এখন জোড় লড়াই। কাদের মধ্যে? অনেকেরই মধ্যে। এনআরসি বনাম এনআরসি বিরোধী। নাটক বনাম টেলিসোপ। এবং স্কুলশিক্ষক বনাম গৃহশিক্ষক। কে টিউশন করবেন, কে করবেন না। কারা জিতবেন, কারা হারবেন। এক দিকে স্কুলশিক্ষকেরা তাঁদের টিউশন-সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে মরিয়া। অন্য দিকে রীতিমতো রণহুঙ্কার দিয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন গৃহশিক্ষকেরা।
বহু স্কুলের বেশ কিছু মাস্টারমশাই প্রাইভেট টিউশনকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা লজ্জাঘৃণাভয় ত্যাগ করে উগ্র সাধনায় মেতে উঠেছেন। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, কোনও মতে এসএসসি’তে নাম তোলাতে পারলেই হল! কেল্লা ফতে! চাকরির চাকরিও হল। সঙ্গে প্রাইভেট টিউশনের ছাড়পত্র! একেবারে শিক্ষার ককটেল বানিয়ে পাতে পাতে পরিবেশন! আর অভিভাবকেরাও উল্লসিত! গৃহশিক্ষক আর অভিভাবক মিলে শিক্ষার স্বাস্থ্যপানে মেতে ওঠা!
আজ সমস্ত উত্তরবঙ্গ তথা রাজ্য জুড়ে স্কুলশিক্ষার সমান্তরাল চলছে এই ব্যবস্থা। স্কুল-কলেজ হয়ে উঠেছে নাম নথিভুক্তির জায়গা, পরীক্ষাকেন্দ্র মাত্র! ক্লাসরুমের ফাঁক গলে শিক্ষা বসে পড়েছে টিউশন স্যারের ঘরের মেঝেতে পারা মাদুর বা কার্পেটের উপরে। এক এক সঙ্গে ৩৫-৪০ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে চলছে ব্যাচের পর ব্যাচ। দিনে চার থেকে ছ’টা ব্যাচ। আমদানির পয়সায় বিশাল বাড়ি। সামনে শাটার লাগানো গ্যারেজ। কেতাদুরস্ত গাড়ি। সে গাড়ি একাধিক হলে বিভিন্ন জায়গায় ভাড়া দেওয়া। শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে একটা করে জায়গা কিনে রাখা। শহরতলিতে বড় রাস্তার ধারে জায়গা কিনে আকাশমণি-ইউক্যালিপ্টাস গাছ লাগিয়ে রাখা। কাঁটাতার ঘেরা। পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলে নিদেন পক্ষে ১০ বিঘা জমি এবং এক বা একাধিক পুকুর।
এরই মধ্যে জেলায় জেলায় বাসস্টপ থেকে শুরু করে হাসপাতালে রোগীর পরিজনের বসার জায়গায় ছেয়ে যায় ফ্লেক্স আর ছাপা বিজ্ঞপ্তি— অমুক স্যারের কোচিং! নব্বই শতাংশ নম্বরের গ্যারান্টি! এই সব বিজ্ঞপ্তি সীমান্তের কাঁটাতারের গায়ে পর্যন্ত লাগানো থাকে। সুযোগ পেলেই ছাত্র যেন ওপার থেকে এপারে চলে আসবে!
নানা ধরনের ‘স্ট্র্যাটেজি’। শহরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে পড়াতে আসা শিক্ষকদের বংশপরিচয় কম জানা যায়। কী তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, তাও তেমন প্রকাশ পায় না। ভাল ছাত্রছাত্রী এঁদের না জুটলেও থোরাই কেয়ার। গ্রামগঞ্জের ছেলেমেয়েরা সব দলে দলে পড়তে আসে। এক এক জন শিক্ষক মুশকিল আসান! বাংলা, ইংরেজি, এডুকেশন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শনবিদ্যা, ইতিহাস! সে রীতিমতো হিস্টিরিয়া! যাঁর নামে পোস্টার, তাঁকে কচিৎ দেখা যায় এবং মাসের প্রথমে কিছুটা বেশি দেখা যায়। এক সঙ্গে একাধিক জায়গায় কোচিং চলে। বিভিন্ন জায়গায় লোক নিযুক্ত করা থাকে, যাঁরা নোট বিতরণের পুণ্য কর্মটি করে থাকেন!
এক ধরনের নেশা পেয়ে বসেছে! টাকা বানানোর নেশা! অনেকের অনেক লজিক। কেউ বলেন, এতে নাকি চর্চা বজায় থাকে।! কেউ বলেন, এতে সময়ের উপযুক্ত ব্যবহার হয়! গোটা বিষয়টি তুঙঅগে উঠেছে! ‘জানিস, অমুক স্যারের কাছে পড়তে গেলে এক বছর আগে নাম লেখাতে হয়!’ ‘আরে, সবাই কম-বেশি ভাল পড়ান, কিন্তু অমুক স্যারের মতো গাইড করতে কে পারেন!’ কোচিংয়ে সপ্তাহে সপ্তাহে পরীক্ষা। পড়ুয়াদের প্রবল গরমেও গরম লাগে না। এসি আছে! বছরে একবার পিকনিক। টিচার্স-ডে’র বিপুল সেলিব্রেশন। পুরো রেস্তরাঁ নিয়ে। বেলুন! রঙিন কাগজ! কী দারুণ ব্যাপার! শিক্ষক প্রতিটি ব্যাচের সঙ্গে দামি পোশাক পরে হাজির থাকেন। তাঁর মার্বেল আর ফলস সিলিংয়ের শৌখিন বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণনের একটি ছবিও পাওয়া যায় না!
পড়ার ঘরের দেওয়াল জুড়ে আলমারি। তাতে কত না বই সাজানো। সব কেনা? তা হলেই হয়েছে। সবই নোটবই। অমুক প্রকাশনী, তমুক প্রকাশনী ফি বছর দিয়ে যায় স্পেসিমেন কপি। তা বাদে বিভূতিভূষণ, মানিক, রবীন্দ্রনাথ আছে কিছু। একজন ছাত্র যদি অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে ফেলে— সব পড়েছেন স্যার? তখন ঢোক গিলে— ‘না রে! পড়ার আর সময় কোথায়! তোদের দিকে নজর দিতে-দিতেই তো ঘড়ির কাঁটা চলে যাচ্ছে! ওসব বিয়ের সময় কিছু পেয়েছিলাম আর বাকি তোদেরই দেওয়া সব উপহার আর কী!
বাড়ির সামনে সার দেওয়া সাইকেল। আহা! সিনেমা হলের রমরমার সময় এরকম এক সঙ্গে অনেক সাইকেল দেখা যেত স্ট্যান্ডগুলোয়। আর বাড়ির বাইরে জুতো দেখে মনে হয়, বুঝি-বা কোনও মন্দির! ভিতরে দর্শনার্থীরা গিয়েছেন পুজো দিতে! ইচ্ছে করে কম নম্বর দিয়ে, ভয় দেখিয়ে তৈরি করা টিউশনির সাজানো বাগান!
শিক্ষা দফতরের বিজ্ঞপ্তি। সরকারি শিক্ষকদের টিউশনি বারণ। রাজ্যের সমান্তরাল শিক্ষা সঙ্কটের মুখে। যে সমস্ত মাস্টারমশায়েরা টিউশন করেন না, তাঁরা ভাবলেন— লোভেই এই বিপর্যয়। অল্পসল্প করলে বেকারদের কাছেও ছাত্র যেত। সবারই হত। কিন্তু গাছেরও খাওয়া আর তলারও কুড়োনোর ফল! বিরাট যুদ্ধজয়ের আনন্দে আত্মহারা বঞ্চিত গৃহশিক্ষকের দল। অথচ এটা কোনও স্থায়ী সমাধান নয়। শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষাকে তো বাধ্যতামূলক করা হলই না, উপরন্তু কোচিং সেন্টারগুলোর গায়ে শিলমোহর পড়লো। শিক্ষায় সেই ব্যবসায়িক বার্তাই রয়ে গেল। ব্যাটন কেবল এক হাত থেকে আরেক হাতে গেল। এই সুযোগে কিছু গৃহশিক্ষকের পসার জমবে, এটা নিশ্চিত। কিন্তু তাতে কী হবে? কালোটাকা তো রয়েই গেল! এতে আয়কর দফতরের লাভ নেই, আবার যাঁরা কাঁচা পয়সার লোভে এই খোলাবাজারের খপ্পরে পড়ল, তাঁদের জীবনেও স্থায়ী সমাধান হল না। চাকরির বয়স পেরিয়ে তাঁদের মনে হবে, জীবনে টিউশন ছাড়া আর কিছুই করা হল না! কালো টাকার মোহ ছেড়ে সময় থাকতে থাকতে উদ্যোগ নিলে হয়তো কিছু হত! নাগরিক হিসেবে সম্মান পেতেন! সুখের কালো টাকা জীবনকে এমনই রুদ্ধ বাঁকে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়, যেখান থেকে আর ফেরা যায় না!
(লেখক বালুরঘাটের মহাদেববাটী এফপি স্কুলের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)