—ফাইল চিত্র।
মাসাধিক কাল শূন্য থাকা পশ্চিমবঙ্গের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির পদে অবশেষে অধীর চৌধুরীকে বসানো হইল। তাঁহার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বার এই পদপ্রাপ্তি। এক্ষণে কংগ্রেস হাইকম্যান্ড অর্থাৎ সনিয়া গাঁধীর সিদ্ধান্তটি নির্বাচনমুখী পশ্চিমবঙ্গের জন্য নিশ্চয় কিছু বার্তা বহন করে। গত লোকসভা নির্বাচনের কিছু পূর্বে তৎকালীন প্রদেশ সভাপতি অধীরবাবুকে অকস্মাৎ সরাইয়া সর্বভারতীয় কংগ্রেসের পূর্বতন সভাপতি রাহুল গাঁধী কেন বয়োবৃদ্ধ সোমেন মিত্রকে বাছিয়া লইয়াছিলেন, তাহা এখনও অস্পষ্ট। তবে সোমেনবাবুর প্রয়াণের পরে আবার অধীরবাবুকে ফিরাইয়া তাঁহার উপর হাইকম্যান্ডের আস্থার ঘাটতি-সংক্রান্ত জল্পনায় জল ঢালা গেল, বলা যাইতে পারে। প্রশ্ন হইল, অধীর চৌধুরীর হাত ধরিয়া রাজ্য কংগ্রেস কোন পথে চলিবে? রাজ্য-রাজনীতির প্রেক্ষিতে তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কট্টর বিরোধী বলিয়া স্বীকৃত। এই মনোভাব অবশ্য উভয়ত সত্য। এমতাবস্থায় তৃণমূল ও কংগ্রেসের মধ্যে কোনও সমঝোতার সম্ভাবনা আপাতদৃষ্টিতে ক্ষীণ। ২০১৬ সালে অধীরবাবুই ছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি এবং সেই নির্বাচনেই বাংলায় প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে সিপিএম তথা বামেদের সহিত কংগ্রেসের আসন-রফা হয়। ভোটে তৃণমূলের কাছে তাঁহারা শোচনীয় ভাবে ধাক্কা খাইয়াছিলেন ঠিকই, তবে রাজ্যের রাজনীতিতে অবশ্যই নূতন এক ধারা সূচিত হইয়াছিল। গত বৎসর লোকসভা নির্বাচনের সময়েও সোমেন মিত্রের প্রদেশ কংগ্রেস অনুরূপ চেষ্টা করে। কার্যকারণে শেষরক্ষা হয় নাই। যদিও ২০২১-এর ভোটের জন্য সেই কাজ সোমেনবাবু কিছুটা আগাইয়া দিয়া গিয়াছেন। অধীরবাবুও একই পথে হাঁটা শুরু করিয়াছেন।
কিন্তু, বিজেপি-বিরোধী ঐক্যের স্বার্থে জাতীয় মঞ্চে সনিয়া গাঁধী যখন মমতার হাত ধরিতে উৎসুক ও হাত বাড়াইয়া দিতে তৃণমূল নেত্রীও যখন বিশেষ অনাগ্রহী নন, তখন রাজ্যে কংগ্রেসের মমতা-বিরোধী ভূমিকা শেষ পর্যন্ত কতটা কার্যকর বা যুক্তিগ্রাহ্য হইতে পারে? কান পাতিলে সংশয়াবিষ্ট এমন কথাও শুনা যাইতেছে। রাজনীতির গতি অতি বিচিত্রগামী ও দ্রুত পরিবর্তনশীল। সেখানে অসম্ভব বলিয়া কিছু থাকিতে পারে না। পরিস্থিতির দাবিতে বরং নূতন হইতে নূতনতর সম্ভাব্যতার পথ খুলিয়া যাইতে পারে। অতএব, কী হইলে কী হইবে বা হওয়া উচিত, এখনই সেই জল্পনায় কালক্ষেপ না করা মঙ্গল। তবে নীতিগত বা কৌশলগত অবস্থানে রাজ্যের কংগ্রেসকে সর্বদাই যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মুখাপেক্ষী হইয়া চলিতে হইবে, ইহাও কোনও কঠোর বন্ধন হইতে পারে না।
জাতীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতা অনেক সময় বড় হইয়া উঠে। যেমন, কংগ্রেসের নেতৃত্বে কেন্দ্রে প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে রাজ্যে নন্দীগ্রাম-কাণ্ড ঘটে। সেই সময় বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে মমতার ডাকা বাংলা বন্ধে কংগ্রেস সক্রিয় ভাবে অংশ লইতে পারে নাই। রাজ্য-দলের ইচ্ছাকে উপরতলার নির্দেশে দমন করিতে হইয়াছিল। কারণ, সিপিএম ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের অংশ। এখন পরিস্থিতি অন্য। কংগ্রেস ক্ষমতায় নাই। ফলে ক্ষমতাচ্যুত হইবার আশঙ্কাও নাই। এই অবস্থায় শুধু জাতীয় পর্যায়ে বিরোধী-ঐক্য গঠনের যুক্তিতে কোনও রাজ্যের রাজনৈতিক বাস্তবতা হইতে মুখ ঘুরাইয়া রাখা সর্বদা বিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপ না-ও হইতে পারে। রাজ্যের শাসকের বিরুদ্ধে বলার কথা বলিবার, প্রতিবাদ বা বিরোধিতার পরিসরই বা রাজ্যস্তরে থাকিবে না কেন? কেরলেও তো সিপিএমের নেতৃত্বে বাম-সরকারের অপসারণ, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ ইত্যাদি দাবিতে কংগ্রেস আন্দোলন করিতেছে। কিন্তু তাহাতে বিরোধী দলগুলির বৃহত্তর মঞ্চে বোঝাপড়ার কোনও রূপ ঘাটতি হইতেছে কি? পরিশেষে একটি কথা বলিবার। ভোট-ভিত্তিক রাজনীতিতে কাহার কত আসন মিলিল, তাহাই শেষ কথা। অধীরবাবুর কাছে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জও বটে।