দরিয়াপুরে বঙ্কিমচন্দ্রের স্মৃতি। নিজস্ব চিত্র
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মেদিনীপুরের সম্পর্ক খুব কমদিনের নয়। উত্তরাধিকার এবং কর্ম, দুই সুতোতেই গাঁথা। উনিশ শতকের চারের দশকে কর্মসূত্রে বেশ কিছুদিন মেদিনীপুর শহরে ছিলেন বঙ্কিমের বাবা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। দারোগা যাদবচন্দ্র ১৮৪৩ সালের ৬ নভেম্বর ডেপুটি কালেক্টর হয়ে সপরিবারে মেদিনীপুরে আসেন। তাই বঙ্কিমের শৈশবের অনেকখানি কেটেছে মেদিনীপুরে। পাঁচ বছরে তাঁর হাতেখড়ি হয়েছিল এই শহরে। হাতেখড়ির দিনই তিনি নাকি বাংলা বর্ণমালা পুরোটা মুখস্থ করে ফেলেন! ছাত্রাবস্থার গোড়ার দিনগুলিও কেটেছিল এখানেই।
বঙ্কিমের ছাত্রজীবন নিয়ে খুব বেশি জানা যায় না। ভাই পূর্ণচন্দ্র ও ভ্রাতুষ্পুত্র শচীশচন্দ্রের লেখা থেকে জানা যায়, খাতায়-কলমে স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই দাদা সঞ্জীবচন্দ্রের সঙ্গে তিনি মাঝে মধ্যে মেদিনীপুর জিলা স্কুলে (পরে কলেজিয়েট স্কুল) যেতেন। হেডমাস্টার এফ টিড সঞ্জীবচন্দ্রের কাছে ভাইয়ের বর্ণমালা-শিক্ষার খবর জানতে পেরে, বঙ্কিমকে ভর্তি করে নেন। বালক বঙ্কিম শিক্ষকদের মন জয় করে নেয়। বিশেষত টিড সাহেবের। টিড সাহেব নিজের বাড়িতে তো বটেই, ডেপুটি কালেক্টরের বালক পুত্রটিকে তিনি নিয়মিত ম্যাজিস্ট্রেটের কুঠিতেও নিয়ে যেতেন। মালেট তখন মেদিনীপুরের ম্যাজিস্ট্রেট। একদিন হঠাৎই মালেটের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দেয় বালক বঙ্কিম। শোনা যায়, একদিন সাহেবের বাড়িতে বঙ্কিম যখন অন্য ছেলেদের সঙ্গে ব্যস্ত, তখন বাংলোর মাঠে চায়ের আসরের প্রস্তুতি চলছিল। এক সাহেব সকলকে ডাকলেও কোনও কারণে বঙ্কিমকে ডাকেননি। বঙ্কিম তখনই ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়ি ছাড়েন। আর তাঁকে ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়ি পাঠানো যায়নি। এ নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট নাকি যাদবচন্দ্রের কাছে আক্ষেপ করেন।
শচীশচন্দ্রর লেখা থেকে জানা যায়, স্বভাব-গম্ভীর বঙ্কিম প্রায় কখনওই অন্য ছেলেদের সঙ্গে খেলতেন না। এমনকি দর্শক হিসেবেও না। স্কুল ছুটির পর নাকি সমবয়সি বন্ধুদের নিয়ে তাস খেলতে বসে পড়তেন। তাঁর তাসের নেশা হুগলি কলেজে ভর্তি হওয়ার পরও কাটেনি। শচীশচন্দ্র স্কুলের একটি বিশেষ ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। স্কুলের সামনের রাস্তায় একবার এক ‘খোট্টা’ ডুগডুগি বাজিয়ে একটি বাঁদর নিয়ে চলেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র ডেবরার বাসিন্দা এক সহপাঠীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন বাঁদর-খেলা দেখতে। সুরসিক বঙ্কিম নাকি সহপাঠীকে বলেছিলেন, ‘বাঁদরটাকে এনে আমাদের কেলাসে ভর্ত্তি করে দিলে হয়; দেখি ইংরাজি শিখতে পারে কিনা’। কিন্তু বাঁদরখেলা দেখা শেষ করে স্কুলে ফিরলে শিক্ষকেরা বকাঝকা করেন। এই স্কুলে বঙ্কিমচন্দ্র তিন বছর পড়েছিলেন। ১৮৪৭ সালে মেদিনীপুর ছেড়ে হুগলি মহসীন কলেজে ভর্তি হন। যাদবচন্দ্র এই সময়ই মেদিনীপুর ছেড়ে চলে যান চব্বিশ পরগনায়। মেদিনীপুর শহরের সঙ্গে কিশোর বঙ্কিমের আবার যোগাযোগ হয় ৪০ বছর পর। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার ঠিক আগে। ১৮৮৭ সালের মে মাসে বঙ্কিম মেদিনীপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং ডেপুটি কালেক্টর পদে যোগ দেন। এবারে ছিলেন মাত্র ছ’মাস। এই সময়পর্বেই তাঁর শেষ উপন্যাস ‘সীতারাম’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
কিন্তু মেদিনীপুর জেলার সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র যোগ কখনওই পুরোপুরি ছিন্ন হয়নি। চাকরিসূত্রে দাদাদের মতো বঙ্কিমচন্দ্রও বেশ কিছুকাল এই জেলায় কাটান। ১৮৬০ সালের জানুয়ারিতে তিনি এলেন কাঁথির কাছে তৎকালীন নেগুয়া মহকুমার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হয়ে। নভেম্বরে বদলি হয়ে চলে গেলেন খুলনায়। কিন্তু এই দশ মাসের মেদিনীপুর-বাস বঙ্কিম-সাহিত্যে চিরস্থায়ী স্বাক্ষর রেখে যায়। নেগুয়া-কাঁথি মিলিয়ে দু’জায়গার বাংলোতেই তিনি থেকেছেন। উল্লেখ্য, তখনও তিনি স্বনামধন্য সাহিত্যিক নন, শুধুমাত্র সরকারি চাকুরে। যদিও তাঁর বাবা প্রশাসক হিসেবে এই এলাকায় জনপ্রিয় ছিলেন। যাদবচন্দ্র মেদিনীপুরের ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে একাধিকবার নেগুয়া-কাঁথিতে আসেন। বাসিন্দাদের জলকষ্ট দূর করতে একাধিক পদক্ষেপ করেন। বঙ্কিম-সুহৃদ শ্রীশচন্দ্র মজুমদার একথা উল্লেখ করেছেন। ১৩২৫ বঙ্গাব্দে কাঁথি থেকে প্রকাশিত ‘নীহার’ পত্রিকায় যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাব্য-প্রশস্তি ছাপা হয়। কাঁথি-নেগুয়ার স্থানীয় ইতিহাসে প্রশাসক বঙ্কিমের গুরুত্বও খুব কম নয়। পূর্ব মেদিনীপুরের অন্যতম প্রাচীন স্কুল, কাঁথি হাইস্কুলের জমিটি বঙ্কিমই স্কুল কর্তৃপক্ষকে দান করেন।
এই সময় সরকারি মামলা মোকদ্দমার কাজে একাধিকবার বঙ্কিমকে নেগুয়া ছেড়ে কাঁথি আসতে হয়েছে। সেই সময়ে তিনি উকিল বারাণসী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে কাটিয়েছেন। বাড়িটি ১৯৩৩ সালে আগুনে পুড়ে যায়। এই বাড়ির কাছের একটি পুকুর কৃষ্ণকান্তের পুকুর নামে খ্যাত। স্থানীয় বাসিন্দারা আজও মনে করেন, এটিই ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এর বারুণী পুষ্করিণী। বঙ্কিমের স্মৃতিতেই বাড়ির সংলগ্ন রাস্তাটির নাম হয়েছে ঋষি বঙ্কিম সরণী। এবং সেখানে বসানো হয়েছে বঙ্কিমের মূর্তি।
‘যুগলাঙ্গুরীয়’ উপন্যাসের প্রেক্ষাপটও মেদিনীপুর। আসলে প্রাচীন তাম্রলিপ্ত। তিনি যে সময়ে নেগুয়ায় ছিলেন, সেই সময়েই তাঁর অগ্রজ শ্যামাচরণ তমলুকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। সেই সময় তিনি কিছুদিন কাটিয়েছিলেন তমলুক রাজবাড়ির উদ্যানে। ভ্রাতুষ্পুত্র শচীশচন্দ্রের মতে, এই বাড়িটিই পনেরো বছর পর ‘যুগলাঙ্গুরীয়’র পটভূমি হয়ে উঠেছিল।
আরও একটি উপন্যাসে বঙ্কিমের প্রত্যক্ষ ভাবে কাঁথিবাসের স্মৃতি রয়ে গিয়েছে। তা ‘কপালকুণ্ডলা’। এ নিয়ে বিভিন্ন গল্প প্রচলিত। নেগুয়া বা কাঁথি থেকে সেই সময় গভীর রাতে সমুদ্রের গর্জন শোনা যেত। বিপত্নীক বঙ্কিম তখন একা কুঠিতে। শচীশচন্দ্র লিখেছেন, সমুদ্রের সেই ‘রোদনে তিনি আপন হৃদয়ের প্রতিধ্বনি শুনিতেন’। এইরকমই এক রাত্রে তাঁর কাছে আসেন এক কাপালিক। তিনি বঙ্কিমকে নিয়ে যেতে চান সমুদ্র-তীরের বালিয়াড়িতে। পরপর তিন রাত নাকি সেই কাপালিক আসেন। এবং বঙ্কিম তাঁকে প্রতিবারই বিদায় করে দেন। শচীশচন্দ্রই আরও একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। একবার কোনও কাজে তাঁকে গ্রামের এক জমিদারবাড়িতে থাকতে হয়েছিল। সেই রাতে নাকি হঠাৎই এক শুভ্রবসন মহিলা এসে উপস্থিত হন। ভীত, বিস্মিত বঙ্কিম ‘তুমি কে?’, ‘তুমি কী চাও?’ ইত্যাদি নানা প্রশ্ন করেন। কিন্তু কোনও উত্তর আসে না। খানিকক্ষণ পর সেই রহস্যময়ী বাগানের পথে বেরিয়ে যান। এই দুই ঘটনাই কাপালিক ও কপালকুণ্ডলা চরিত্র নির্মাণে সাহায্য করেছিল বলে অনেক প্রচলিত মতের একটি। লেখকের কল্পনায় চরিত্রগুলিকে তিনি নিয়ে ফেলেন সমুদ্রতীরবর্তী দরিয়াপুর এলাকায়। যেখানে একটি ডাকাতির মামলার তদন্ত করতে যেতে হয়েছিল তাঁকে।
কাঁথির কাছে দরিয়াপুর এলাকার বিগ্রহহীন একটি মন্দির কপালকুণ্ডলার মন্দির হিসেবে পরিচিত। মন্দির-সংলগ্ন এলাকাতেই তৈরি হয়েছে বঙ্কিম স্মৃতিস্তম্ভ। বসানো হয়েছে একটি আবক্ষ মূর্তি। প্রায় একশো বছর আগে স্থাপিত সেই স্মৃতিস্তম্ভে লেখা আছে ‘কপালকুণ্ডলার পরিকল্পনা ক্ষেত্র’। এখানেই তাঁর নামে গড়ে তোলা হয়েছে একটি স্থায়ী মঞ্চ। তাঁর স্মৃতিতে দরিয়াপুরে প্রতি বছর জাঁকিয়ে বঙ্কিম মেলা হয়। চলতি বছরই সেই মেলা শতবর্ষে পা দিয়েছে।
লেখক কাঁথি প্রভাতকুমার কলেজের বাংলার শিক্ষক