সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত এক শ্রীময় শিক্ষার আদর্শেই কলাভবন

অন্য পৌরুষের খোঁজে

১৯০১ সালে বিজ্ঞানী-বন্ধু জগদীশচন্দ্রকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতনে তিনি একটি বিদ্যালয় খোলার বিশেষ চেষ্টা করছেন। প্রাচীনকালের গুরুগৃহবাসের মতোই হবে সেখানে সমস্ত নিয়মকানুন।

Advertisement

বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৮ ০১:১২
Share:

রবীন্দ্রনাথের ইস্কুলের কথা উঠলেই আম বাঙালি নাচে-গানে ভরপুর, বৃক্ষতলে সকাল দুপুর এমন এক জায়গার কথা ভেবে বিভোর হন। এ বাঙালির স্বভাব। সহজ, স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক বলতে যে ‘তাতা-থৈথৈ’ ফাঁকিবাজিকে বোঝায় না এই কাণ্ডজ্ঞান যদি বাঙালির থাকত! নেই বলেই, রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিষ্ঠান নিয়ে কী ভাবছিলেন বিশ্বভারতীর কলাভবনের শতবর্ষ উদ্‌যাপনের এই সময়টিতে তা আর এক বার মনে করে নেওয়া ভাল।

Advertisement

১৯০১ সালে বিজ্ঞানী-বন্ধু জগদীশচন্দ্রকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতনে তিনি একটি বিদ্যালয় খোলার বিশেষ চেষ্টা করছেন। প্রাচীনকালের গুরুগৃহবাসের মতোই হবে সেখানে সমস্ত নিয়মকানুন। ‘‘ছোটবেলা হইতে ব্রহ্মচর্য না শিখিলে আমরা প্রকৃত হিন্দু হইতে পারিব না।’’ তা হলে কি ব্রহ্মচর্যের হিঁদুয়ানিতেই আটকে গিয়েছিলেন তিনি? মোটেই না। প্রকৃত হিন্দু অথবা খাঁটি হিন্দু গড়ে তোলার এই বাসনা কিছু দিন যেতে না যেতেই ত্যাগ করেছিলেন। খাঁটি হিন্দুর পিছুটান কেটে গিয়েছিল। সে ইতিহাসের ছায়া হয়তো এক ভাবে ‘গোরা’ উপন্যাসে পড়েছিল। আর, একবগ্‌গা রেজিমেন্টেড ইস্কুল তৈরি হলে তার মাস্টার ও ছাত্রদের চেহারা কেমন হতে পারে এবং রাষ্ট্র অথবা শাসক সেই পড়ুয়াদের কী ভাবে ব্যবহার করতে চাইতে পারে তা-ও দেশবিদেশ ঘুরে বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। ভয়ঙ্কর এক যুদ্ধকামী বিদ্যালয়ের ছবি আছে রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ নাটকে। নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ ‘দি ওয়াটারফল’, তাঁর নিজেরই করা। ইংরেজি সংলাপ বাংলার থেকেও অনেক বেশি চোখা ও রাজনৈতিক। স্কুলমাস্টার ছেলেদের শিখিয়েছে তারা মহৎ জাতির বংশধর। তাদের পূর্বপুরুষদের ছিল খাড়া নাক। খাড়া নাক জাতি-গরিমার নিশান। আর "And what is the mission of the greater races?" ছেলেরা মাস্টারের সুরে সুর মিলিয়ে বলে, "They conquer the world for themselves." আহা, নিজেদের জন্য অন্যের ভূখণ্ড ছিনিয়ে না নিলে জাতিগরিমাদীপ্ত নেশনের কি চলে! খাড়া নাকের মর্যাদাই তো থাকে না। রেজিমেন্টেড শিক্ষাব্যবস্থা তো এই পুরুষালি, ছিনিয়ে নেওয়ার মন্ত্রই ক্রমাগত জপতে থাকে পড়ুয়াদের কানে। মেয়েদেরও ‘পুরুষালি’ করে তুলতে চায়। সঙ্কীর্ণ হিন্দুত্বের রাষ্ট্রবাদী রাজনৈতিক লক্ষ্যমুখী ইস্কুল কি এ কালে এ দেশে চোখে পড়ে না?

রবীন্দ্রনাথ কখনও চাইতেন না তাঁর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পড়ুয়ারা এমন হোক। চাইতেন না বলেই তাঁর নজর পাঠ্যসূচির ওপর— চাই অন্য রকম বিদ্যাবিবেচনা ও বোধের আয়োজন। এ দেশের সাদা-সাহেবরা শিক্ষার যে পাঠ্যসূচি তৈরি করেছিলেন তা নানা কিসিমের ছোটবড় কেরানি তৈরি করার জন্য চমৎকার। শুধু কেরানি হওয়ার বাসনা অতিক্রম করতে পেরেছিলেন বলেই অবশ্য উনিশ শতকের বহু বাঙালি সাহেবি প্রতিষ্ঠানের জোয়াল ঠেলেও স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত। রবীন্দ্রনাথের নিজের কিন্তু এই সব ঔপনিবেশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না-পসন্দ। দাদা সত্যেন্দ্রনাথের মতো ব্যবস্থার মধ্যে থেকে ব্যবস্থাকে ডিঙিয়ে যাওয়ার লড়াই তাঁর নয়। নিজের মতো বিকল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার বাসনা জেগে ওঠে তাঁর। সাহেবি শিক্ষা ব্যবস্থার বিরোধিতা করতে গিয়ে অনেকের মতোই রবীন্দ্রনাথ উল্টো দিকের খাঁটি হিন্দুত্বের ফাঁদে পড়ে যাচ্ছিলেন প্রথম দিকে। পড়ে যে গেলেন না, তার কারণ তাঁর সচল ‘অনাগারিক’ মন। কোনও আগার অর্থাৎ দেওয়ালের সীমায় নিজের মনকে আটকে না রেখে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ চেহারা দেখে তিনি বুঝেছিলেন, নেশনের বিষবাষ্পের বাইরে আসতে হবে। আর তাই তাঁর উগ্র জাতীয়তাবাদ বিরোধী বক্তৃতানিবন্ধ, বিশ্বভারতী নামক শিক্ষাদর্শের কল্পনা ও নির্মাণ-উদ্যোগ, শিক্ষালয়ের পাঠ্যক্রমে কলা-সঙ্গীত বিদ্যার আয়োজন পরস্পর সম্পর্কিত। এই সমসাময়িক প্রচেষ্টাগুলি নিতান্ত ফাঁকিবাজি শখ নয়, হঠাৎ জাগা ইচ্ছে নয়।

Advertisement

২৪ পৌষ ১৩১৯-এ আমেরিকার আরবানা থেকে অসিতকুমার হালদারকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘‘আমার অনেক দিনের ইচ্ছে, বোলপুরে চিত্রবিদ্যাটা বেশ একটু ভাল করেই শেখানো হয়। ঐ সঙ্গে সঙ্গীতটাও চলে। কিন্তু আজ পর্যন্ত লক্ষ্মী সদয় হলেন না— টাকার টানাটানি কিছুতেই ঘুচল না— মনের সাধ মনেই রয়ে গেল।’’ কেন তাঁর এই সাধ? কলাবিদ্যা আর সঙ্গীত, এই দুইয়ের শিক্ষা মানুষের লড়াকু লোভী মনকে যে বদলে দিতে পারে এই বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের ছিল। কলাবিদ্যা আর সঙ্গীত প্রথাগত চাকরিমুখী বিদ্যা নয়। শিক্ষালয় যে কেবল উপযোগবাদী প্রায়োজনিক শিক্ষা দেবে তা-ও রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন না। ১৯১৯-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন বসেছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তো ঔপনিবেশিক ভারতে প্রয়োজনমুখী শিক্ষার উৎপাদক। সেই শিক্ষাও তখন চাকরিপ্রদ নয়। স্যাডলার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের রিপোর্টে লিখেছিলেন, এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পড়ুয়ারা ‘ইন্টেলেকচুয়াল প্রোলেতারিয়েত’। বিদ্যা আছে, বিত্ত নেই, চাকরি নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিদ্যালয়ের শিক্ষায় চাকরি ও বিত্তের বিষয়টিকে রাষ্ট্র-প্রশাসন ইত্যাদির সূত্রে বিচারই করছিলেন না। তাঁর বিদ্যালয় ব্যবস্থায় উপার্জন বিষয়টিকে সামাজিকতার দিক দিয়ে বুঝতে চাইছিলেন। আমাদের ভারতীয় সমাজের গঠন ও প্রয়োজনের সঙ্গে বিদ্যা ও শিক্ষার যেন যোগ থাকে। আবার সেই সমাজমন যেন কেবল প্রয়োজনের দেওয়ালে আটকা না পড়ে, সমাজজীবনে অপ্রয়োজন ও আনন্দের গুরুত্ব স্বীকার করে। কৃষক তো কলুর বলদের মতো চোখ বাঁধা শ্রমিক নন। চাষ করতে গিয়ে তিনি গান করেন। কৌমসমাজের মানুষ তাঁদের গোলাঘরের দেওয়ালটি সহজ আলপনায় সাজিয়ে তোলেন। এই অবকাশ আর ফাঁকগুলি আছে বলেই প্রতি মুহূর্তে সামাজিক মানুষ অপরের সঙ্গে ছিলা-টান লড়াইয়ে যোগ দেন না, নিজেদের জীবনে তৃপ্ত থাকেন। সমাজের এই চরিত্রটি চিনতে পেরেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষালয়ে অঙ্কন ও সঙ্গীতবিদ্যার আয়োজন করতে চেয়েছিলেন।

চিত্রবিদ্যা ও সঙ্গীত প্রকৃতির সঙ্গে পড়ুয়াদের সহজ যোগ সাধন ঘটাতে পারে। অসিতকুমার হালদার নন্দলালকে শান্তিনিকেতন থেকে চিঠি লিখতেন। ১৯১৫ সাল থেকে অসিতকুমার-নন্দলাল সচিত্র কার্ড বিনিময় শুরু হয়েছিল। নন্দলালের কার্ডে আটকা পড়া শিল্পীর ছবি। ছিপ দিয়ে খেলিয়ে টাকা গাঁথবার চেষ্টা করছেন চিত্রকর। আর অসিত হালদারের সচিত্র কার্ডে ‘শান্তিনিকেতনে ছাত্রদের পাঠ পড়ার ছত্র’, রবীন্দ্রনাথের দেহলী বাড়ি, মঞ্জু-মালতীর একাংশ। খোড়ো চালের সে আলয় আকাশ-আঁচড়া বাড়ির নাগরিক স্পর্ধার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। নন্দলাল রবীন্দ্রনাথের শিক্ষালয়ে যোগ দিলেন। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘‘১৯১৯ সনে পূজার ছুটির পর নন্দলাল বসু আসিয়া শান্তিনিকেতনের কার্যে যোগ দেওয়াতে… বিশ্বভারতীর কলাভবনের সূচনা দেখা গেল।’’ ১৯১৯ জালিয়ানওয়ালাবাগের রাষ্ট্রীয় হত্যারও বছর, রবীন্দ্রনাথের নাইট উপাধি ত্যাগেরও বছর। রামকিঙ্কর আর বিনোদবিহারীর সাক্ষ্য থেকে দেখি, নন্দলাল মাঝে মাঝেই ছাত্রদের ছবি আঁকার সময় পাশে রেখে দিতেন টাটকা প্রকৃতির নিশান। বিনোদবিহারী লেখেন, ‘‘বৈজ্ঞানিক যুগের মানুষের জীবন প্রকৃতির থেকে বিচ্ছিন্ন। পশু-পক্ষী, কীটপতঙ্গ, গাছ, ঝড়জল, প্রাকৃতিক দুর্যোগ সবকিছুকে বিজ্ঞান পোষ মানিয়ে নিজের কাজে লাগিয়েছে।’’ প্রকৃতিকে পোষ মানিয়ে নিজেদের কাজে লাগাতে গেলে কী সর্বাত্মক ধ্বংসের মুখোমুখি হতে হয় তা উন্নয়নবাদী গোলকায়িত পৃথিবী উত্তরোত্তর টের পাচ্ছে। কলাবিদ্যা আর সঙ্গীত প্রকৃতিকে পোষ মানিয়ে শুধু কাজে লাগানোর শিক্ষার বিরোধিতা করত।

এ যে সবাই মেনে নেবেন তা তো নয়। দেশের আমজনতার মনে নানা দ্বিধা। এ জাতীয় বিদ্যা মেয়েলি, এমন কথা বলতেও ছাড়েনি মানুষ। রবীন্দ্রনাথকে বিদেশের উদাহরণ দিয়ে লিখতে হল, ‘‘এই সকল ললিতকলা শিক্ষা দ্বারা... পৌরুষ খর্ব হইতেছে’’ এমন প্রমাণ হয় না। লিখতে হল, ‘‘বিশ্বভারতী যদি প্রতিষ্ঠিত হয় তবে ভারতীয় সঙ্গীত ও চিত্রকলা শিক্ষা’’ তার প্রধান অঙ্গ হবে। ১৯০১’এ যে হিন্দুর কথা ভাবছিলেন রবীন্দ্রনাথ, এই ভারত সেই হিন্দু ভারত নয়। নানা ভারত এসে মিলে মিশে গিয়েছে। বিনোদবিহারী একপাল মোষের ছবি আঁকছেন। এক সাঁওতাল মেয়ে বললে, ‘‘এতগুলো কেড়া (মহিষ) দিলি, আর একটা বাচ্চা দিলি না?’’ ছাত্র সত্যজিৎকে বিনোদবিহারী বলেছিলেন, ‘‘এক মন্তব্যে ছবিটার একটা বড় ত্রুটি বাতলে দিল।’’ এই যে ভারতীয় চোখ, মানুষের চোখ, মেয়েদের শ্রীময় দৃষ্টি— কেজো ঔপনিবেশিক শিক্ষালয়ের পুরুষালি পড়ুয়ারা তার খোঁজ রাখত না। রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষ আগে এই শ্রীময় বিদ্যাচর্চায় শিক্ষালয়কে সমাজের সঙ্গে যোগ করার যে আয়োজন করেছিলেন, পৌরুষকে ভিন্নার্থে নির্মাণের যে চেষ্টা করেছিলেন, ঘর থেকে মেয়েদের শিক্ষাঙ্গনে নিয়ে আসার যে আহ্বান করেছিলেন, শান্তিনিকেতনের কলাভবনে সে ধারা এখনও বিগত হয়নি।

বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement