রাজনীতিকদের উত্তরণের আকাঙ্ক্ষায় দোষের কিছু নেই

মমতার তত্ত্বে সিলমোহর?

গোটা দেশের চোখ ছিল ১১ ডিসেম্বরের দিকে। পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনকে পণ্ডিতরা অনেকেই বলেছিলেন, লোকসভা ভোটের সেমিফাইনাল।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

সমবেত: (বাঁ দিক থেকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, চন্দ্রবাবু নায়ডু, এইচ ডি দেবগৌড়া, রাহুল গাঁধী, সনিয়া গাঁধী। দিল্লি, ১০ ডিসেম্বর

গোটা দেশের চোখ ছিল ১১ ডিসেম্বরের দিকে। পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনকে পণ্ডিতরা অনেকেই বলেছিলেন, লোকসভা ভোটের সেমিফাইনাল। কথাটা ভুল কিছু নয়। কারণ বিশেষ করে হিন্দি বলয়ের হৃদিস্থল থেকে যে রায় উঠে আসে, জাতীয় রাজনীতিতে তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়ের ফলাফল দেখার পরে বিরোধীরা যতটা উৎসাহিত, বিজেপি ততটাই চাপে। এই চাপ বাড়িয়ে তুলে ফাইনালে যেতে হলে বিরোধী মঞ্চকে যথাসম্ভব মজবুত এবং প্রসারিত করার লক্ষ্য তাদের থাকবেই। সেই তৎপরতা পুরো দমে জারি রয়েছে।

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী-ঐক্য গঠনের উদ্যোগে এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তবে তাঁর ভূমিকা কতটা ‘প্রাধান্য’ পাচ্ছে, তা নিয়ে জল্পনার অন্ত নেই। বিভিন্ন মহলে এমন একটা ধারণা ঘুরে বেড়াচ্ছে যে, মমতাকে যতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে, আসলে তিনি তত গুরুত্বপূর্ণ নন। যাঁরা এই ধারণায় বিশ্বাস করেন, তাঁদের মতে, মমতা মনে মনে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে নাম লিখিয়েছেন বলেই নাকি বিরোধী-বৃত্তে তাঁর ‘ওজন’ কম! অর্থাৎ, তাঁরা ধরে নিয়েছেন, মমতা প্রধানত রাহুল গাঁধী এবং তৎসহ মায়াবতী (হয়তো চন্দ্রবাবুও) প্রমুখের প্রতিদ্বন্দ্বী। এবং সেখানেই যত গোল!

ধারণা যার যার নিজস্ব সম্পদ। কে কী ধারণা পোষণ করবেন, সেটা তাঁর ব্যাপার। যদিও ধারণা তৈরির ক্ষেত্রে চার পাশের আনুষঙ্গিক কিছু বিষয় অবশ্যই প্রভাব ফেলে। তাই মমতার দলের নেতা-কর্মীরা তাঁকে প্রধানমন্ত্রী দেখতে চান বলে আওয়াজ তোলার পরে ওই ধারণাটি হয়তো একটু পুষ্টি পাচ্ছে। সঙ্গে বিবিধ কটাক্ষও চলছে নানা স্তরে।

Advertisement

তৃণমূলের চাওয়ার মধ্যে অন্যায় কিছু নেই। যাঁরা চাকরি করেন তাঁরা উন্নতির প্রত্যাশী। রাজনীতির লোকেরাও যদি চলতে চলতে নিজেদের উপরের দিকে নিয়ে আসতে পারেন, অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, পরিশ্রম ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনসমর্থনের ভিত শক্ত করতে সক্ষম হন, তাঁদের উত্তরণের আকাঙ্ক্ষাও তো সঙ্গত। সংসদে মমতার অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিনের। তিনি বিভিন্ন সময় কেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন। রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রিত্ব করছেন সাড়ে সাত বছর। সর্বোপরি তাঁর জনসমর্থনের ভিত এবং রাজনৈতিক সাফল্য প্রমাণিত। জাতীয় রাজনীতির অন্য অনেক নেতার চেয়ে মমতার বায়োডেটা সে দিক থেকে তুলনায় উজ্জ্বল। সুতরাং সেই মমতাকে তাঁর দল প্রধানমন্ত্রী হিসাবে যোগ্য মনে করলে তাদের আবেগকে হেয় করা অনুচিত।

আবার তৃণমূলের ওই প্রত্যাশাকে দেশের অন্য বিরোধী দলেরা যদি খোলা মনে স্বাগত না জানায়, সেটাও খুব দোষের নয়। রাজনীতির খেলায় এটাই তো ‘বিধি’। মমতা দূরস্থান, রাহুল গাঁধীকে ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তুলে ধরার কথাও কি তামিলনাড়ুর স্ট্যালিন ছাড়া অন্য কোনও বিরোধী নেতার মুখে এখনও পর্যন্ত সোজাসাপ্টা শোনা গিয়েছে? না। বরং চন্দ্রবাবু থেকে শুরু করে সকলেই সচেতন ভাবে সেই উত্তর এড়িয়ে যাচ্ছেন। খোদ কংগ্রেসও এখন এ সব আলোচনায় নারাজ। আসলে জল মাপছেন সবাই। তার কারণও সহজবোধ্য।

তবে সেই প্রসঙ্গ আলোচনার আগে বলা দরকার, এই আবহেই বিরোধী নেতাদের মধ্যে যোগাযোগের নিরন্তর প্রক্রিয়া কিন্তু জারি আছে। সেখানেও মমতা রীতিমতো সক্রিয়। রাহুলের সঙ্গে তাঁর বার্তালাপ আগের থেকে অনেক বেড়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁরা ঘন ঘন এসএমএস-এ কথা বলেন। অন্য নেতাদের সঙ্গেও মমতার নিয়মিত কথা হয়। পাঁচ রাজ্যের ফলের পরে মায়াবতীর সঙ্গেও তাঁর সরাসরি কথা হয়েছে। কমল নাথ

ভোপালে তাঁর শপথের মঞ্চে মমতাকে হাজির করানোর জন্য বিশেষ বিমান পাঠাতে চেয়েছিলেন। একান্ত ব্যক্তিগত একটি কারণে মমতা অবশ্য সে দিন যেতে পারেননি।

কয়েক দিন আগে দিল্লিতে বিরোধী দলগুলির যে বৈঠক হয়, তাতে গুরুত্বপূর্ণ সবাই যাতে উপস্থিত থাকেন, তৃণমূল নেত্রীর তরফে সে জন্যও চেষ্টার কসুর ছিল না। যেমন, চন্দ্রবাবুর ফোনে মমতা জানতে পারেন অরবিন্দ কেজরীবাল নাকি আমন্ত্রণ রক্ষার প্রশ্নে দোনামোনা করছেন। তৎক্ষণাৎ কেজরীবালকে ফোন করে তিনি বলেন, ‘‘কে কী ভাবে আমন্ত্রণ করলেন, সে সব বিচার করবেন না। এটা কারও ব্যক্তিগত বিষয় নয়। আমাদের সকলের দায়িত্ব। দরকার হলে আপনি দিল্লিতে আমার বাড়িতে আসুন। আমরা একসঙ্গে যাব।’’ আবার উত্তরপ্রদেশের অখিলেশ

যাদবকেও ফোনে পরামর্শ দেন মমতা, ‘‘মায়াবতী যাতে এই শিবিরে থাকেন, তা যে কোনও মূল্যে নিশ্চিত করা দরকার। এই কাজে তোমাকে উদ্যোগী হতে হবে।’’

কিন্তু বিরোধী শিবিরে কংগ্রেসের অবস্থান কী হবে, সেই প্রশ্ন সামনে এলেই গোটা বিষয়টি এক ভিন্ন মাত্রা নেয়। কংগ্রেসের মুখ রাহুল গাঁধী। দেশেরও মুখ কি? প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে এই আবর্তে। তাই দেখা গেল, হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্যে কংগ্রেসের নির্বাচনী সাফল্যের পরেও মমতা, চন্দ্রবাবু, মায়াবতী, এমনকী অখিলেশও প্রশংসার মালা একা রাহুলের গলায় পরাননি। সবাই বলেছেন, জয় হয়েছে বিজেপি-বিরোধী জনমতের।

ঠিক এইখানে দাঁড়িয়েই মমতার রাজ্যভিত্তিক প্রধান বিরোধী দলগুলিকে শক্তিশালী করার তত্ত্ব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। বিজেপির বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম ফেডারেল ফ্রন্ট গড়ার ডাক দিয়ে মমতা বলেছিলেন, যেখানে যে দল শক্তিশালী, তাকে এগিয়ে দিয়ে বিজেপিকে হারানোর পথ প্রশস্ত করতে হবে। সন্দেহ নেই, এ নীতি মানলে এখানে মমতার সুবিধা ষোলো আনা। কারণ পশ্চিমবঙ্গে তাঁর দলই একক শক্তিতে বিজেপির মোকাবিলা করার যোগ্য।

আবার এটাও লক্ষণীয়, এখন পাঁচ রাজ্যের ভোটে ওই তত্ত্বেরই ‘সফল’ প্রতিফলন মোটামুটি স্পষ্ট হয়েছে। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়ে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। তারা তিন রাজ্যেই বিজেপিকে হারিয়েছে। আবার তেলঙ্গানায় হইহই করে জিতেছে কেসিআর-এর আঞ্চলিক দল। মিজ়োরামে এমএনএফ-এর জয়েও একই ছবি। ফলে কংগ্রেসকে সাফল্যের একক অংশীদার করতে না-চাওয়ার কিছু যুক্তি তো আছেই।

সন্দেহ নেই, সাম্প্রতিক এই ভোটের পরে রাহুলের পায়ের তলায় মাটি অনেক শক্ত। তাঁর শরীরী ভাষায় আত্মবিশ্বাসের ছাপ। সবচেয়ে বড় জাতীয় দল কংগ্রেস এখন নিঃসন্দেহে মাথা তুলে লড়াই করার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে। কিন্তু এই যুদ্ধ যে একা জেতার নয়, সেটা তো তিনি নিজেও বিচক্ষণতার সঙ্গে বলছেন বার বার। কয়েক দিন আগেই একটি টুইটে আমেরিকান ব্যবসায়ী রিড হফ্‌ম্যানকে উদ্ধৃত করে রাহুল বলেছেন, ‘‘আপনি যতই প্রতিভাবান হোন, একা খেলতে গেলে সম্মিলিত দলীয় শক্তির কাছে আপনাকে হেরে যেতেই হবে।’’ অর্থ পরিষ্কার। জোটই একমাত্র পথ। সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বিচারে রাজ্যওয়ারি ছবিও এক থাকতে পারে না। সকলের পক্ষেই এই বোধোদয় আজ জরুরি।

আর সেই কারণে মমতা অতি গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্র হয়ে উঠতে চলেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চান বা না-চান, পারুন বা না-পারুন, তাঁর হাতে যদি কমবেশি চল্লিশ জন সাংসদ থাকেন, লোকসভা ভোটের পরে তাঁর ‘প্রয়োজন’ তা হলে বাড়বে বই কমবে না! শোনা যাচ্ছে, রাজ্য কংগ্রেসের নেতারা দিল্লিতে দরবার করছেন, যাতে মমতার ব্রিগেডের সভায় দলের হাইকম্যান্ড থেকে কেউ না আসেন। আসবেন কি না, তা তাঁদের সিদ্ধান্ত। কিন্তু ভুললে চলবে না, আজকের অবস্থানে দাঁড়িয়ে এই রাজ্যে কংগ্রেসকে মমতার যত না প্রয়োজন, দিল্লিতে মমতাকে কংগ্রেসের প্রয়োজন তার চেয়ে ঢের বেশি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement