রাজ্য সরকারের দাবি, ‘জল ধরো জল ভরো’ প্রকল্প সফল হয়েছে। ফাইল চিত্র
কালনার শেখ ইয়ার মহম্মদ হাতটা বাড়িয়ে বললেন, ‘এই যে নদীটা দেখছেন, এর নাম বেহুলা। আমি বলি হোয়াং হো।’ সে কী, কেন? ‘হোয়াং হো চিনের দুঃখ। আর এই নদী রামেশ্বরপুর মৌজার দুঃখ। এক রাত বৃষ্টি হলে সব খেত ভেসে যাবে। আর দু’দিন বৃষ্টি না হলেই নদী পাঁক।’ কেন এই দশা? কারণ শেষ সংস্কার হয়েছে কংগ্রেস সরকারের আমলে। ‘ফুড ফর ওয়ার্ক’ প্রকল্পে তখন মজুরি ছিল দিনে দু’কেজি গম।
সেই দুঃখনদীর ভরসাতেই পেঁয়াজ-ধান-পাট চাষের চক্র চলছে পূর্ব বর্ধমানের অন্তত একশোটা গ্রামে। রামেশ্বরপুরে নিচু জমিতে তৈরি চালকল বন্ধ করে দিয়েছে জলনিকাশি নালা। মন্তেশ্বরে তো মস্ত এক পুকুরই চুরি গিয়েছে। পঞ্চাশ বিঘের ওই পুকুরে যদি জল থাকত, আশেপাশের চারশো-পাঁচশো বিঘে জমি সেচ পেত। ‘সরকার দেখিয়ে দিক, পুকুরটা কোথায়। খুঁজে না পেলে ফিরিয়ে দিক পুকুর’, বললেন শুকদেব গড়াই, সুব্রত রায়, রমেশ দে।
এ বছর বর্ষা এসেছে শ্রাবণ পার করে। বর্ধমানের বেশির ভাগ খেতে বর্ষা আসার আগেই বীজ বপন হয়ে গিয়েছে সাবমার্সিবল (পাম্প)-এর জলে। এর ঝুঁকি কি চাষি বোঝেন না? ‘দশ বছর আগেও পঁচিশ ফুট খুঁড়লে জল উঠত, এখন নব্বই ফুটেও জল উঠতে চায় না। এমন চললে খাবার জল মিলবে না।’ তাই নদী, পুকুর, নয়ানজুলি ফিরে চাইছেন চাষি।
সরকার কী চাইছে? চাইছে, মাটির নীচের জল যাতে তুলতে না পারে চাষি, তার ব্যবস্থা করতে। চাষির অভিযোগ, সেই জন্যই চাষের মরসুম জুড়ে লোডশেডিং চলেছে। বিশে জুন থেকে জুলাইয়ের সাত-আট তারিখ পর্যন্ত পূর্ব বর্ধমানের বিস্তীর্ণ অংশে সকাল আটটা থেকে বেলা দশটা-এগারোটা লোডশেডিং হয়েছে। ঠিক যখন জমিতে জল দেওয়ার সময়। অনেক গ্রামে সেচ পাম্পে বৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ কাটা হয়েছে, অনেক গ্রামে বিদ্যুৎ কর্মীরা মুখে বারণ করে গিয়েছেন পাম্প চালাতে। নতুন সাবমার্সিবল বসানোর অনুমতি মেলার তো প্রশ্নই নেই। প্রশাসন, শিল্পপতি, শখের সমাজসেবী, সকলেই চাষির দিকে আঙুল তুলছেন— এত জল খরচ করো কেন?
চড়া দরে কেনা জল নষ্ট করবে, চাষি কি এতই ধনী? ডিজেল ৬৫ টাকা লিটার, বিদ্যুৎ নিতে হয় বাণিজ্যিক হারে (পঞ্জাবে প্রতি ইউনিট ৫০ পয়সা)। সাধারণত বর্ষার আমন চাষে পাম্পের জল দরকার হয় না। কিন্তু এ বার শ্রাবণে বৃষ্টি না-হওয়ায় সুযোগ বুঝে পাম্প মালিকরা জলের দাম চড়িয়েছেন। ‘অন্য বার বোরো সিজ়নে (এক-দেড় মাস) দু’হাজার টাকা চায়, এ বার আমনেই তা চাইছে’, বললেন কালনার চাষিরা। ভাদ্রের শেষে ধানের শিষে দুধ জমলে জল দিতে হয়। অমনি জলের দরও বাড়ে। সরকারি পাম্প হলে ‘সিজ়ন’ চুক্তির দর সাতশো-আটশো টাকা। জল নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে চাষিকে সরকার ছেড়ে দিচ্ছে জলের অনিয়ন্ত্রিত বাজারে।
চাষিরাও বলছেন, ভূগর্ভস্থ জল তোলায় নিয়ন্ত্রণ চাই। ‘ফাল্গুন-চৈত্রে বোরো ধানের চাষ আইন করে বন্ধ হোক। তখন তিল, গম, সরষে হোক’, বলছেন মন্তেশ্বরের চাষিরা। কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম বর্ষার জলে আমন ধানের চাষ করে আসছে বাংলার চাষি, যা সংবৎসরের খাবার জোগায়। তা যদি জলের অভাবে বন্ধ হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা হলে চাষির কী হবে? ‘আজ যাঁরা পাম্প চালাতে নিষেধ করছেন, তাঁরা কি ভুলেছেন, কেন চাষি পাম্প বসাতে বাধ্য হয়েছিলেন?’ প্রশ্ন তাঁদের। সরকারি তথ্যই অবশ্য সে গল্পটা বলে দেয়। আজও রাজ্যে ৫৬ লক্ষ হেক্টর চাষযোগ্য জমির মধ্যে মেরেকেটে ১৩ লক্ষ হেক্টর জল পায় নদী ও ক্যানালের, ৩৫ লক্ষ হেক্টর নির্ভরশীল মাটির নীচের জলের উপর। এ বছর বহু জেলায় নদী-খাল শুকিয়ে এমন দশা হয়েছিল, যে ধান রোপণের সময়ে রিভার পাম্প, শ্যালো কাজ করেনি। ময়ূরাক্ষী, কংসাবতী প্রকল্প থেকে ক্যানালে গত বছরের চাইতে অনেক কম জল ছাড়া হয়েছে, বলছে সেচ দফতর।
রাজ্য সরকারের দাবি, ‘জল ধরো জল ভরো’ প্রকল্প সফল হয়েছে। চাষির প্রশ্ন, ক’টা পুকুর কাটা হয়েছে, সে হিসেব না-হয় সরকার দিচ্ছে। কিন্তু ক’টা পুকুর বুজিয়ে নির্মাণ হয়েছে, তার হিসেব তো দিচ্ছে না? পাকা রাস্তার ধারে ধারে থাকা ধাবা, দোকান বা বাড়ি নয়ানজুলির গতিপথ আটকে দেয়। অথচ এই সব নয়ানজুলি স্থানীয় পুরসভা বা পঞ্চায়েতের নজরদারিতে নিয়মিত পরিষ্কার রাখলে শীতে রবি চাষের জল মেলে। যেখানে নয়ানজুলিতে জল পাওয়া গিয়েছে, সেখানকার চাষিরা এ বারের বৃষ্টিহীন বর্ষায় ওই জলেই বীজ বপন করেছেন। যেখানে মেলেনি, সেখানে পাট পচাতে সেচ পাম্প চালিয়েছেন। দাঁড়ানো ফসল শুকোতে দেখলে কে ভবিষ্যতের বিপর্যয় নিয়ে ব্যস্ত হবে?
সেচের জলে নিয়ন্ত্রণ আরও অসহনীয় হয় চাষির কাছে যখন তিনি দেখেন, পানীয় জল থেকে বাংলা মদ— সব ব্যবসাই চলছে মাটি থেকে জল তুলে। তার পরিমাণ কি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে? শহরের সমস্ত রাস্তা পিচ বা কংক্রিট। বৃষ্টির জল মাটির নীচে যাওয়ার উপায় নেই। প্লাস্টিকে ভরা নর্দমায় পড়ে শুকিয়ে নষ্ট হয় বৃষ্টির জল। ভৌমজলের স্তর এমনিই বেড়ে যাবে? প্লাস্টিক উৎপাদন, ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ কই? ভাগ্যিস চাষির জমিতে প্লাস্টিক ফলে না, নইলে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ত। চাষির না আছে লোকবল, না অর্থবল। চাষিকে জলের ব্যবহার কমাতে যাঁরা উপদেশ দেন, তাঁদেরই ছাদের ট্যাঙ্ক, পাড়ার কল থেকে জল উপচে যায়।
কিন্তু কী করে উদ্ধার হবে নয়ানজুলি, সেচখাল, নিকাশিনালা? দক্ষিণ ২৪ পরগনার মগরাহাটে যুগদিয়া, গোকর্ণী, বারাসাত গ্রামের ইউসুফ আলি হালদার, সাহাজুল সর্দাররা জানালেন, দক্ষিণ শালগড়িয়া-চালতাবেড়িয়া খাল বুজিয়ে ঘরবাড়ি হয়েছে। অন্তত দশটা সংসদের কয়েকশো বিঘে জমিতে জল দাঁড়িয়ে যায় সামান্য বৃষ্টিতে। রাতারাতি নষ্ট হয় শাকসব্জি। বিডিও-সহ সেচ দফতরের কর্তারা নতুন খাল কাটতে এসেও ফিরে গিয়েছেন। যাঁদের জমির উপর দিয়ে খাল যাবে, তাঁদের দাবির মীমাংসা করবে কে? এক সময়ে গ্রামের স্তরে নানা স্বার্থের মধ্যে রফা করে সহমত তৈরি করতেন রাজনৈতিক নেতারা। এখন রাজনীতি মানে সংঘাত। সাধারণ মীমাংসাও নেতা-আমলাদের কাছে অসাধ্য।
সাবমার্সিবলে জল তোলা ‘জাতীয় বিপর্যয়’, তাই জমির উপরের জল ফিরে চান মন্তেশ্বরের চাষিরা। তাঁদের দাবি, ব্লক ভূমি দফতর আধিকারিকের নথি বার করে মিলিয়ে দেখা হোক, কোথায় নালা, পুকুর, খাল থাকার কথা, আর কী রয়েছে। সেই জলসম্পদ ফিরিয়ে দিক সরকার। অসম্ভব মনে হচ্ছে? ঠিকই তো, বেআইনি নির্মাণ কে বন্ধ করতে পারে। তার চাইতে ঢের সোজা চাষির সেচের জল বন্ধ করা। ব্যস, লোডশেডিং করে দিলেই হল।