অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস
হ্যাপ্পি বেঙ্গলি নিউ ইয়ারের কাব্য-ন্যাকামিকে অন্তত এ বছরের মতো ছুটি দেওয়া হোক। সারা বছর ম্যাক্সি আর জিন্স পরে, 'আমার ছেলেটা বেঙ্গলিতে বড্ড উইক' বলে পাড়া মাথায় করবার পর হঠাৎ পয়লা বৈশাখে আলমারি থেকে সুন্দর সুন্দর শাড়ি আর আগুল্ফ-লম্বিত বাসন্তী পাঞ্জাবি টেনে বার করে 'বৈশাখ হে মৌনী তাপস' গাইবার বিড়ম্বনা থেকে এবার অন্তত মুক্তি পাক পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি। কেননা পয়লা বোশেখ তো এবার 'বসন্তের আবেশ-হিল্লোলে পুষ্পদল চুমি' আসেনি; এসেছে 'রথচক্র ঘর্ঘরিয়া বিজয়ী রাজসম গর্বিত নির্ভয়'। তার সেই বজ্রমন্ত্রের অর্থ অবশ্য বুঝতে পারেননি সেদিনকার সেকেলে কবি, তবু না-বুঝেই বলেছিলেন 'জয় তব জয়।'
একেলে আমরা ইন্টারনেট-টিন্টারনেটের দৌলতে অনেক কিছু বুঝে ফেলেছি, তাই আমরা জানি আসলে নব-কিরীটি নামক এই দুঁদে ভাইরাসটি একটি আনকনশাস টুল অব হিস্ট্রি। গত একশো বছরে যা ঘটেনি, তাই এবার ঘটেছে। নব-কিরীটি ঘাড়ে রদ্দা কষিয়ে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, কে দোস্ত, কে দুশমন। অন্যের ঘাড় ভেঙে খাওয়া ছাড়া ভাইরাসদের আর কোনো কাজ নেই। যখন তারা অন্যের ঘাড় ভেঙে বংশবিস্তার করে না, তখন তারা আধ-জ্যান্ত কণা বই আর কিছু নয়। কিন্তু যে-মুহূর্তে শাঁসালো কোনো কোষের ঘাড় ভেঙে তার নিউক্লিয়াসে ঢুকে পড়ল, অমনি তাদের আর ঠেকায় কে। কোষের মূল মালিকদের বুকের ওপর বসে, তাদেরই দাড়ি উপড়ে জ্যামিতিক হারে ছানাপোনা বানিয়ে খাবারদাবার সব হজম করে ফেলে; কখনও কখনও মূল মালিকের এন্তেকাল উপস্থিত হওয়া অব্দি চলে সে-শোষণ। তাই দিকেদিকে আজ স্লোগান উঠেছে: দূর হোক যত পরজীবী।
নব কিরীটির কল্যাণেই মরি মরি, কী দেখিলাম। সমস্ত ধর্মস্থান হয় বন্ধ, নাহয় সংক্রমণের আখড়া বলে নিন্দিত। 'আল্লা কালী জিশুর দিব্য' বলে কোনও ব্যাটার হিম্মত হল না বলে যে, এই স্থান পরমেশ্বরের পূত লীলাভূমি, এ স্থানে অপবিত্র ভাইরাসদের প্রবেশ নিষেধ। অর্থাৎ পরজীবীদের মধ্যে ভাইরাসদের পরেই যাদের নাম কুচকুচে কালো হরফে লেখা হয়ে গেছে, তারা হল ধর্মজীবী। তারা হয় অপ্রয়োজনীয়, নাহয় ক্ষতিকর। বিশ্ব জুড়ে কী বেয়াক্কেলেপনারই-না নিদর্শন রাখলেন তাঁরা।
অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস
হিন্দুরা এই বাজারে রামনবমী করলেন। খাস কলকাতায়— বেলেঘাটায়, মানিকতলায়। গিরিশ পার্কের কাছে রাম মন্দিরে। উত্তর প্রদেশের যোগী-মুখ্যমন্ত্রী জানালেন, নব-কিরীটির হাত থেকে রামলালাই বাঁচাবেন। অযোধ্যা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট, যিনি আবার রাম মন্দির নির্মাণ কমিটিরও সদস্য, তিনি ১৬ মার্চ বললেন, ‘‘এটা তো ঐতিহ্যর অঙ্গ। আমরা সাবধানতা নিশ্চয়ই অবলম্বন করব, কিন্তু তাই বলে রাম নবমী মেলা বাতিল কখনওই করব না। গত এক মাস ধরে জেলা প্রশাসন এর জন্য কত প্রস্তুতি নিয়েছে।’’ গোমূত্র-টোমূত্রর কথা তুলে নববর্ষকে আর অপবিত্র না-ই করলুম।
ওদিকে ইন্দোনেশিয়া-পাকিস্তান-ভারত জুড়ে মুসলমানরা আন্তর্জাতিক তবলিগি পরব করে কাণ্ডজ্ঞানহীনতার নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করলেন। পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধর্মপ্রচারক, ঘনিষ্ঠ ইমরান-বান্ধব মৌলানা তারিক জামিল-এর মতে সৌদি আরবের আজোয়া-খেজুর নাকি সর্বরোগহর। দেখা যাক ইমরান সাহেব এই খেজুরে পথেই নব-কিরীটিকে কুপোকাত করেন কি না। ক্রিকেটজগতের নয়নের মণি, অক্সনিয়ান ইমরান খানের সঙ্গে আমাদের বর্তমান শাসকদের এক জায়গায় খুব মিল। তিনিও ঘোর ডারউইন-বিরোধী। তাঁর মতে, প্রাকৃতিক নির্বাচন-টির্বাচনের মতো গাঁজাখুরি তত্ত্ব দিয়ে ডারউইন মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে নষ্ট করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি অবশ্য তাঁর প্রভুপাদ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্ররই পথানুসারী। আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের মৌলবাদী খ্রিস্টানরা তো বহুকাল ধরেই ইস্কুলে ডারউইন পড়ানোর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন। তা নিয়ে মামলাও করেছেন। আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের কোথাও কোথাও নাকি ডারউইনের তত্ত্ব পড়াবার পাশাপাশিই বাইবেলের জেনেসিস পড়ানো আবশ্যিক।
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস
ইরানও এক তিক্ত শিক্ষা লাভ করেছে। ঢের দেরিতে তাদের ধর্মকর্তারা বোঝেন যে, কোম এবং মশাদ-এ তীর্থযাত্রী ঢুকতে দিয়ে তাঁরা এক পর্বতপ্রমাণ ভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। সে-অনুমতি অবশ্য পরে তুলে নেওয়া হয়েছিল। ততদিনে ইরানে ৩০০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন, আর সীমানা পার হয়ে সে-অসুখ পাকিস্তান আর আফগানিস্তানেও ছড়িয়ে পড়েছে।
সবথেকে করুণ হচ্ছে, পোপ ফ্রান্সিসের দশা। ভাটিকানে এক গা-ছমছম করা শুনশান চকের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি তামাম বিশ্বের কাছে আহ্বান জানালেন, যেন এই নব-কিরীটি বিশ্বমারি একটা ঐক্য ও সংহতির পরীক্ষা হয়ে ওঠে। অনেক খ্রিস্টান আবার ভাবতে শুরু করেছেন, এই গুঁতো দিয়ে ঈশ্বর তাঁদের বলছেন, আমাকে যদি ডাকতেই হয়, তার জন্য এত বিশাল বিশাল চার্চ বানানোর কী প্রয়োজন? এত ঘটার-ই বা কী প্রয়োজন? আর এর জন্য কী বিপুল টাকা খরচ হয়, ভেবে দেখেছ, বৎসগণ? ভারতের হিন্দু মন্দিরগুলো নিয়ে একই প্রশ্ন তুলেছে আমাদের দেশের এক বালক— ঠিক কত কিলো সোনা মজুত আছে মন্দিরগুলোতে?
আরও পড়ুন: ‘বলছিলুম কি, সাল পয়লার দিনে এট্টুখানি কাঁচা আমের চাটনি হবে তো?’
অথচ গরিব দেশ ভিয়েতনামে এখনও একজনকেও মারতে পারেনি নবকিরীটি। কারণ সেই জানুয়ারি মাস থেকেই তারা তেড়েফুঁড়ে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছিল। আর কিউবা? আরেক গরিব দেশ? সে তো এ লড়াইয়ের একেবারে সম্মুখসারিতে। ইন্টারফেরন আলফা-২ বি নামে এক ওষুধও নাকি তারা বার করেছে, যা চিনে ব্যবহার হয়েছে। সত্যিমিথ্যে জানি না। কিন্তু এটুকু জানি, এই দুটো দেশেই ধর্মকর্ম নিয়ে আদিখ্যেতা বেশ কম।
তাহলে কী দাঁড়াল? কিরীটি সমস্যার সমাধান করা তো দূরের কথা, যেসব প্রতিষ্ঠান ওই ভাইরাসের বংশবিস্তারে বিশেষ সাহায্য করেছে তাদের অন্যতম হল ধর্ম। এ জিনিসে আমাদের কী প্রয়োজন? আচার্য আবদুস সালামের প্রিয় ছাত্র, পাকিস্তানের বিখ্যাত পরমাণু-বিজ্ঞানী পারভেজ হুডভয় চমৎকার লিখেছেন, ‘‘এমনকি অতি-রক্ষণশীলরাও, বিজ্ঞানকে যারা বাতিল করে দিয়েছে সেইসব বিশ্বনেতারাও, এখন নতজানু হয়ে বিজ্ঞানীদের কাছে প্রার্থনা করছে, যাতে উদ্ধারকাজ ত্বরান্বিত হয়। মুখে তারা যতই ধর্মবিশ্বাসের কথা বলুক, যতই ট্যাং ট্যাং করে বাসনপত্র বাজাবার কথা বলুক আর বারান্দা থেকে হাততালি দেওয়ার ডাক দিক, শেষ পর্যন্ত তারা করোনা ভাইরাস-প্রতিরোধী ভ্যাকসিন আর ওষুধের জন্যই সওয়াল করতে বাধ্য হচ্ছে। ধাপ্পাবাজি, গলাবাজি আর কাঁসর-ঘণ্টা-বাজির একটা সীমা তো কোথাও আছে।’’
আরও পড়ুন: অনলাইনে পয়লা বৈশাখ বাঙালি চালু করলেই পারে!
নব-কিরীটি ভাইরাস এসে আমাদের বুঝিয়ে দিল, বিজ্ঞানই মানুষের শ্রেষ্ঠ আশ্রয়, 'বিপদের দিনের বন্ধু।' আর পরজীবী কারা, তাও জলের মতো পরিষ্কার। পৃথিবীর যেখানে যত ধর্মস্থান আছে, মানুষের ঘাড় ভাঙা ছাড়া যাদের আর কোনো কাজ নেই, সেগুলোই পরজীবী। এটা এখন আর তত্ত্বকথা নয়, চোখে-দেখা বাস্তব।
জয় বাবা নব কিরীটি! যদি বেঁচে থাকি, তোমারই প্রতিমা গড়ব মন্দিরে মন্দিরে। তোমার চেহারাখানি তো একেবারে নবকার্তিকের মতো। কুমোরটুলির শিল্পীরা নিশ্চয়ই এখন থেকে মডেল বানিয়ে রাখছেন। দেখো বাবা, তোমাকে যেন অসুর না বানিয়ে ফেলে।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)