ছবি: সংগৃহীত
ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করিল। বহু আবেদনের পরে কেবল সীমান্তে আটকাইয়া থাকা পেঁয়াজের ট্রাকগুলি পাঠাইতে রাজি হইয়াছে কেন্দ্র। এই সিদ্ধান্ত দুর্ভাগ্যজনক। বাণিজ্যের সম্পর্কের ভিত্তি কেবল চুক্তি নহে, আস্থা। আগাম সতর্ক না করিয়া, অকস্মাৎ নিজ অঙ্গীকার হইতে সরিয়া আসিলে তাহার অভিঘাত আস্থার সম্পর্কের উপর পড়িতে বাধ্য। বাংলাদেশ ভারতের পেঁয়াজের সর্ববৃহৎ আমদানিকারী রাষ্ট্র। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানাইয়াছেন, তিনি পেঁয়াজহীন ব্যঞ্জন খাইতেছেন। হয়তো তাঁহার দেশবাসীর সমস্যার তীব্রতা কতখানি, তাহা ইঙ্গিতে বুঝাইতে নিজের দৃষ্টান্ত দিয়াছেন। বাংলাদেশের বাজারে জোগানের অভাবে ইতিমধ্যেই পেঁয়াজ অগ্নিমূল্য হইয়াছে। রফতানি বন্ধের সিদ্ধান্তের কী মূল্য ভারতকে চুকাইতে হইবে, সেই প্রশ্নও থাকিয়া যায়। পূর্বে ঘোষণা না করিয়াই রফতানি বন্ধ করিবার পরিণাম কী হইতে পারে, তাহার দৃষ্টান্ত পশ্চিমবঙ্গেই রহিয়াছে। ২০১৪ সালে আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে রাখিতে অন্যান্য রাজ্যে আলুর জোগান বন্ধ করিয়াছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। তাহার পরিণাম এই যে, অন্য রাজ্যগুলিতে আজও বাজার ফিরিয়া পায় নাই পশ্চিমবঙ্গের আলু। পরিবহণে সরকারি ভর্তুকি দিয়াও রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, বিহার, ওড়িশায় রাজ্যের আলুর চাহিদা পূর্ববৎ হয় নাই। ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড ক্রমশ আলু উৎপাদনে স্বনির্ভর হইয়া উঠিতেছে। প্রতিবেশীদের বিপাকে ফেলিলে তাহার ফল ভোগ করিতেই হইবে।
সংসদে যখন আবশ্যক পণ্য আইন সংশোধন করিল কেন্দ্র, সেই সময়েই অকস্মাৎ পেঁয়াজের রফতানি বন্ধ কি দ্বিচারিতা নহে? পেঁয়াজের উৎপাদন এই বৎসর কম হয় নাই, তবে অতিবর্ষণের জন্য কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত প্রভৃতি রাজ্যে পেঁয়াজ ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। তাহাতে পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম চড়িয়াছে। নভেম্বরে নূতন ফসলের জোগান মিলিবে। সেই পর্যন্ত দাম বাড়িতে থাকিবে, এবং তাহার প্রতিফলন হইতে পারে রাজ্য-রাজনীতিতে, সেই আশঙ্কায় কেন্দ্র রফতানি বন্ধ করিয়া দাম নিয়ন্ত্রণ করিতেছে। কৃষক সংগঠনগুলি প্রশ্ন তুলিয়াছে, তাহা হইলে আলু-পেঁয়াজকে অত্যাবশ্যক পণ্যের তালিকা হইতে বাহির করিয়া চাষির কী লাভ হইল? তাহারা কেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনিয়াছে। রাজ্যগুলিও অভিযোগ করিতে পারে, অত্যাবশ্যক পণ্য আইন সংশোধন করিয়া রাজ্যের ক্ষমতা খর্ব হইল কেবল। রাজ্য তাহার বাজার নিয়ন্ত্রণ করিয়া ক্রেতাকে সুরক্ষা দিতে পারিবে না। সেই ক্ষমতা কেন্দ্র কুক্ষিগত করিল। অপর কোনও পরিবর্তনই হইল না। যুদ্ধ হয় নাই, দুর্ভিক্ষও নাই, পেঁয়াজের দর এখনও অবধি নাগালের বাহিরে যায় নাই— তবু রফতানি বন্ধ হইল।
নরেন্দ্র মোদীরা যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রশ্নটিকে কখনও বুঝিতেই পারেন নাই, এই কথাটি এখন সংশয়াতীত রকম স্পষ্ট। সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র বন্ধুুভাবাপন্ন রাষ্ট্র বাংলাদেশের সহিত এহেন বিশ্বাসভঙ্গের কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া কী হইতে পারে, সরকারপক্ষ তাহা ভাবে নাই বলিয়াই অনুমান করা চলে। তাহাদের পাখির চোখ এখন বিহারের নির্বাচন। কিন্তু, যেখানে চিনের সহিত সীমান্ত সংঘাত তীব্রতর হইয়া উঠিতেছে, তখন দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে এক বিরল বন্ধু-রাষ্ট্রকে চটাইবার ঝুঁকি যে লওয়া চলে না, এই কথাটি মোদীদের বুঝাইবে কে?