একটি ফোনের কথা দিয়ে শুরু করা যাক। মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর গত বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেদিন নরেন্দ্র মোদীকে বলে দিলেন, নির্বাচিত রাজ্য সরকার কেন্দ্রের ক্রীতদাস নয়, ওই টেলিফোনের ঘটনাটি তারও কয়েকদিন আগের। করোনা মোকাবিলায় বাংলার সরকারের ‘ব্যর্থতা’র প্রশ্নে বিবাদ-বিতর্ক ততদিনে তুঙ্গে।
রাজ্যের বিরুদ্ধে রোগের প্রকোপ সংক্রান্ত তথ্য গোপন করা, চিকিৎসায় অব্যবস্থা, রেশন বিলিতে দুর্নীতি, পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজ্যে ফেরাতে গড়িমসি ইত্যাদি ভূরি ভূরি অভিযোগ তার আগে থেকেই ছড়াচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া এবং রাজনৈতিক বিবৃতিতে। দু’ঘণ্টার নোটিসে দুটি কেন্দ্রীয় দল রাজ্যে পৌঁছে যাওয়া ঘিরেও প্রবল চাপান-উতোর দুই সরকারের মধ্যে। কেন্দ্র থেকে রোজ চিঠির পর চিঠি, হুমকি, নির্দেশ আসছে, জবাবও যাচ্ছে। সর্বোপরি, রাজভবনের রাজনীতি তো আছেই!
এমনই এক আবহে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে এক দিন ফোনে কথা হয় মুখ্যমন্ত্রী মমতার। সেখানেই শাহকে তিনি জানান, কেন্দ্রের ‘অসৌজন্যমূলক আচরণ এবং অকারণ খবরদারি’ দিন দিন বাড়ছে। এটা মেনে নেওয়া রাজ্যের পক্ষে কঠিন। অতঃপর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষুব্ধ বক্তব্য: ‘‘রোজ রোজ এভাবে ব্যতিব্যস্ত না করে কেন্দ্র বরং যা করার এক বারে করে ফেলুক। যদি মনে করা হয়, রাজ্য কাজ করতে পারছে না, তা হলে বরং কেন্দ্র এসে এখনই দায়িত্ব বুঝে নিক! বাকিটা মানুষ বুঝে নেবে।’’
যতদূর জানি, অমিত শাহ প্রসঙ্গটি সে দিন আর বাড়তে দেননি। ইঙ্গিতটি তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তাই মমতার ক্ষোভের উত্তরে রাষ্ট্রধর্মের আদর্শ শুনিয়ে বলে দেন, নির্বাচিত রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারে হস্তক্ষেপ করা কেন্দ্রের নীতি নয়। এ নিয়ে ভুল বোঝার কোনও অবকাশ নেই।
আসলে বিষয়টি কি সত্যিই এতটা সরল? করোনা-পর্বে কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের সংঘাত যেভাবে বেড়ে উঠছে, তাতে কিন্তু অন্যতর উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। যাতে স্বাভাবিকভাবেই মনে হয়, এই জট আরও জটিল হবে। কারণ, কে কার অধিকার বা এক্তিয়ারের সীমা কতটা লঙ্ঘন করেছে, কার আচরণ কতটা অসৌজন্যমূলক, সেই সব এখন আর শুধু রাজনৈতিক তরজায় সীমাবদ্ধ নেই। সরকারি ভাবে দুই প্রশাসন সম্মুখসমরে নেমেছে। বিষয়টি তাই বেশ অর্থবহ।
করোনা-পর্যায়ে কেন্দ্রীয় সরকারের শীর্ষমহল বিভিন্ন ব্যাপারে নিয়মিত লিখিত ভাবে রাজ্য প্রশাসনকে দোষারোপ করছে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপে স্বচ্ছতা এবং সহযোগিতার অভাব ঘটছে বলে অভিযোগ তুলছে। রাজ্যও তার জবাব দিচ্ছে। কেন্দ্রের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ আনতেও কসুর করছে না। এমনকি, রাজ্যকে কার্যত অন্ধকারে রেখে কেন্দ্রীয় দল পাঠানো, পরিযায়ীদের ট্রেন নিয়ে ‘বিভ্রান্তি’ সৃষ্টি, নবান্নের ‘অগোচরে’ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে রাজ্যের অফিসারকে ডেকে নেওয়ার মতো ‘অসৌজন্য’ নিয়ে নবান্নের প্রতিক্রিয়া বেশ কঠোর।
আবহসঙ্গীতটা যে উভয় তরফেই রাজনীতির সুরে বাঁধা, তা বিশদ করা নিষ্প্রয়োজন। এটা জানা কথা, কেন্দ্র বা রাজ্য যে সরকারই হোক, রাজনৈতিক প্রভুরা না চাইলে আমলারা খামখা এমন চিঠিপত্র লেখেন না। কিন্তু বিচক্ষণ আমলাবর্গ এটাও বিলক্ষণ বোঝেন, কোনও রাজ্যের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ও কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কেন্দ্র যদি সরকারি স্তরে ক্রমাগত বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করতে থাকে এবং সরকারের চিঠিতে লিখিত অভিযোগগুলি সেইভাবে নথিবদ্ধ করা হয়, তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হওয়া অসম্ভব নয়। বাংলাকে তেমন বাঁধনে বেঁধে ফেলার প্রস্তুতি কি তা হলে শুরু হয়ে গেল?
কিছু দিন ধরে একটি জল্পনা নানা মহলে ঘুরপাক খাচ্ছে। হাওয়া মেপে অনেকেই বুঝতে চান, রাজ্যে আগামী বিধানসভা ভোটের আগে সরকার ভেঙে দেওয়া হবে না তো? বিজেপি-র দু-দশ জন ‘হামবড়া’ নেতা অবশ্য লোকসভা ভোটের পর থেকেই কথায় কথায় এমন হুঙ্কার দিয়ে বাজার গরম রাখেন। তার উপর মহামহিম জগদীপ ধনখড় রাজভবনে আসা ইস্তক নিত্য কর্মসূচি পালনের মতো কথায় কথায় যে ভাবে সরকারের মুণ্ডপাত এবং ‘কঠোর পরিণতি’র হুঙ্কার দিয়ে যাচ্ছেন, তাতেও ওই ধরনের জল্পনা বাড়ছে বই কমছে না।
কিন্তু সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হয়, আচমকা সাংঘাতিক গোলমেলে কোনও পরিস্থিতির উদ্ভব না হলে নির্বাচিত রাজ্য সরকারকে সরিয়ে ভোটে যাওয়ার হঠকারিতা মোদী-শাহ করবেন না। করলে তাতে মমতারই লাভ হবে অনেক বেশি! কারণ এই রকম কাজ সচরাচর মানুষ মেনে নেয় না। ভোটের রায়েও সেই জনরোষের প্রকাশ ঘটে। সেটা বুঝেই হয়তো মমতা জোরের সঙ্গে বলতে পারেন, কেন্দ্র চাইলে সরকার ভেঙে দিক!
তা বলে রাজ্য সরকারকে ‘স্বস্তি’তে রেখে বিজেপি ভোট করবে, সেটাও ভাবা ভুল। ক্ষমতাসীন মমতাকে নানা দিক থেকে যত রকম প্যাঁচে ফেলা যায়, তার ফন্দি কষেই এগোনোর ছক করছে তারা। শীর্ষস্তরের অফিসারদের উপর সরকারি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চাপ বাড়িয়ে যাওয়া, আরও সোজাসুজি বললে, তাঁদের অদক্ষ, অ-নিরপেক্ষ বলে দাগিয়ে দেওয়া সেই কৌশলের অন্যতম অঙ্গ। এতে প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় ভোটের আগে শীর্ষ পদাধিকারী অফিসারদের রদবদলের পথ যেমন প্রশস্ত করা যাবে, তেমনই সরকারকে ‘ব্যর্থ’ প্রতিপন্ন করে রাজনৈতিক প্রচারের জোর বাড়বে। মানুষ কাকে কতটা বিশ্বাস করবেন, সেটা অবশ্য বলবে ভোটের রায়। তবে তার আগের বিবিধ বিড়ম্বনা এড়ানো সহজ না-ও হতে পারে।
রাজ্যে নির্বাচনী বিধি চালু হওয়ার পরে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে অফিসার ও পুলিশে রদবদল ইদানীং কিছুটা রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্রে বিজেপি জমানায় বিশেষ করে বিরোধী রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে এটা নজরে পড়ার মতো। গত লোকসভা ভোটের শেষ পর্বে এখানে স্বরাষ্ট্র সচিব এবং কলকাতার পুলিশ কমিশনারকেও সরানো হয়েছিল। প্রশাসনে তার অভিঘাত ছিল ব্যাপক। রাজনীতিতে তো বটেই। আসলে একেবারে উঁচুতলায় টান পড়লে জনমানসেও একটা সন্দেহের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া যায়। শাসকের পক্ষে তা স্বস্তিকর বলা চলে না।
এবার বিধানসভা ভোটের আগেও তেমন সম্ভাবনা প্রায় ষোলো আনা। কয়েক মাস আগে এক দিন দিল্লির পথে বিমানে এখনকার বিজেপি নেতা মুকুল রায় কথায় কথায় বলেছিলেন, ভোটের ছ’মাস আগে থেকেই নির্বাচন কমিশন রাজ্যের উপর ‘নজর’ রাখবে। তখন অবশ্য করোনার দুঃসময় আসেনি। তবে নাগরিকত্ব প্রশ্নে বিজেপি-র চাপে পড়া টের পাওয়া যাচ্ছিল।
এখন করোনা-রাজনীতিই হবে ভোটের চালিকাশক্তি। আর রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে কেন্দ্রের ‘সরকারি’ তালিকা যত দীর্ঘ হবে, নির্বাচন কমিশনের নজরও হয়তো ততই ‘স্বচ্ছ’ হতে থাকবে। পাশাপাশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে রাজ্যপালের ‘নিরপেক্ষ’ ভূমিকাও।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য সর্বদাই বলে থাকেন, অফিসার রদবদলে তাঁর কিছু যায়-আসে না। আগেও এ সবে তাঁর কোনও অসুবিধা হয়নি। কারণ, তাঁর ভরসা জনগণ। রাজনীতিক হিসাবে তিনি তো এটাই বলবেন। কিন্তু এক জন প্রশাসক নিশ্চয় অনুভব করেন, আইএএস, আইপিএস-রা প্রশাসন যন্ত্রের নাট-বল্টু। আলগা হতে থাকলে যন্ত্র নড়বড় করতে পারে।
তবে মুদ্রার আর একটি পিঠও আছে। গত সপ্তাহে বিজেপি-র স্বপন দাশগুপ্ত, শিশির বাজোরিয়া প্রমুখ নেতা ‘কোভিড-১৯ অতিমারি এবং পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক একটি আলোচনার আয়োজন করেছিলেন। ভিডিয়ো-প্রযুক্তির মাধ্যমে দলের জেলাস্তরের অনেক নেতা তাতে যোগ দেন। সেখানে প্রসঙ্গ উঠেছিল, কী বিকল্প নীতি সামনে রেখে বিজেপি রাজ্যে সরকার গড়ার কথা বলবে? ওই বৈঠকে কোনও স্পষ্ট জবাব মেলেনি।
তবে বিজেপি-শাসিত ভারতের দিকে তাকালে উত্তর বোধহয় খুব অজানা নয়!