Rabindranath Tagore

‘রবিকাকা সুর বসাচ্ছেন, আমি এস্রাজে’

ভারতীয় সঙ্গীতে এস্রাজের আবির্ভাব আনুমানিক দেড়শো বছরের বেশি। কথিত, বীণা যন্ত্রের আধার থেকে যেমন সেতারের আবির্ভাব, তেমনই সারেঙ্গী ও সেতার যন্ত্রের মিশ্রণে এস্রাজ। যদিও এস্রাজের আবিষ্কর্তা কে, তা নিয়ে মতভেদ আছে। লিখছেন শুভায়ু সেন মজুমদার।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২০ ০১:৪৬
Share:

সঙ্গীতভবনে এস্রাজের ক্লাসে ছাত্রীরা। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গাইছেন, সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এস্রাজ বাজাচ্ছেন এ ছবি রবীন্দ্রানুরাগী মানুষ মাত্রেই দেখে থাকবেন। শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথের কথায়, “...রবিকাকা গান লিখছেন নতুন নতুন, তাতে তখুনি সুর বসাচ্ছেন, আর আমি এসরাজে সুর ধরছি। দিনুরা তখন সব ছোটো—গানে নতুন সুর দিলে আমারই ডাক পড়ত।”

Advertisement

এক সময় অবনীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন, এস্রাজে পাকা বাজিয়ে হবেন, যাকে বলে ওস্তাদ। ঠাকুরবাড়ির তিন জন অবনীন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথ ও অরুণেন্দ্রনাথ তালিম নিতে শুরু করলেন কানাইলাল ঢেরীর কাছে। কেউই ওস্তাদ না হলেও পাকা বাজিয়ে হয়েছিলেন। অরুণেন্দ্রনাথ দীনেন্দ্রনাথের কাকা। দীনেন্দ্রনাথের মা সুশীলা দেবী গান ও অভিনয়ে পারদর্শী। পারিবারিক ভাবেই দীনেন্দ্রনাথ অভিনয়ে, সঙ্গীতে এক ঋদ্ধ উত্তরাধিকার অর্জন করেছিলেন। রাধিকা গোস্বামী ছিলেন তাঁর পিতৃদেবের গানের আসরের বাঁধা গাইয়ে, তাঁর কাছেও তিনি নিয়মিত তালিম নিতেন। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সকল গানের ভাণ্ডারী দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এস্রাজ সহযোগে ছাত্র-ছাত্রীদের গান শেখাতেন, এ কথা অনেকেরই জানা। সে সময় উৎসব অনুষ্ঠানে তাঁর দরাজ গলা এবং এস্রাজ বাদনের সঙ্গে সকলেই পরিচিত। আশ্রমের বাইরে নিকটবর্তী পারুলবনে, খোয়াইধারে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার সময় বা কোনও বিশেষ আনন্দ উৎসবে এস্রাজযন্ত্রটি ছিল দীনু ঠাকুরের নিত্যসঙ্গী। অনেক সময় রবীন্দ্রনাথও তাঁদের সঙ্গী হতেন। সে সময় ব্রহ্মচর্যাশ্রমের ছাত্র প্রমথনাথ বিশীর চোখে দীনেন্দ্রনাথ ছিলেন, ‘উৎসবের প্রতীক, উৎসবরাজ’।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের সুর বেশি সময় মনে রাখতে পারতেন না। তাই তখনই শিখিয়ে দিতেন দীনেন্দ্রনাথকে। তিনি এস্রাজে সেই সুর তুলে স্বরলিপি করে নিতেন। গানটিও চিরদিনের মতো ধরা পড়ে যেত। ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী বলেছেন, ‘স্বরলিপির বিষয়ে দীনেন্দ্রনাথ হলেন ‘সুপ্রিমকোর্ট’।’ ফলে এটা বলাই যায়, সূক্ষ্মভাবে স্বরলিপিকরণেও এস্রাজের বিশেষ ভূমিকা আছে। রবীন্দ্রনাথের সময়ে ঠাকুর বাড়ির অনুষ্ঠানে, গীতি বা নৃত্যনাট্যে কখনও পিয়ানো বা অর্গান বাজিয়ে মহড়া হলেও মূল অনুষ্ঠানের সময় বাজতো দেশি তারযন্ত্র এস্রাজ, তানপুরা। ঠাকুর বাড়িতে মেয়েদের মধ্যে ইন্দিরাদেবী, সরলাদেবী, সুনয়নীদেবীরা এস্রাজ বাজাতে জানতেন। পরবর্তী কালে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথও। ব্রহ্মাচর্যাশ্রমের ছাত্র-শিক্ষকদের কেউ কেউ এস্রাজ বাজাতে জানতেন। দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, শান্তিদেব ঘোষ এবং বিষ্ণুপুর ঘরানার অশেষচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের যুগ পর্যন্ত শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রসঙ্গীতচর্চা ও পরিবেশন কালে অনুষঙ্গ যন্ত্র হিসাবে তানপুরা আর এস্রাজকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

Advertisement

ভারতীয় সঙ্গীতে এস্রাজের আবির্ভাব আনুমানিক দেড়শো বছরের বেশি। কথিত, বীণা যন্ত্রের আধার থেকে যেমন সেতারের আবির্ভাব, তেমনই সারেঙ্গী ও সেতার যন্ত্রের মিশ্রণে এস্রাজ। যদিও এস্রাজের আবিষ্কর্তা কে, তা নিয়ে মতভেদ আছে। আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মত, সঙ্গীত সাধক ঈশ্বরপ্রসাদজী এই যন্ত্রের আবিষ্কর্তা। তাঁর নামানুসারে প্রথমে যন্ত্রটির নাম হয় ইস্‌রাজ। যা বর্তমানে এস্রাজ নামে খ্যাত।

এস্রাজ পর্দা যুক্ত (frade) গায়কী অঙ্গের যন্ত্র। যন্ত্রটিতে অনেকগুলি পর্দা থাকে। প্রধান তার চারটি, সঙ্গে তরফের তার। এস্রাজের বেশ কয়েকটি ঘরানার নাম পাওয়া গেলেও শান্তিনিকেতনে বিষ্ণুপুর ঘরানাই স্বীকৃত। এর মূল কারণ বিষ্ণুপুর ঘরানার দুই কৃতী পুরুষ গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরসূরি অশেষচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের এস্রাজের অধ্যাপক হয়ে সঙ্গীতভবনে যোগদান। গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সুরেন্দ্রনাথও রবীন্দ্রসঙ্গীতের কয়েকটি গানের স্বরলিপি করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, মর্যাদার নিরিখে বিষ্ণুপুর ঘরানা ভারতীয় অন্যান্য রাগসঙ্গীতের সমতুল। পরে বিষ্ণুপু্র ঘরানার দু-এক জন কৃতী এস্রাজ শিক্ষক বিশ্বভারতীর সঙ্গীতভবনে যোগদান করায় তা আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। ফলে, বিশ্বভারতীতে এস্রাজ শিক্ষাদানে বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রভাব বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করা যায়। রবীন্দ্রনাথের নিজের কথায়— ‘বাল্যকালে স্বভাবদোষে আমি যথারীতি গান শিখিনি বটে, কিন্তু ভাগ্যক্রমে গানের রসে আমার মন রসিয়ে উঠেছিল। তখন আমাদের বাড়িতে গানের চর্চার বিরাম ছিল না। বিষ্ণু চক্রবর্তী ছিলেন সংগীতের আচার্য, হিন্দুস্থানী সংগীতকলায় তিনি ওস্তাদ ছিলেন। অতএব ছেলেবেলায় যে-সব গান সর্বদা আমার শোনা অভ্যাস ছিল, সে শখের দলের গান নয়; তাই আমার মনে কালোয়াতি গানের একটা ঠাট আপনা-আপনি জমে উঠেছিল। রাগরাগিণীর বিশুদ্ধতা সম্বন্ধে অত্যন্ত যাঁরা শুচিবায়ুগ্রস্ত তাঁদের সঙ্গে আমার তুলনাই হয় না, অর্থাৎ সুরের সূক্ষ্ম খুঁটিনাটি সম্বন্ধে কিছু কিছু ধারনা থাকা সত্ত্বেও আমার মন তার অভ্যাসে বাঁধা পড়েনি—কিন্তু কালোয়াতি সংগীতের রূপ এবং রস সম্বন্ধে একটা সাধারণ সংস্কার ভিতরে ভিতরে আমার মনের মধ্যে পাকা হয়ে উঠেছিল’।

ফলস্বরূপ দেখা যায়, কালোয়াতি গানের বাঁধাধরা নিয়মের অন্ধ দাস্যবৃত্তির বাইরে বেরিয়ে এসে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন রাগরাগিণীর মিশ্রণে এমন কিছু গান রচনা করেছেন, যা এক কথায় অভিনব এবং অতুলনীয়। এস্রাজ বাদনের সময় সুর ও ভাবের সেই বৈশিষ্টগুলি, তার গমন যেমন প্রকাশ পায়, তেমনই গানে সূক্ষ্ম মীড়ের বা টপ্পার কাজ সহজেই ধরা পরে। বিশ্বভারতীতে এস্রাজ বিষ্ণুপুর ঘরানায় সমৃদ্ধ হলেও মনে হয়, তার বাজন শৈলীতে এক নিজস্ব স্বকীয়তা প্রবাহমান। যার পথিকৃৎ পণ্ডিত অশেষচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। কারণ শান্তিনিকেতনের উৎসব অনুষ্ঠানে, গানে, নৃত্যনাট্য-গীতিনাট্যে তার বাজন শৈলী, গমন তুলনামুলক ভাবে অন্যান্য জায়গার বাজিয়েদের থেকে আলাদা। যন্ত্রটিকে কাঁধে ফেলে বাজানোর রীতি হলেও শান্তিনিকেতনে যন্ত্রটিকে দাঁড় করিয়ে বাজান হয়। এ বিষ্ণুপুর ঘরানার একটি বৈশিষ্ট।

রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রে তানপুরার সঙ্গে এস্রাজেরও বিশেষ মর্যাদা। এই রূপটি শান্তিনিকেতনেই বেশি ধরা পড়ে। রবীন্দ্রসঙ্গীতে অনুষঙ্গ-যন্ত্র হিসাবে এস্রাজের কেন এত প্রাধান্য, এ প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই অনেকের মনে আসতে পারে। এ প্রসঙ্গে বিশ্বভারতীর এস্রাজের প্রাক্তন অধ্যাপক পণ্ডিত রণধীর রায় বলেছিলেন, ‘এস্রাজ কেবল রবীন্দ্রসঙ্গীত জগতে নয় যে কোনও সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তার প্রয়োজনীয়তা আছে।... এস্রাজ তো বহুকাল ধরেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের সার্থক আনুষঙ্গ যন্ত্র হিসাবে সমাদৃত।...রবীন্দ্রসৃষ্টির স্বাতন্ত্র্যে, সম্পূর্ণতায় অনুষঙ্গ যন্ত্র রূপে এস্রাজ সার্থক হয়ে উঠেছে—লাভ করেছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের মাধুরী মেশানো চরিত্র। তাই দেখতে পাই, সেই সব গানের সঙ্গে বেজে ওঠে না আনন্দলহরী, একতারা, ঘুঙুর করতাল। বাজে এস্রাজ’।

অশেষচন্দ্রের সুযোগ্য শিষ্য রণধীর রায়ের সৃজনশীল চিন্তাভাবনা ও কঠোর পরিশ্রমের ফসল, আজকের বড় এস্রাজ যন্ত্র, যা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রে সেতার, সরোদ, বেহালা প্রভৃতি যন্ত্রের সমগোত্রীয়। রণধীর এস্রাজকে কখনও রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুষঙ্গ যন্ত্র হিসাবে বিচার করেননি। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি এস্রাজকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে স্বাধীন যন্ত্ররূপে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তাঁর সেই ইপ্সিত ইচ্ছার সার্থক রূপায়ণই আমাদের লক্ষ্য। আমার গুরু, সঙ্গীতভবনের অধ্যাপক পণ্ডিত বুদ্ধদেব দাস রণধীর রায়ের সুযোগ্য শিষ্য। তিনিও এই যন্ত্রটির প্রচারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। এখন তো বেতারে, দূরদর্শনে নিয়মিত ভাবে শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের আসরে একক ভাবে এস্রাজ বাদন শোনা যায়।

এস্রাজের জনপ্রিয়তা বাড়ছে দেখে উৎসাহ পাই। ভারতবর্ষ তো বটেই, পৃথিবীর যে প্রান্তে গিয়েছি, দেখেছি এস্রাজে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুর, বিভিন্ন রাগের নিপুণ মূর্চ্ছনা, ভাব তার সঙ্গে যন্ত্রের বাজন শৈলী, শ্রোতৃবৃন্দ যেমন মুগ্ধ হয়েছেন তেমনই এস্রাজের নবকলেবর সুন্দর রূপটিও প্রশংসা পেয়েছে। আজ পণ্ডিত রণধীর রায় সৃষ্ট নতুন কাঠামো যুক্ত এস্রাজ যন্ত্রটি সেতার, সরোদ, বেহালার মতো শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতে বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। আশা, আগামী দিনে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতে এস্রাজে ভাল ভাল শিল্পীর আবির্ভাব ঘটবে। বিশ্বভারতীতে যেমন ক্লাসিকাল এস্রাজে ডিগ্রি ও মাস্টার্স কোর্স আছে, তেমনি সাবসিডিয়ারি বিষয় হিসাবে ছাত্রছাত্রীরা এস্রাজ নিতে পারে। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে যা খুবই প্রয়োজন বলে মনে করি। রবীন্দ্রনাথের বিশেষ পছন্দের এই যন্ত্রটিকে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দিতে একমাত্র বিশ্বভারতীতে এস্রাজ বিষয় নিয়ে পঠনপাঠন ও গবেষণার সুযোগ আছে।

লেখক বিশ্বভারতীর সঙ্গীতভবনের অধ্যাপক, মতামত নিজস্ব

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement