ফাইল চিত্র।
ভারতে স্বাধীনতার পরে অনেক ভয়াবহ বন্যা ঘটে গিয়েছে। তার মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য একটি বন্যা হল ১৯৬৮ সালে জলপাইগুড়ির তিস্তা নদীর প্লাবন, যা অত্যন্ত আকস্মিক ভাবে একটি শহরকে গ্রাস করে এবং যার পরিণতিতে সেই শহরের চেহারাই অনেকটা বদলে যায়। এই বছর সেই বন্যার পঞ্চাশ বছর পূর্তি।
ঘটনার সূত্রপাত ২ অক্টোবর ১৯৬৮। আগের দিন সন্ধ্যা থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি। শুধু জলপাইগুড়িতেই নয়, তিস্তার উচ্চ অববাহিকাতেও প্রচণ্ড বৃষ্টি। রেকর্ড বলে যে, অক্টোবরের ২ থেকে ৫ তারিখের মধ্যে এই অববাহিকায় অস্বাভাবিক বৃষ্টি হয়েছিল। ৪ অক্টোবর ১৯৬৮-র গভীর রাতে তিস্তা নদী হঠাৎ শহরের ভিতর ঢুকে পড়ে। পঞ্চাশ বছর আগে যাঁরা ওই দুর্যোগ প্রত্যক্ষ করেছিলেন বা তার গ্রাসে পড়েছিলেন তাঁরা মন থেকে এই দিনটি মুছে ফেলতে পারেননি।
সে সময় জলপাইগুড়ি শহর অনেক ছোট, অধিকাংশ বাড়িই একতলা, টিনের চাল। শহরে বন্যার জল প্রবেশ করে রাত দুটো নাগাদ প্রথমে করলা নদী দিয়ে। তখন করলার মোহানা ছিল কিং সাহেবের ঘাটের কাছে। সেখানে বাঁধ থাকায় জল ঢুকতে একটু সময় নেয়। করলা নদীর উপর যে ক’টি ব্রিজ ছিল, একটি বাদে সব ক’টি ভেঙে যায়। ফলে করলার পূর্ব দিকের অংশ পশ্চিম দিকের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একই সঙ্গে রংধামালীর দিক থেকে তিস্তার জল প্রবল বেগে ঢুকতে থাকে। সারা শহর দুই থেকে সাড়ে চার মিটার জলের তলায় চলে যায়। অনেক নিচু জায়গায় জলের গভীরতা আরও বেশি ছিল। শুনেছি জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালের একতলাটি সম্পূর্ণ ডুবে গিয়েছিল, অধিকাংশ রোগীকেই বাঁচানো যায়নি। জেলখানার একটি দেওয়াল ভেঙে যায় ও একতলা ডুবে যায়।
এই বন্যায় জলপাইগুড়ি শহরে ২১৬ জন মানুষের মৃত্যু ঘটে, ৩৪৫৬টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৩৭০টি গরু মারা যায়। শহরের ভিতরে জলস্রোত ছিল প্রতি ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার। তিস্তায় সে দিন জলপ্রবাহের পরিমাণ ছিল ১৯৮০০ কিউসেক (ঘনমিটার প্রতি সেকেন্ডে)। জলপাইগুড়ির তিস্তা ব্রিজ এমন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে ডুয়ার্সের সঙ্গে জলপাইগুড়ির যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অ্যান্ডারসন ব্রিজের মতো অনুপম স্থাপত্যের নিদর্শনটিও এই বন্যায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। করলা নদীর বাঁ দিকের অংশের সঙ্গে ডান দিকের অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় বাঁ দিকের বন্যা কবলিত মানুষ রিলিফ পেয়েছেন অনেক দেরিতে।
এই বন্যা এত আকস্মিক ছিল যে বহু লোক প্রস্তুত হওয়ার কোনও সময় পাননি। ৩ অক্টোবর সন্ধ্যা ছ’টার সময়েই খবর এসেছিল তিস্তাবাজারে অ্যান্ডারসন ব্রিজে জল বিপদসীমার ২০ মিটার উপরে উঠে গিয়েছে। এটাও অনুমান করা গিয়েছিল যে রাত দুটো নাগাদ বন্যার জল জলপাইগুড়ি শহরের কাছে এসে পৌঁছবে। কিন্তু প্রশাসন থেকে কোনও সতর্কতামূলক বিজ্ঞপ্তি বা নির্দেশিকা জারি করা হয়নি। এর দু’টি কারণ থাকতে পারে: ১) এটা প্রশাসনের দিক থেকে একটি ত্রুটি, ২) প্রশাসন এবং জলপাইগুড়ির সাধারণ মানুষ ভাবতে পারেনি শহরকে রক্ষা করার জন্য যে তিন মিটার উঁচু বাঁধ আছে তা ছাপিয়ে জল শহরে প্রবেশ করতে পারে।
১৯৬৮ সালের বন্যা জলপাইগুড়ির মানুষকে দু’টি অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করেছিল। প্রথমত, এই হঠাৎ বন্যায় এক সঙ্গে কী করে প্রাণ বাঁচাতে হবে সেই শিক্ষা, এবং প্রতিবেশী শহরের মানবিক মুখ। জলপাইগুড়ি শহরের ভিতর দিয়ে যখন বন্যার জল বয়ে যাচ্ছিল তখন শিলিগুড়ির মানুষ নিজেদের উদ্যোগে রিলিফ সংগ্রহ করছিলেন। ৫ অক্টোবর ভোরে তাঁরা ট্রাক ভর্তি করে ত্রাণসামগ্রী
নিয়ে শহরের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। জল নামার সঙ্গে সঙ্গে তার বিতরণ শুরু হয়। ৫ অক্টোবর সকাল দশটার মধ্যে পান্ডাপাড়ার লোকেরা ত্রাণ পেতে শুরু করেন।
এই বন্যা কেন ঘটেছিল? জলপাইগুড়ির শহরের উত্তরে তিস্তার যে অববাহিকা, তা প্রায় ৯৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এর মধ্যে প্রায় ৮৪০০ বর্গকিলোমিটার পার্বত্য এলাকা ও তার কিছুটা হিমবাহ। হিমবাহ অঞ্চলে রয়েছে অনেকগুলি প্রাকৃতিক হ্রদ যেগুলি প্রচুর জল সঞ্চয় করে রাখতে পারে। ২ থেকে ৫ অক্টোবর, চার দিনে অত্যধিক বৃষ্টিপাত হয়। এই জলপ্রবাহের একটা অংশ তিস্তা দিয়ে বয়ে আসায় নিম্ন অববাহিকায় বিপদসীমার উপর দিয়ে জল বইতে শুরু করে। কারও কারও মতে, উচ্চ অববাহিকাতে ধস নামার ফলে সম্ভবত কোনও সাময়িক জলাধার তৈরি হয় যেখানে প্রচুর পরিমাণ জল জমে। ৩ অক্টোবর সেই হ্রদে ভাঙন ঘটে, সমস্ত জল এক সঙ্গে প্রবল বেগে নীচের দিকে ছুটে আসে।
তিস্তা নদীর বন্যা ও জলপ্রবাহ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। ১৯৬৮ সালের পরেও তিস্তা বহু বার ধ্বংসাত্মক রূপ নিয়েছে। করলা নদী দিয়ে জল এসে জলপাইগুড়ি শহর ভাসিয়েছে। কিন্তু ’৬৮ সালের মতো ভয়াবহ আকার নেয়নি। এই পঞ্চাশ বছরে জলপাইগুড়ি শহরে বাঁধের সংস্কার হয়েছে, তিস্তার উপর ব্যারেজ হয়েছে যা তিস্তার জলের একাংশ মহানন্দায় নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু জলপাইগুড়ি কি বন্যার ঝুঁকি থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ?
বর্তমানে তিস্তার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব, তার উচ্চ অববাহিকায় ক্রমাগত নির্মাণকাজ হচ্ছে। বিপুল পরিমাণে বনভূমি নষ্ট হয়েছে রাস্তা প্রসারিত করার জন্য। তার উপরে তিস্তার বুকে বেশ কয়েকটি ব্যারেজ ও জলাধার নির্মাণ করা হয়েছে। সিকিম ও দার্জিলিং হিমালয়ের অন্তর্ভুক্ত তিস্তার উচ্চ অববাহিকা ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। এই এলাকায় প্রতিটি জলাধারই ঝুঁকিপূর্ণ। বর্ষাকালে ধস নামার প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। কাজেই আবার যদি খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ বৃষ্টিপাত ঘটে তবে প্রাকৃতিক জলাশয় এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জলাধারগুলি যে সেই জল ধরে রাখতে সক্ষম হবে না, তেমন আশঙ্কা বিলক্ষণ।