এই ভারতে, পুনরাগমনায় চ?

ভারতে বধূহত্যা একটি গুরুত্বপূর্ণ— শোচনীয়ও বটে— স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যা, যা বছরের পর বছর চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েই চলেছে।

Advertisement

চৈতালী চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০১৯ ০০:২০
Share:

কাকে বলব পুনরাগমনায় চ! কোন প্রতিমাকে আদর করে ‘এসো মা’ ডাকব, এই নারীধর্ষণ নারীহত্যা ও কন্যাভ্রূণহত্যার দেশে! দেবীর অসম্মান লাগে না তাতে?

Advertisement

তথ্য অনুযায়ী যা-যা অপকর্ম ঘটে চলেছে, সে তালিকার চতুর্থ স্থানে ধর্ষণ জ্বলজ্বল করছে। এও জানি, এই দেশে ধর্ষণের যে-ছবি খাতায় কলমে ফুটে ওঠে তার বাইরেও অজস্র ধর্ষণ হয়ে থাকে শহরে বা প্রত্যন্ত গ্রামেগঞ্জে, দরিদ্র বা বর্ধিষ্ণু পরিবারগুলিতে।

একই সঙ্গে আমরা জানি, ভারতে বধূহত্যা একটি গুরুত্বপূর্ণ— শোচনীয়ও বটে— স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যা, যা বছরের পর বছর চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েই চলেছে। পিত্রালয় থেকে চাহিদা মতো পণ দিতে না পারার জন্য মেয়েদের বিয়ের পর হত্যা করার পরিসংখ্যান একটি সূত্র অনুযায়ী ১৯৮০’তে ছিল ৪০০ জন, ১৯৯০’তে সেই সংখ্যা বেড়ে ৫৮০০ জন। প্রতি বছর পুলিশ কম করে ২৫০০টি বধূহত্যার অভিযোগ পায়। বলা হয়েছে, পণজনিত বধূহত্যার ৫৮২৪টি কেস থানায় ঝুলে আছে। এ ছাড়াও, অনথিভুক্ত, লুকোছাপা দিয়ে রাখা দুর্নীতি, পরিবারের পুরুষদের চরিত্রদোষের খবর জেনে-যাওয়ার অপরাধে বৌয়ের মুখ জন্মের মতো বন্ধ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া তো জারি থেকেই যায়!

Advertisement

কন্যাভ্রূণ-হত্যার ফলে সারা দেশে হুহু করে, পুত্রসন্তানের তুলনায় কন্যাসন্তান জন্মের হার কমছে, এখনও। ইতিমধ্যে প্রি-কনসেপশন অ্যান্ড প্রি-নেটাল ডায়াগনস্টিক টেকনিক্স আইনে জন্মের আগে মায়ের গর্ভস্থিত ভ্রূণের লিঙ্গনির্ধারণ নিষিদ্ধ হলেও সকলের চোখের সামনে এই নির্ধারণপ্রক্রিয়া চলছে ধরে নিতে পারি। না হলে উত্তর ও পশ্চিমের রাজ্যগুলিতে ছেলেমেয়ের অনুপাত আজ যা দাঁড়িয়েছে, তা হতে পারত না। তবে, এই পদ্ধতি কার্যকর না হলে, সদ্যোজাত শিশুকন্যার আর আলো না দেখার ব্যবস্থা করা তো খুব পরিচিত। এমনকি দুর্গাপুজোর সপ্তাহেও তো শুনলাম আছাড় দিয়ে তিন মাসের কন্যাকে মেরে ফেলার খবর।

আর, কী বলি, অনার কিলিং নিশ্চয় কন্যাবিদ্বেষ থেকে আসে না! নিশ্চয় পরিবারের সম্ভ্রম, আব্রু, মর্যাদা ইত্যাদিই এখানে আসল ঘটনা, যা রক্ষার জন্য বাড়ির মেয়েকে ঘটনাচক্রে বলি হতে হয়!

ধরা যাক, একটি মেয়ে পারিবারিক বা তাদের এলাকার প্রথা ভেঙে, বিয়ে না করে লেখাপড়া শিখে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাটুকু পেতে চায়। বৌ, বৌমা, মা হয়ে বেঁচে থাকার পাশাপাশি একটা আত্মপরিচয় চায়। ধরা যাক, একটি মেয়ে, পরিবারের বেঁধে-দেওয়া পাত্রকে অস্বীকার করে নিজের পছন্দমতো কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে চায়। হয়তো সেই ছেলেটির জাতধর্ম আলাদা। ধরা যাক, একটি মেয়ে শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার আর নিতে না পেরে, নিজেই চলে আসে পিত্রালয়ে, কিংবা তাকে ফিরিয়ে দিয়ে যাওয়া হয়। এই সব ক্ষেত্রে অনার কিলিং চলতে পারে, কেননা তা ‘অনার’-এরই প্রশ্ন। পরিবারের মুখ উজ্জ্বল রাখা মেয়েটির স্বাভাবিক জীবনাদর্শ। ফলে মেয়েটিকে চুপিসারে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে, থানায় মিসিং ডায়েরি করলেই হয়। কিংবা মেয়েটিকে বিষ খাইয়ে, গলায় দড়ি দিয়ে মেরে ফেললেও হয়। গত তিন বছরে নাকি তিনশোরও বেশি অনার কিলিংয়ের কেস উঠে এসেছে।

কিন্তু তবু, দেবীকে জলে ভাসিয়ে পুনরাগমনায় চ বলতে এক বারও গলা কেঁপে ওঠে না সকলের। পৃথিবী এক অনন্ত হত্যাশালা, আমরা জানি। কিন্তু মেয়েদের নিধনের ক্ষেত্রে সেই হত্যার স্ফূর্তি সমানেই বেড়ে-বেড়ে চলে। এবং আরও নৈঃশব্দ্য জাত হয় সেই স্ফূর্তিকে ঘিরে। আধুনিক পৃথিবী নিঃশব্দে আয়োজন করছে মেয়েদের নিধন, আর উদ্‌যাপন করে চলেছে সেই নিধনের আনন্দ। একটি মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে ক্রমাগত অবজ্ঞা, অপমান, অবহেলা (হয়তো সূক্ষ্ম ভাবে, বিদগ্ধ উপায়েও বটে) পেতে পেতে, বৈধ তবু অনিচ্ছাকৃত যৌনসম্ভোগের নিয়মিত শিকার হতে হতে খাদের কিনারায় চলে আসে। হালকা বিষক্রিয়ার মতো এই হত্যাপদ্ধতি।

তাই বলছিলাম— মাতৃশক্তির আরাধনা আসে যায়, কিছু কথা থেকে যায়, বড় মেয়েলি। একটি পুজোমণ্ডপে গিয়ে শুনি মেয়েদের সহর্ষ ঘোষণা, মেয়েরাই এ বার পুজো করবে। পুজোকমিটির মেয়ের করুণ স্বগতোক্তি কানে আসে, বাপ রে! বাড়ির উনকোটি কাজ সামলে তার পর ঠাকুরের কাজ, চাট্টিখানি কথা! আর এ সব শুনতে শুনতে শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা, অকালবোধন তত্ত্ব, দুর্গার আরও নানাবিধ রূপ ছেড়ে, আমার ইচ্ছে হয়, এই পাঁচ-পাঁচটা দিন মা দুর্গার মহিষাসুরমর্দিনী, রণচন্ডী রূপটি চোখ ভরে দেখার। যে রূপ দেখে মেয়েরা হয়তো এক ধরনের প্রত্যয় অনুভব করে। দেবীর অদৃশ্য হুঙ্কার ও অট্টহাসি মনে-মনে শুনে নিয়ে, পরিবারে মেকুর হয়ে বেঁচে-থাকা মেয়েটিও হয়তো নড়েচড়ে ওঠে!

মাতৃশক্তিপূজায় পাগল হয়ে যাচ্ছে মানুষ, দিগ্বিদিকে ঢাকঢোল পেটানো হচ্ছে। এই কয়েকটি দিনকে আমরা স্টেজ রিহার্সাল হিসেবে মনের মধ্যে এঁকে নিতে পারি না কি, সংবৎসর ঘরে বাইরে মেয়ে বৌদের মান দেব বলে!

শুনলাম, ১১ অক্টোবর নাকি কন্যাদিবস ছিল। সত্যি। এক বিপুল তামাশা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement