ছবি: এএফপি।
দীর্ঘ লকডাউন প্রমাণ করিয়াছিল, যানবাহন চলাচলে রাশ টানিলে পরিবেশ কতটা নির্মল হইতে পারে। কিন্তু ইহা যে স্থায়ী সমাধান নহে, লকডাউন উঠিলেই দূষণ পুনরায় জাল বিস্তার করিবে, এমন আশঙ্কাও যুগপৎ শুনা যাইতেছিল বিশেষজ্ঞদের মুখে। সেই আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক হইবার সঙ্গে সঙ্গেই কলিকাতার পরিবেশ ফের কলুষিত। দূষণের পরিমাণও বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রকার। যেমন, পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ওয়েবসাইট দেখাইতেছে, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিটি রোড অঞ্চলে বাতাসের গুণমান কলিকাতায় নিকৃষ্টতম। সর্বাপেক্ষা উন্নত রবীন্দ্র সরোবর সংলগ্ন অঞ্চলে। একই শহরের দুই প্রান্তে বাতাসের গুণমানের মধ্যে সুবিশাল তফাতটি গড়িয়া দিয়াছে বিটি রোডে অনিয়ন্ত্রিত পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল। জানা গিয়াছে, রবীন্দ্রভারতী চত্বরে অধিকতর দূষণের চিত্রটি নূতন নহে, বহু বৎসর ধরিয়া ইহা পরিলক্ষিত হইতেছে। অথচ, দূষণ কমাইবার এবং পণ্যবাহী যানগুলি নিয়ন্ত্রণের জন্য যে সদর্থক পদক্ষেপ করিবার প্রয়োজন ছিল, রাজ্য সরকার তাহা করে নাই।
কেন করে নাই, তাহার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নাই। ইতিপূর্বে ২০০৮ সালে তৎকালীন বাম সরকার জাতীয় পরিবেশ আদালতকে জানাইয়াছিল, তাহারা ধাপে ধাপে ১৫ বৎসর বা তাহার অধিক পুরাতন বাণিজ্যিক যান চলাচলের অনুমোদন বাতিল করিবে। নির্দেশিকা জারি করিয়া ২০০৯ সালের মধ্যে শহরের সমস্ত অটোকে এলপিজি বা সিএনজি-তে পরিণত করা, পরিবেশবান্ধব জ্বালানির উপর জোর, দূষণ পরীক্ষা কেন্দ্রগুলির উপর নজরদারি-সহ একগুচ্ছ কর্মসূচির কথাও বলা হইয়াছিল। অতঃপর রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটিয়াছে। কিন্তু কলিকাতার দূষণ-ভাগ্য অ-পরিবর্তিত থাকিয়া গিয়াছে। নূতন আমলেও অধিকাংশ নির্দেশই বাস্তবায়িত হয় নাই। ২০১৫ সালে কলিকাতা ও হাওড়ায় যান দূষণ লইয়া উদ্বিগ্ন জাতীয় পরিবেশ আদালত সরকারকে প্রস্তাব দিয়াছিল, দূষণ নিয়ন্ত্রণের ছাড়পত্র দর্শাইতে না পারিলে তেল মিলিবে না— এমন নীতি গ্রহণ করিবার। কিন্তু প্রবল বিরোধিতায় সেই নীতিও কার্যকর করা যায় নাই। সুতরাং, কলিকাতায় বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা এবং নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড বিপজ্জনক মাত্রা পার করিয়াছে।
কিন্তু বায়ুদূষণের বিপদ লইয়া কি রাজ্য সরকার আদৌ চিন্তিত? প্রতি বৎসর কালীপূজা ও ছটের সময় বাজি পুড়াইবার উপর পরিবেশ আদালতের নিষেধাজ্ঞাকে যে ভাবে এই রাজ্যে অগ্রাহ্য করা হয়, এবং রাজ্য সরকার সেই নিয়মভঙ্গকে যে অসীম প্রশ্রয় দিয়া থাকে, তাহাতে সরকারি সদিচ্ছা লইয়া সন্দেহ হয়। করোনাকালে বায়ুদূষণের বিপদ লইয়াও গোড়ার দিকে সরকার যথেষ্ট কড়া হয় নাই। আদালতের কঠোর নির্দেশের পর প্রশাসনকে পথে নামিতে দেখা গিয়াছে। পণ্যবাহী যানের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। নজরদারিতে বিস্তর ফাঁক। পুরাতন ও দূষণ সৃষ্টিকারী যান অবাধে চলাচল করিতেছে। ফলত, বৎসরের পর বৎসর ধরিয়া কার্বন মনোক্সাইড ও সিসা-মিশ্রিত ধোঁয়া গলাধঃকরণ করিতেছেন শহরবাসী। একদা পরিবেশ আদালত বলিয়াছিল, পরিচ্ছন্ন ও সুস্থ জীবন যাপন সকলের সাংবিধানিক অধিকার। সেই অধিকার কলিকাতাবাসী কি আদৌ পাইবেন— উত্তর ঘোর তমসাচ্ছন্ন।