কেবলমাত্র সনিয়া গান্ধীর কথাতেই মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে নিজের দাবি ছেড়ে দিলেন ডোড্ডালাহাল্লি কেম্পেগৌড়া শিবকুমার? ফাইল চিত্র।
কেবলমাত্র সনিয়া গান্ধীর কথাতেই মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে নিজের দাবি ছেড়ে দিলেন ডোড্ডালাহাল্লি কেম্পেগৌড়া শিবকুমার? না কি তিনি জানেন, তিনি মুখ্যমন্ত্রী হবেন কি না, সত্যিই সিদ্দারামাইয়া আড়াই বছর পরে তাঁর জন্য মুখ্যমন্ত্রীর আসন ছেড়ে দেবেন কি না, সেগুলো প্রশ্নই নয়— কবে কর্নাটকে কংগ্রেস জিতলে তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্ব স্বতঃসিদ্ধ হবে, প্রশ্ন শুধু সেটুকুই? কলেজ রাজনীতি থেকে উল্কাগতিতে উত্থান হয়েছে তাঁর। মাত্র ২৭ বছর বয়সে বিধায়ক হয়েছিলেন, তার পর থেকে টানা জিতেছেন বিধানসভা নির্বাচনে। ২৫ বছর বয়সে— যেটুকু বয়স না হলে ভারতে ভোটে দাঁড়ানোই যায় না— লোকসভা নির্বাচনে লড়েছিলেন মহীরুহসম এইচ ডি দেবগৌড়ার বিরুদ্ধে। হেরেছেন, পরের নির্বাচনে আবার দাঁড়িয়েছেন। আবারও হেরেছেন। হাল ছাড়েননি। ২০০৪-এ রাজনীতিতে নবাগত সাংবাদিক তেজস্বিনী শ্রীরমেশকে জিতিয়ে আনলেন দেবগৌড়ার বিরুদ্ধে, বিপুল ভোটে। দশ জনপথ অবধি বার্তা বিলক্ষণ পৌঁছেছিল— কর্নাটকের রাজনীতির মঞ্চে অবতীর্ণ এমন এক জন, ‘অসম্ভব’ শব্দটিতে যাঁর নিতান্ত অরুচি।
তত দিনে অবশ্য ‘রাজনীতির রিসর্ট-ম্যান’ হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছেন ডি কে। ২০০২ সালে মহারাষ্ট্রে মুখ্যমন্ত্রী বিলাসরাও দেশমুখ আস্থাভোটের মুখোমুখি— আশঙ্কা, বিস্তর ঘোড়া কেনা-বেচা হবে। বেঙ্গালুরুর উপকণ্ঠে নিজের রিসর্টে কংগ্রেস বিধায়কদের এনে রাখলেন ডি কে। একেবারে আস্থাভোটের দিন সকালে পৌঁছে দিলেন মুম্বইয়ে। এর পর দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে যখনই কংগ্রেসের প্রয়োজন পড়েছে বিধায়কদের ‘নিরাপদ’-এ রাখার, ডি কে ত্রাতার ভূমিকায়। ২০১৮ সালে রাজ্যে ত্রিশঙ্কু বিধানসভায় কংগ্রেসের বিধায়কদের রক্ষা করার ঘটনাতেই হোক, অথবা গুজরাতে রাজ্যসভার নির্বাচনের আগে কংগ্রেস বিধায়কদের আড়াল করতে, ডি কে শিবকুমার ও তাঁর রিসর্টের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অবশ্য, শুধু নিজের দলের বিধায়কদের ক্ষেত্রেই নয়, ২০১৬ সালের রাজ্যসভা ভোটে যে সাত জেডি(এস) বিধায়ক দলের নির্দেশ অমান্য করে ভোট দিয়েছিলেন বিরোধী প্রার্থীকে, তাঁদের পিছনেও ছিলেন শিবকুমার।
সদ্য ৬১ বছর পূর্ণ করা এই ভোক্কালিগা নেতা দেশের অন্যতম ধনী রাজনীতিক, তাঁর ঘোষিত সম্পদের পরিমাণ ১৪০০ কোটি টাকা। রিসর্ট ছাড়াও তাঁর ব্যবসা রয়েছে খনি, শিক্ষা, কৃষি জমি ইত্যাদির। বিতর্কও রয়েছে বিপুল। নরেন্দ্র মোদীর আমলে বিরোধী দলের এমন এক ডাকাবুকো নেতার বাড়িতে আয়কর হানা দেবে, তা এক রকম স্বয়ংসিদ্ধ। কিন্তু তার বাইরেও শিবকুমারের বিরুদ্ধে হরেক অভিযোগ— বে-আইনি ভাবে জমি দখলের, পরিবেশ বিধির তোয়াক্কা না করার, এবং অতি অবশ্যই, বাহুবল প্রয়োগের। রাজ্য রাজনীতিতে তিনি পরিচিত ছিলেন কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণর অতিঘনিষ্ঠ, রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হিসাবে। কৃষ্ণ দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন, শিবকুমার তাঁর অনুগামী হননি। থেকে গিয়েছেন সিদ্দারামাইয়ার সঙ্গে, যিনি আগাগোড়া দূরত্ব বজায় রেখেছেন শিবকুমারের সঙ্গে। রামমনোহর লোহিয়ার অনুগামী সিদ্দারামাইয়া কর্নাটকের সেই তিন প্রবীণ নেতার অন্যতম, একদা ভোটে জিততে শুধু যাঁদের নামই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু অন্য দু’জন, যথাক্রমে জেডি(এস)-এর এইচ ডি দেবগৌড়া এবং বিজেপির বি এস ইয়েদুরাপ্পার সঙ্গে সিদ্দারামাইয়ার ফারাক, তাঁর গায়ে দুর্নীতির কলঙ্ক লাগেনি তেমন। সেই কারণেই বিতর্কিত ডি কে-র সঙ্গে দূরত্ব রাখার বিষয়ে সচেতন ছিলেন তিনি।
তার পরও ডি কে তাঁর সঙ্গে থেকেছেন, নির্বাচনী প্রচারপর্বে যাবতীয় বিরোধ সরিয়ে রেখে সিদ্দারামাইয়ার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলেছেন। নেহাতই বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে পর্যদুস্ত করার সদিচ্ছায়? না কি, তিনি জানতেন, বাসবরাজ বোম্মাইয়ের বিজেপি সরকারকে যদি দুর্নীতির অস্ত্রে ঘায়েল করতে হয়, এবং যদি জাতপাতের গণ্ডি টপকে ভোট পেতে হয়, এখনও সিদ্দারামাইয়ার বিকল্প নেই? তিনি ভোটযন্ত্র সামলাতে জানেন, কিন্তু রাজ্যব্যাপী জনসমর্থন আদায়ের জন্য এখনও সিদ্দারামাইয়া তাঁর চেয়ে এগিয়ে? এ কথাটা বোঝা, এবং ব্যক্তিগত অহং সরিয়ে বৃহত্তর রাজনীতির ছবিটাকে স্পষ্ট দেখতে পাওয়ার ক্ষমতা কংগ্রেসে সুলভ নয়। ভোটে জেতার পর ডি কে প্রকাশ্যেই বলেছেন যে, তিনি চান এই জয়ের পিছনে তাঁর ভূমিকাটি স্বীকৃতি পাক। সেই স্বীকৃতি মিলেছে উপমুখ্যমন্ত্রী পদপ্রাপ্তির মাধ্যমে। মন্ত্রিসভাতেও তাঁর অনুগামীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। ডি কে শিবকুমার সম্ভবত জানেন, রাজনীতি একশো মিটারের দৌড় নয়, ম্যারাথন।
রাজ্য রাজনীতিতে তাঁর উত্থানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে তাঁর প্রতি দশ জনপথের নির্ভরশীলতাও। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, ২০১৯ সালে কর্নাটকে বিধানসভা উপনির্বাচনে কংগ্রেসের দলত্যাগী বিধায়করা বিজেপির টিকিটে জিতে আসার পর দীনেশ গুন্ডু রাও দলের রাজ্য সভাপতির পদ ছাড়ার পর বহুবিধ আপত্তি সত্ত্বেও পদটি পেয়েছিলেন ডি কে। সেই ভরসার মূল্য তিনি দিয়েছেন। অদূর ভবিষ্যতে শুধু রাজ্য রাজনীতিতে নয়, কংগ্রেসের সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর গুরুত্ব বাড়বে, এ কথাটিও সম্ভবত পড়ে নিতে পেরেছেন ডি কে। সিদ্দারামাইয়াকে মুখ্যমন্ত্রীর পদটি ছেড়ে দিয়ে সেই লক্ষ্যের দিকে আরও এক পা এগিয়ে গেলেন তিনি।