১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর বাবরি ধ্বংসের এক দশক পর ২০০২-এ গুজরাত গণহত্যার ঘটনা। এমন নয় যে সত্তর বছরের গণতান্ত্রিক ভারতের এই দু’টিই একমাত্র সাম্প্রদায়িক কলঙ্কজনক ঘটনা। বস্তুত, দেশের কোথাও না কোথাও কখনও না কখনও জাতিদাঙ্গা বা সাম্প্রদায়িক হানাহানি হয়েই এসেছে। কিন্তু একটি দশকের ফারাকে ঘটে যাওয়া ওই দু’টি ঘটনা যে ভাবে আসমুদ্রহিমাচল কাঁপিয়ে সাধারণ মানুষকে হতবাক করে দিয়েছে, তেমনটি আগে হয়নি। তার পরের ইতিহাস কারও অজানা নয়। ক্রমাগত ঘৃণা আর হিংসার রাজনীতি হাত ধরাধরি চলতে চলতে সহাবস্থান আর সমানাধিকারের ধারণাই লুপ্ত হতে বসেছে। রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতার ঘোষণাই খারিজ হয়ে যাওয়ার দাখিল।
তিস্তা সেতলবাদের স্মৃতিচারণ (ফুট সোলজার অব দ্য কনস্টিটিউশন, লেফটওয়ার্ড) পড়তে পড়তে সময়ের প্রলেপ পড়া এই ইতিহাস চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এটাও মনে হয়, অনতিঅতীতে চোখের সামনে ঘটা ঘটনার বাইরেও অনেক ঘটনা থেকে যায়, ইতিহাস হিসেবে তার দামও কম নয়।
যেমন অযোধ্যায় যখন মসজিদ ভাঙা হচ্ছিল, তখন মুম্বইতে সাংবাদিকতা করছিলেন তিস্তা। মসজিদ ধ্বংসের অব্যবহিত বহিঃপ্রকাশ ঘটে মুম্বই-হিংসায়। সাংবাদিক হিসেবে খুব কাছ থেকে অবাধে এই হিংসার রূপ আর তার উৎসমুখের সন্ধান করার সুযোগ পান। এ কাজই সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাসে আকৃষ্ট করবে তিস্তাকে, এবং গুজরাত গণহত্যার পর রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা দেবে।
এক দিকে সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতাবাদের নতুন ভাষা তৈরি করছিল রাষ্ট্র, অন্য দিকে তৈরি হচ্ছিল প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের পদাতিক বাহিনী। যারা কিনা শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ে আস্থা রেখে মানুষের অধিকার অর্জনের আর গণতন্ত্রের পথ সুগম করে।
যে কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পক্ষেই সংবিধান মেরুদণ্ডের মতো। গণতন্ত্রকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে সংবিধানকে যথার্থ মান্যতা দিতেই হবে। কারণ সংবিধান সমাজ আর রাষ্ট্রের মধ্যে সেতুর কাজ করে। নাগরিকের অধিকার স্থির করার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের লাগামহীন স্বেচ্ছাচারিতায় বাঁধ দেয়। আজকের ভারতবর্ষে প্রতিনিয়ত সংবিধান লঙ্ঘন করা ক্ষমতা প্রদর্শনের সহজতম উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংবিধানে আস্থা রেখে শপথ নেন যাঁরা, সংবিধান লঙ্ঘনে তাঁরাই অগ্রণী। রাজনীতির এই ভূমিকা সমাজকে ক্রমশ অসহিষ্ণু করে তোলে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
তিস্তার লড়াই তাই কেবল মানবাধিকার রক্ষার লড়াই নয়। সমাজ সংস্কারেরও লড়াই।
আমাদের সদ্য-স্বাধীন দেশে যখন সংবিধান তৈরি হয়েছিল, তখন ভবিতব্যের সবটা সুদূর কল্পনাতেও বোঝা সম্ভব ছিল না। কিন্তু দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া আর জাতিভেদে আক্রান্ত বহু ধর্ম ও সংস্কৃতির ধারক ভারতবর্ষের সমাজ এবং তা থেকে উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সংবিধান রচনাকারীদের জ্ঞান এতটাই স্পষ্ট ছিল যে সত্তর বছর পরের সমস্যারও ইঙ্গিত আছে সংবিধানের পাতায়। ব্যক্তির সুরক্ষার অর্থ যে তার বাক্স্বাধীনতার সুরক্ষা, অনেক আগে তাঁরা সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। আজ যখন শাসকের যে কোনও সিদ্ধান্তকে সমর্থন না করাই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের সমান হিসেবে গণ্য করার রেওয়াজ হয়েছে, তখন সংবিধান এক নির্বিকল্প রক্ষাকবচ। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন
বলেই সম্ভাব্য বিপদ এড়াতে বিভিন্ন স্বশাসিত সংস্থার ব্যবস্থা করেছিলেন সংবিধান প্রণেতারা। এই সংস্থাগুলি সংবিধান তথা গণতন্ত্রের সেফটি ভালভ-এর কাজ করে।
তাই প্রথম আঘাত এসেছে এই সেফটি ভালভ-এর ওপর। কী রাজ্য, কী কেন্দ্র, জনসাধারণের সামাজিক আর রাজনৈতিক পরিসর সঙ্কুচিত করে ফেলার ভয়ঙ্কর অসাংবিধানিক ও গণতন্ত্রবিরোধী প্রবণতায় আজ গোটা শাসনব্যবস্থা আক্রান্ত। তিস্তার লড়াইয়ের স্মৃতিচারণ তারই দলিল। আর সেখানেই এই সময়ের প্রেক্ষিতে বইটির প্রাসঙ্গিকতা।
অনেক ঘটনা, যা আমরা খবরে দু’চার কথা জেনেছি, বইয়ে তার পূর্ণাঙ্গ রূপটি ধরা আছে। তিস্তার লড়াই একেবারে সরাসরি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে।
মানবাধিকার রক্ষা করেই যে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে, সেই প্রাথমিক সাধারণ সাংবিধানিক পাঠে তিস্তা ক্ষমতার আস্ফালনের বিরুদ্ধে দ্বিধাহীন।
এই দ্বিধাহীনতার জোর এই বইয়ের জোরের জায়গা। দুর্বলতারও। দক্ষ সাংবাদিকতার কলমে তাঁর যাত্রার অনেক কথাই এসেছে, তুলনায় নিজের সঙ্গে নিজের দ্বন্দ্বের কথা প্রায় নেই। বাইরের লড়াইয়ের সঙ্গে নিজের উত্তরণের কাহিনির স্পর্শ থাকলে তা পাঠকের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠতে পারত।