’ তে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ।

ভারতীয়দের সঙ্গে নাগাদের কোনও রকম রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক সংযোগ যাতে না থাকে তার জন্য ‘ব্যাকওয়ার্ড ট্র্যাক্টস’, ‘এক্সক্লুডেড এরিয়া’ নামে দু’টি আইন বলবৎ করা হয়। এমনকি, ভারতের স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশরা (কুপড প্ল্যান) উত্তর-পূর্ব ভারতে ‘ক্রাউন কলোনি’ বলে একটি অঞ্চল তৈরির চেষ্টা করে। যেটার পরিচালনা করার পরিকল্পনা করা হয় লন্ডন থেকে। স্যর কার্ডোগান ১৯৩৫ সালে মে-তে হাউস অব কমন্সে বলেন, ‘‘নাগাস হ্যাড আ ভেরি শ্রুড সাসপিশন দ্যাট সামথিং ইজ বিয়িং ডান টু টেক অ্যাওয়ে ফ্রম দেম দেয়ার ইমমোরিয়াল রাইটস অ্যান্ড কাস্টমস।’’ এর ফলে নাগারা পরিপূর্ণ ভাবে ভারত বিরোধী মনোভাব পোষণ করতে শুরু করেন।

Advertisement

শেষ ব্রিটিশ ডেপুটি কমিশনার পজি-র (১৯৩৭-৪৭) তত্ত্বাধানে ১৯৪৫ সালের এপ্রিল মাসে গঠন করা হয় ‘নাগা হিলস ডিস্ট্রিক্ট ট্রাইবাল কাউন্সিল’। এটি ১৯৪৬ সালে ‘ওখা’ তে নাগা ন্যাশনাল কাউন্সিল (এনএনসি) নামে পরিচিত হল। এটিই নাগাদের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন। তারা চাইল স্বায়ত্তশাসন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং প্রধানমন্ত্রী নেহরুও চাইলেন উত্তর-পূর্ব ভারতের আদিবাসীদের জন্য একটা আলাদা নীতি তৈরি হোক। কিন্তু এই সময়ে ১৯৪৭ সালের জুনে বার্মা (এখন মায়ানমার) থেকে আনগামি জিফু ফিজো এসে জানালেন, ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাগা হিলস আর ভারতের অংশ থাকবে না।

এই ব্যাপারটি ভারতের গণপরিষদে আলোচনার পরে ২০ মে ১৯৪৭ সালে কোহিমাতে ‘বরদোলই সাব কমিটি’ তৈরি করা হল। কিন্তু এনএনসি ভারতীয় আইনের ৬ নম্বর তালিকাভুক্ত স্বায়ত্তশাসন সম্বন্ধীয় ধারাটি প্রত্যাখ্যান করে ১৯৪৭ সালে ১৪ অগস্ট নাগাল্যান্ডকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করল। এই ঘোষণা পত্রে ২৯ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র ৯ জন সই করেন। রাতারাতি ফিজো নাগাদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এবং খুব দ্রুত ভারত বিরোধী চরমপন্থী কার্যকলাপ শুরু হয়ে যায়। ১৯৪৮ সালে ৯ জুলাই ফিজো কে গ্রেফতার করে কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে পাঠানো হয়। এই সময় নরী রুস্তমজি অসমের গভর্নরের উপদেষ্ঠা ছিলেন। তাঁর অনুরোধে ফিজোকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৫০ সালে ১১ ডিসেম্বর এনএনসি-র নির্বাচনে ফিজো সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন এবং ১৯৫১-’৫২ সালের ভারতের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন বয়কট করেন। ভারত এই সময় নাগাল্যান্ডের তিনটি জেলা (‘মন’, ‘তুয়েনসাং’ এবং ‘জুনেবটো’) এনইএফএ-র ৬ নম্বর ফ্রন্টিয়ার ডিভিশনের সঙ্গে যুক্ত করে দেয় (নাগা হোহো ডকুমেন্ট ২০০১).

১৯৫৩ সালে এনএনসি সদস্যদের বিরুদ্ধে কড়া হয় ভারত সরকার। দমনমূলক নানা আইন প্রয়োগ শুরু হয়। ১৯৫৫ সালে ‘অসম ডিসটার্ব অ্যাক্ট’-এর ধারায় নাগালান্ডে ভারতীয় সেনা ঢোকে। ২২ মার্চ ১৯৫৬ সালে এনএনসি, ফেডারেল গভর্নমেন্ট অব নাগাল্যান্ড (এফজিএন) গঠন করে নিজস্ব পতাকা উত্তোলন করে সমান্তরাল সরকার চালানোর উদ্যোগ নেয়। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই এনএনসি দু’টি ভাগে ভেঙে যায়। এদের মধ্যে চরমপন্থী দলের নেতা ছিলেন ফিজো। আর নরমপন্থী দলের কর্ণধার ছিলেন ফিজোর শ্যালক টি সাখিরে। চরমপন্থীরা সংখ্যায় কম থাকলেও পেশিশক্তি প্রয়োগে পিছিয়ে ছিল না। এক দিকে ভারতীয় সেনার দমননীতি, অন্য দিকে এই দুই গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বে প্রতিনিয়ত রক্তক্ষয় হতে থাকল। সাধারণ গ্রামবাসীদের জীবন এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দিল। সামান্য সন্দেহের বশে পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হতে থাকল। প্রায় সব গ্রাম পুরুষ শূন্য হয়ে পড়ল। স্বাধীনতার নামে এই বৈপ্লবিক চিন্তাধারার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ল কম বয়সী নাগাদের একাংশ। পুলিশের পোস্ট এবং থানায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হতে থাকল। সরকারি কর্মচারী অপহরণ, যাত্রীবাহী বাসের হাইজ্যাক, সেনাবহরের উপরে অতর্কিত হামলা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে উঠল। অন্য দিকে, অভিযোগ ওঠে, ভারতীয় সেনাও বিনা প্ররোচনায় বিপ্লবী বা আতঙ্কবাদী বলে সাধারণ গ্রামবাসীদের হত্যা করছে। ১৮ জানুয়ারি ১৯৫৬ সালে টি সাখিরেকে ফিজো-র দল অপহরণ করে জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করল।

তীব্র রক্তক্ষয়ের মধ্যে শান্তির জন্য সাধারণ গ্রামবাসী মরিয়া হয়ে উঠলেন। ১৯৫৭ সালে ২২-২৬ অগস্ট ‘কোহিমা’য় খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের চেষ্টায় এক মহাসভার আয়োজন করা হল। কিন্তু চরমপন্থীরা এতে অংশগ্রহণ করলেন না। ১৯৫৮ সালে ‘মককচুং’ শহরে দ্বিতীয় মহাসভা আয়োজিত হল। এই সভার পরে ১৬টি প্রস্তাব নিয়ে সভার উদ্যোক্তারা ভারত সরকারের দ্বারস্থ হলেন। দু’পক্ষের মধ্যে কথা শুরু হল।

ফিজো এই দ্বিপাক্ষিক এই আলোচনা মেনে না নিয়ে নাগাল্যান্ড ছেড়ে স্থায়ী ভাবে লন্ডনে বসবাস শুরু করে দিলেন। একই সঙ্গে ভারত সরকার বিরোধী কার্যকলাপের ইন্ধন যোগাতেও থাকলেন। শুরু হল চিন এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগ্নেয়াস্ত্র আনা এবং নতুন করে সংঘর্ষকে জাগিয়ে তোলা। ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ তে ট্রানজিশনাল প্রভিশনাল রেগুলেশন অ্যাক্ট-এর ধারায় ৪২ জন সদস্য সন্মিলিত পাঁচ জনের এক কার্যনির্বাহী পরিষদ গঠন করে। সরকার ‘রাজ ক্ষমা’ ঘোষণা করল। কিন্তু কোনও বিদ্রোহী এতে সাড়া দিলেন না। তবে আলোচনা থেমে থাকল না।

অবশেষে ১৯৬৩ সালে পয়লা ডিসেম্বের বর্তমানের নাগাল্যান্ডের জন্ম হল ভারতের ১৬ তম রাজ্য হিসেবে।

প্রাক্তন অধ্যক্ষ, বিধানচন্দ্র কলেজ আসানসোল

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement