হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য। ফাইল ছবি
এখন পণ্ডিত মহলের বাইরে বইটির প্রচার ও প্রসার তেমন চোখে পড়ে না। তবে এই মুহূর্তে যখন বেশ কিছু ধারণার ‘পুনর্গঠন’ চলছে তখন এই বইটির গুরুত্ব বলার অপেক্ষা রাখে না। এই বইটির প্রসঙ্গে ‘বোম্বাই বিচিত্রা’ তাদের শারদ সংখ্যায় লিখেছিল, ‘বাংলা ভাষায় হিন্দুদের দেবদেবীদের নিয়ে এমন ব্যাপক গবেষণা বোধ করি এই প্রথম। .... হিন্দু দেবদেবী সম্পর্কে বহুতর ভ্রান্ত ধারণা নিরসনের সহায়ক এই গ্রন্থটি কৌতূহলী পাঠকের কৌতূহল নিরসনে সহায়তা করবে সে কথা নিশ্চিত।’ এ বিষয়ে সুকুমার সেন বলেছিলেন, ‘‘The work entitled ‘hinduder DevDevi: Udvab O Krombikash’ by Dr. Hangsanarayan Bhattacharya, M. A. appeals to me a very serious treatment of an important topic of our cultural heritage’’
বর্ধমানে জন্ম নেওয়া গবেষক হংসনারাযণ ভট্টাচার্য। হয়তো সে ভাবে তিনি আলোচনার কেন্দ্রে বিচরণ করেননি। কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামের পণ্ডিত বংশের এই সন্তান তাঁর পাণ্ডিত্য ও মেধার নিদর্শন রেখে গিয়েছিলেন ‘হিন্দুদের দেবদেবী: উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ’ এই বইটির মধ্যে। তিন খণ্ডে সম্পূর্ণ হওয়া এই কাজটি পণ্ডিতমহলে আজও সমান আদরণীয়।
অধুনা পূর্ব বর্ধমানের কালনা মহকুমার মীরহাট বা বৈদ্যপুর গ্রামে ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে তাঁর জন্ম। অসাধারণ মেধার অধিকারী হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য সংস্কৃত, বাংলা ও প্রাচীন ভারতীয় ভাষার ইতিহাস বিষয়ে স্নাতকোত্তর পাশ করেন। ১৯৬৬ সালে যাত্রাগান নিয়ে তিনি পিএইচডি করেন। তিনি গবেষণা করেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তার পরে দীর্ঘ ৩৪ বছর নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর মহাবিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছিলেন।
বইটির তৃতীয় পর্বের প্রচ্ছদ। ফাইল ছবি
হংসনারায়ণের বাবা ছিলেন সিদ্ধেশ্বর ভট্টাচার্য। মা নারায়ণী দেবী। স্ত্রী সন্ধ্যারানি। এক মেয়ে, দুই ছেলের বাবা হংসনারায়ণ কর্মসূত্রে ছিলেন নবদ্বীপবাসী। কিন্তু তাঁর জন্মস্থান বর্ধমানের সঙ্গে ছিল তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের পুত্রসম ছাত্র শান্তিরঞ্জন দেব জানিয়েছেন, কী ভাবে তাঁর মেয়ে চিত্রলেখা বাবার লেখা বইয়ের পাণ্ডুলিপির প্রতিলিপি করে সহায়তা করতেন। অধ্যাপনার কাজ থেকে অবসর নেওয়ার পরে তিনি নবদ্বীপেই স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেন।
হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য বিখ্যাত পণ্ডিত হরিনারায়ণ তর্কপঞ্চানন (তাঁর পিতামহ ছিলেন) বংশের সন্তান হলেও তিনি যে কেবল সংস্কৃত, বেদ, পুরাণ ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন তাই নয়, তার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি লিখেছেন ভ্রমণ, গল্প, উপন্যাসও। তবে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তিনি নিয়মিত বিভিন্ন গবেষণাধর্মী বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ লিখতেন। সব মিলিয়ে তাঁর প্রায় দু’শোটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। আগেই বলেছি তাঁর প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে সব থেকে আলোচিত হয়েছিল ‘হিন্দুদের দেবদেবী: উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ’। এর পাশাপাশি, যে বইগুলি তিনি প্রকাশ করেছিলেন সেগুলি হল ‘যাত্রাগানে মতিলাল রায় আর তাঁহার সম্প্রদায়’, ‘রবীন্দ্র সাহিত্যে আর্যপ্রভাব’, ‘বাঙ্গালা মঙ্গলকাব্যের ধারা’, ‘বাঙ্গালা নাট্যসাহিত্যের পরিচয়’। তাঁর প্রকাশিত দু’টি উপন্যাস হল ‘সিন্ধুতরঙ্গ’ এবং ‘মন্দির ত্যজি যব’। এ ছাড়া তাঁর লেখার তালিকায় রয়েছে ‘বঙ্গ সাহিত্যাভিধান’ ( প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং সংযোজন খণ্ড’)। লিখেছিলেন ভ্রমণ কাহিনি ‘রূপের অমরাবতী কাশ্মীর’। এ ছাড়া জেলা বর্ধমানের এই সারস্বত সাধক ‘বর্ধিষ্ণু বর্ধমান’ নামে একটি তথ্যনিষ্ঠ বইও লিখেছিলেন।
‘হিন্দুদের দেবদেবী: উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ’ বইটিতে হংসনারায়ণের মনে যে প্রেরণাটি কাজ করেছিল তা সম্পর্কে একটি আভাস পাওয়া যায় এই অংশটিতে, ‘...ভারতবর্ষে দেবতাদের রূপকল্পনা, উপাসনা ও পূজার্চনা চলে আসছে তার কোনও হিসাব মেলা সহজ নয়। দেবতাদের আকার প্রকারেও কত বৈচিত্র। কত বৈচিত্রময় কাহিনী দেবতাদের সম্বন্ধে। নিছক কৌতূহলবশেই অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি নিয়ে এ বিষয়ে একটু আধটু পড়াশুনো শুরু করেছিলাম অনেক দিন আগে।...ভারতীয় দেবতাদের সম্বন্ধে দেশী বিদেশী বহু খ্যাতনামা পণ্ডিত অল্পবিস্তর আলোচনা করেছেন। কিন্তু এই সকল গ্রন্থ অসম্পূর্ণ বলে আমার মনে হয়েছে। ...দেবতাদের স্বরূপ প্রকাশ ও বিবর্তনের ইতিহাস বর্ণনার জন্য একখানি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনার একান্ত প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি।’ এই অনুভব থেকেই সৃষ্টি হয়েছে এই অমূল্য গ্রন্থটি।
এ কথা আমরা সকলেই জানি, বৈদিক যুগে মূর্তিপুজোর কোনও রেওয়াজ ছিল না। মন্ত্রগুলিতে দেবতার রূপের কল্পনা করা হয়েছে। সেই রূপের কল্পনাকে ছবির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা ছিল হংসনারায়ণবাবুর অন্যতম লক্ষ্য। পাশাপাশি, সেই কল্পনার ক্রমবিকাশও দেখিয়েছেন তিনি। বইটির তিনটি খণ্ডে সেই ছবিগুলি রয়েছে। এই রেখাচিত্রগুলি এঁকেছেন পারুলিয়ার প্রসিদ্ধ সঙ্গীত ও চিত্রশিল্পী ব্রজেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। রেখাচিত্রগুলির আঁকার ক্ষেত্রে লেখকের ছেলে কণাদ ভট্টাচার্য এবং তাঁর বন্ধু সমরেশ সাহাও সহযোগিতা করেছিলেন। দেবদেবীদের ক্রমবিকাশের যে রেখাচিত্র বইগুলিতে সন্নিবেশিত হয়েছিল তা বিষয়ের গ্রহণযোগ্যতা অনেকাংশে বৃদ্ধি করেছে। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই জন্যই এই গ্রন্থ প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, এই ধরনের গবেষণা এক জন গবেষকের দীর্ঘজীবনের কঠিন পরিশ্রম এবং মননশীলতার ফল। এটি সর্বোচ্চ স্বীকৃতির অধিকারী এমন মন্তব্যও করেছিলেন অসিতবাবু। তাঁর মতে, ‘I would frankly opine that it will be highly acclaimed as a piece of modern scholarship on ancient matter’। হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য প্রয়াত হন ২০০২ সালের ১৪ মার্চ। আজ ১৭ বছর হয়ে গেল। তাঁর বইটি এখন সে ভাবে নজরে না পড়লেও বৌদ্ধিক চর্চার ক্ষেত্রে তাঁর আসনটি যে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
লেখক বর্ধমানের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী