ছবি: সংগৃহীত
গত কাল (‘অতিমারির পাঠশালা’, ১৮-৮)বলেছিলাম কোভিড-কালের শিক্ষাদানের চ্যালেঞ্জ মেটাতে বৈদ্যুতিন ব্যবস্থার সহায় নিতেই হবে— অনলাইন এবং অফলাইন। বলেছিলাম, একই স্মার্টফোন হয়তো পালা করে অনেক ছাত্র দেখতে পারে।
এখানে একটা কথা দ্বিধাভরে, ধিক্কারের ঝুঁকি ঘাড়ে নিয়ে লিখছি: স্মার্টফোন ভাড়ার কথা ভাবা যায়? যে অভিভাবক কয়েক হাজার টাকার যন্ত্র কিনতে অক্ষম, তিনি হয়তো মাসে দু’-একশো টাকা দিয়ে সপ্তাহে এক-আধ দিন ভাড়া নিতে পারেন; মোবাইল মালিকেরও দুর্দিনে একটা রোজগার হয়। আমপানের পর বহু পঞ্চায়েত-প্রশাসনে যে উন্মুক্ত অসাধুতা দেখা গিয়েছে, তাতে এমন প্রস্তাব করতে বাধে। তবে মনে হয় অনেক জায়গায় শিক্ষকেরা সুষ্ঠু ভাবে সমন্বয়সাধন করতে পারবেন, অভিভাবক সমিতি ও স্থানীয় সমাজের সহায়তায়, যে ছাত্রদের আদৌ সঙ্গতি নেই তাদেরও হিসেবে ধরে।
দরিদ্রতম পল্লিতে এ ব্যবস্থাও খাটবে না, যেখানে তল্লাটে কারও স্মার্টফোন নেই, থাকলেও নাগালের বাইরে। এ ক্ষেত্রে হয়তো ‘লকডাউন স্কুল’-এ বিশেষ অফলাইন ব্যবস্থাই একমাত্র পথ। জেলা স্কুল প্রশাসনগুলির হাতে কিছু ল্যাপটপ ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম থাকার কথা, সমাজসেবী সংগঠনগুলিকেও ডাকা যেতে পারে। শেষ পন্থা হিসেবে পাঠ্যবস্তুর প্রিন্টআউট স্কুলে-স্কুলে পাঠানো যেতে পারে। চ্যালেঞ্জটা কঠিন, তবে প্রশাসন ও স্থানীয় সমাজের সদিচ্ছা থাকলে বোধ হয় অসম্ভব নয়।
উচ্চশিক্ষা সম্বন্ধে ক’টা কথা যোগ করি। এ ক্ষেত্রে কিন্তু ব্যবস্থা হতে হবে কলেজভিত্তিক, বড়জোর কয়েকটি কলেজ মিলে; রাজ্যওয়াড়ি ব্যবস্থা খাটবে না। এই স্তরে কয়েকটা সুবিধা আছে: মোট ছাত্রসংখ্যা কম (যদিও বহু কলেজে শিক্ষকসংখ্যার অনুপাতে বিশাল); উপরন্তু তারা প্রাপ্তবয়স্ক ও স্বাবলম্বী। তবে ন্যূনতম হিসেবেও তাদের পড়ার সামগ্রী বেশি লাগে, অথচ পাঠ্যপুস্তক ক’টাও সব সময় মজুত থাকে না। তার কারণ সর্বদা অর্থাভাব নয়। এ সময় লেখাপড়া চালিয়ে যেতে কিন্তু বইগুলো জোগাড় করতেই হবে, হয়তো খরচটা কয়েক জনে ভাগ করে; কলেজে বুক ব্যাঙ্ক থাকলে অবশ্যই সহায়। এখানে ছাত্রে-ছাত্রে ব্যবধান বিপুল— সরকারি স্কুলব্যবস্থার চেয়ে বেশি, কারণ যে ছেলেমেয়েরা দামি বেসরকারি স্কুলে পড়ে তারাও উচ্চশিক্ষার জন্য আসে সরকারপোষিত প্রতিষ্ঠানে। ফলে শহরের কিছু সমৃদ্ধ কলেজে আন্তর্জাল-সহ সমস্ত সুবিধা অধিকাংশ ছাত্রের নাগালে; যাদের নেই, শিক্ষকরা বণ্টনের একটা ব্যবস্থা করতে পারবেন, এবং ফোনে, ইমেলে বা কদাচিৎ সাক্ষাতে নির্দেশ দিতে পারবেন।
এই নির্দেশনার ব্যবস্থা সর্বত্র সম্ভব হওয়া উচিত। কিন্তু প্রচুর কলেজে, বিশেষত মফস্সলে, বহু ছাত্র রসদের দিক দিয়ে সত্যিই সম্বলহীন, স্কুলছাত্রদের জন্য উপরোক্ত উপায়ের রকমফের তাদেরও অপরিহার্য। তবে কলেজে কম্পিউটার তথা আন্তর্জালের খানিক ব্যবস্থা থাকা উচিত। যদি সেটাও না থাকে, কলেজ স্তরের ছাত্রদের পক্ষে শিক্ষকদের সাহায্যে একটা ব্যবস্থা করতে পারার সম্ভাবনা বেশি।
শেষে দুটো কথা, কোভিড-কাল পেরিয়ে আরও দূরে তাকিয়ে। এক, যে শিক্ষকেরা এখনও কম্পিউটার ও আন্তর্জাল ব্যবহারে অস্বস্তি বোধ করেন, সেটা কাটিয়ে উঠতে এটা তাঁদেরও সুযোগ। একাধিক অধ্যক্ষের কাছে শুনেছি, অনলাইন ব্যবস্থায় আপত্তি ছাত্রদের নয়, শিক্ষকদের একাংশের, বিশেষত কলা বিভাগের প্রবীণ শিক্ষকদের, যদিও তাঁরা পড়ান লেকচারের আঙ্গিকে, যার যান্ত্রিক সম্প্রচার সবচেয়ে সহজ। বিনীত নিবেদন, একুশ শতকে এই অপারগতা কাটিয়ে না উঠলেই নয়।
দ্বিতীয় জরুরি কথা: আন্তর্জালের নাগাল পেলে তার রসদ কিন্তু কম নয়। গুগলের বিশ্বব্যাপী সম্ভার ছেড়ে দিলাম, কেন্দ্রীয় সরকারের সাইটগুলিতে পাঠসামগ্রী যথেষ্ট আছে, যদিও সবগুলি সমান সুগম বা উপকারী নয়। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে স্বয়ম, ই-পিজিপাঠশালা, এনপিটিইএল, সিইসি প্রভৃতি প্ল্যাটফর্মে প্রচুর পাঠ্যবস্তু মজুত আছে। (এদের মধ্যে যোগ দুর্ভেদ্য ও অস্থাবর, তাতে কিছু এসে যায় না।) সেগুলি দেখতে গেলে প্রায়ই অনলাইন কোর্সে নাম লেখাতে হয় (নিখরচায় অবশ্য); তবে সরাসরি ডাউনলোডের সামগ্রীও আছে বেশ কিছু। তার সদ্ব্যবহার করতে গেলে কিন্তু শিক্ষকদের প্রথমে সাইটগুলি দেখা দরকার, তার পর ছাত্রদের সেইমতো পথনির্দেশ করা, হয় তো একটা ‘দর্শনসূচি’ বানিয়ে। স্কুলপড়ুয়াদের জন্য আছে ই-পাঠশালা, মূলত কেন্দ্রীয় বোর্ডের পাঠ্যক্রম অনুসারে, তবে সকলেরই কাজে লাগতে পারে। ছোটদের জন্য আছে ‘প্রথম বুকস’ প্রভৃতি মনোগ্রাহী সাইট, বেসরকারি কিন্তু নিঃশুল্ক। আছে বাংলাদেশের সাইট; তবে পরিতাপের বিষয়, বিদেশি পাঠ্যবস্তু গ্রহণের আবহাওয়া আমাদের অসহিষ্ণু দেশে আজ আছে কি না সন্দেহ।
দেশের মধ্যেও কেন্দ্র-রাজ্য, এ দল ও দল, সরকারি-বেসরকারি, ইত্যাদি বিতণ্ডায় শিক্ষাক্ষেত্র বিদীর্ণ। সেগুলি একপাশে সরিয়ে ই-রিসোর্সের সম্ভার কিন্তু বিবেচনা করতেই হবে। তার কাজের ফর্দ কম নয়: নানা সংস্থার মধ্যে সমন্বয়সাধন, অসংখ্য ফাঁক পূরণ আর মানোন্নয়ন, ধরাবাঁধা অনলাইন কোর্সের খাঁচা থেকে পাঠ্যবস্তু উদ্ধার, অন্য ভাষা থেকে অক্ষম অনুবাদ সংশোধন— সর্বোপরি ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ পেরিয়ে সবার হাতে বিদ্যাবস্তুগুলি পৌঁছে দেওয়া। কোভিডের তাগিদে তথা অবকাশে এ সব নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করলে মন্দ কী? অন্তত এই দিক দিয়ে অতিমারি শাপে বর হোক।
(মূল্যবান মতামতের জন্য সহকর্মী স্যমন্তক দাসের কাছে কৃতজ্ঞ।)
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।