সুধীর চক্রবর্তী।
একদা নিজের পরিচয় দিতেন ‘কৃষ্ণকলি’ বলে। যাঁদের বাড়ি একই সঙ্গে কৃষ্ণনগর ও কলকাতা, তাঁরাই ‘কৃষ্ণকলি’। বলতে গেলে তিনি সারা জীবন কৃষ্ণনগরেই কাটিয়েছেন। বাংলার ছোট অথচ প্রাচীন, নিস্তরঙ্গ অথচ ঐতিহ্যময় এক একটি শহর বঙ্গসংস্কৃতির এক এক জন দিগ্দর্শকের ঠিকানা, সুধীর চক্রবর্তীর যেমন কৃষ্ণনগর। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি, শিল্প ও কৃষ্টির অন্যতম পীঠস্থান নদিয়ার এই শহরটির পিতৃসম হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ‘স্যর’ বা ‘মাস্টারমশাই’ তাঁকে বলতেন অনেকেই— কলকাতার মানুষজনও— কিন্তু আশ্রয় আর প্রশ্রয় মেশানো তাঁর সস্নেহ অভিভাবকত্বের ছায়া পেয়েছিল দক্ষিণবঙ্গের এই শহর, সমগ্র জেলাটিই। সেই স্নেহের সমান অংশীদার কলেজপড়ুয়া, গবেষক, শিক্ষক, পত্রিকা সম্পাদক থেকে কুলি, মজুর, ভ্যানচালক, রাজমিস্ত্রি। কিংবা গ্রাম্য পালা গায়ক, কথক ঠাকুর।
দায়িত্ববান গৃহকর্তা, দুই কন্যার স্নেহশীল পিতা তিনি। অগণিত ছাত্রের প্রিয় শিক্ষক, দুই বাংলার সর্বমান্য লোকগবেষক। সেই গবেষণা ঠান্ডা ঘরে বসে বই ঘেঁটে সন্দর্ভ রচনার নয়, সেই অনুসন্ধান গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষের সঙ্গে মিশে তাঁদের জীবনকে দেখার। অন্তরে বহতা ছিল সন্ধিৎসা ধারা। যেখানে যা কিছুর মধ্যেই পেতেন বাংলার লোকায়ত জীবনের খোঁজ, ছুটে যেতেন। দেখার চোখটা এতই ক্রিয়াশীল ছিল, জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও অবিরত খুঁজে ফিরেছেন লোকজীবনের রহস্য ও গূঢ়ার্থ।
পঞ্চাশ বছর বয়সে প্রকাশ করেছেন নিজের প্রথম বই। মনন ও প্রজ্ঞার এক মাহেন্দ্রক্ষণেই পাঠকের দরবারে এসেছেন, তার পর থেকে আর ফিরে তাকাননি। পঞ্চাশেরও অধিক মৌলিক গ্রন্থের জনক এই মানুষটির মেধা ও বীক্ষণ তাঁর লেখায় তো বটেই, এমনকি ফুটে উঠত তাঁর গ্রন্থের উৎসর্গপত্রেও। রূপে বর্ণে ছন্দে বইটি দু’জনকে উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের নামের আগে লেখা ‘উদ্যোগী পুস্তক প্রকাশক’ এবং ‘নিঃস্বার্থ পুস্তকপ্রেমী’। সম্পাদিত গ্রন্থ গবেষণার অন্দরমহল যাঁকে উৎসর্গ করেছেন তাঁর নামের আগে লিখেছেন ‘পরহিতব্রতী’। এই মূল্যায়ন যে তাঁর নিবিড় অন্তর-অবলোকনের ফল, আর ওই স্নেহোপহারও নিখাদ প্রীতিমাখা, তা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে খুব কাছ থেকে। বিদ্যা বিনয় দেয়, প্রজ্ঞা— ঔদার্য। তাঁর ঔদার্য নিজেকে জাহির করত না; যাঁর উপর ঝরে পড়ত, তাঁকে টেনে নিত কাছে।
বিজ্ঞাপনবিহীন ধ্রুবপদ পত্রিকার বারোটি সংখ্যার নির্মাণ তাঁর চিন্তা-চেতনার এক শ্রেষ্ঠ ফসল। সম্পাদনা, বিষয় ও লেখক নির্বাচন থেকে লেখা সংগ্রহ, বার বার তার পরিমার্জন ও পুনর্লিখন করানো, প্রুফ দেখা, পত্রিকার বিপণন ইত্যাদি তিনি নিজে করতেন। প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত একটি লেখা ও প্রতি সংখ্যায় ‘আত্মপক্ষ’ ছাড়া তিনি এতে আর লেখেননি, লিখিয়েছেন তরুণ থেকে তরুণতর লেখকদের দিয়ে। লেখক তৈরির জন্যে ছিল তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা। পত্রিকার কাজকেও তাঁর একার কাজ বলে মনে করতেন না কখনও। প্রত্যেক সংখ্যায় থাকত ‘যাঁদের কাছে ঋণী’ শিরোনামে শতাধিক নামের একটি তালিকা। এঁদের অধিকাংশই তরুণ— কেউ শিক্ষক, কেউ চিত্রকর, কেউ গায়ক, আবার কেউ সরকারি কর্মী। লেখালিখি যে একটা সম্মিলিত সাধনা বা ব্রতও হয়ে উঠতে পারে, বিরল ক্ষমতায় এত মানুষকে একত্র করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
লোকজীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আগ্রহ ছিল অনিঃশেষ। অনায়াসে মিশে যেতে পারতেন সাধারণ্যে। এক বার তাঁর সঙ্গে কেঁদুলি মেলায় যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। প্রতি বছরের মতো সে বারও সেখানে অনেক বাউল ফকির ও দেশি-বিদেশি কৌতূহলী মানুষের ভিড়। পৌঁছে দেখি সুধীরবাবুর সেখানে অভূতপূর্ব সমাদর। তাঁকে ঘিরে ধরেছেন বাউল-ফকিরেরা। কত গান, কত তত্ত্বকথা আলোচনা ওঁদের সঙ্গে তাঁর! অবাক হয়ে দেখেছিলাম, অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে তিনি তাঁদের সঙ্গে মিশে গিয়েছেন। না, কারণবারি পান করতে হয়নি, গঞ্জিকাসেবনও না। ছাত্রবৎসল শিক্ষক, সভা মাত করা সুবক্তা এবং উচ্চমার্গের লেখক, সব সত্তাকে ছাপিয়ে তখন তিনি মানুষের প্রতি নিবেদিত এক নিরহং প্রেমিক।
আশির দশকে শান্তিনিকেতনের নাট্যঘরে তাঁর একটি বক্তৃতা শোনার সুযোগ হয়েছিল। সে দিনের বিষয় ছিল রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক তিন কবির গান। তাঁর কথায় প্রাণ পেয়েছিল দ্বিজেন্দ্রলাল-রজনীকান্ত-অতুলপ্রসাদের কাব্য ও গায়ন-প্রতিভা। কথার ফাঁকে ফাঁকে সে দিন গানও গেয়েছিলেন। উদাত্ত কণ্ঠ, অপার সুর ও প্রমিত আবেগে বিভোর করেছিলেন সবাইকে। অনুষ্ঠান-শেষে শ্রোতৃমণ্ডলীর সমবেত ‘সাধু, সাধু’ অভিবাদন সে দিন সর্বাংশে সত্য ও স্বতোৎসারিত মনে হয়েছিল।
শেষ দেখা বছর দেড়েক আগে। এক অনামী প্রকাশকের ঐকান্তিক ইচ্ছায় তাঁকে সঙ্গে নিয়ে ওঁর বাড়ি যেতে, তীক্ষ্ণ তীব্র প্রশ্নের বাগাড়ম্বরে না গিয়ে প্রায় বিনা শর্তে তাঁর কয়েকটি বইয়ের পুনর্মুদ্রণের সম্মতি দিয়ে দেন, সে দিনই! গবেষকের রুক্ষতা নেই, বিজ্ঞের শুষ্কতা নেই। ছিল সহজ সুস্মিত আলাপন, মধ্যে মধ্যে বৈদগ্ধের হঠাৎ-আলোর ঝলকানি। আশ্রয় আর প্রশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহাবৃক্ষ।