একদা: বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ১৯৭২ সালের ইস্টবেঙ্গল খেলোয়াড়েরা। ছবি অমিয় ভট্টাচার্যের সৌজন্যে
ঐতিহাসিক বাংলাদেশ সফরের স্মৃতিচারণ করছিলেন অমিয় ভট্টাচার্য। ১৯৭২ সালে ইস্টবেঙ্গলে খেলেছিলেন তিনি। অবশ্য কলকাতার মাঠে কুমোরটুলির হয়ে খেলা শুরু করেছিলেন মেদিনীপুরের ছেলে অমিয় ভট্টচার্য। এরপর জর্জ টেলিগ্রাফ। ফুটবল খেলে ইস্টার্ন রেলে চাকরি হয়। তারপর রাজস্থান ক্লাব। রাজস্থান ক্লাবের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন। অমিয়বাবু ১৯৭২ সালে ইস্টবেঙ্গলে সই করেন। সেন্টার ফরোয়ার্ড এবং স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতেন তিনি। ওই বছরই ইস্টবেঙ্গল ক্লাব কলকাতা লিগ, অসমের বড়দলৈ ট্রফি, রোভার্স কাপ ও ডুরান্ড কাপ জেতে। অমিয়বাবু জানান, ওই সময় প্রশিক্ষক ছিলেন প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। পিকে-র কোচিংয়ে খেলার সুযোগ পেয়ে উৎসাহিত ছিলেন তিনি। ১৯৭২ সালে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ত্রিমুকুট জয় করেছিল। অর্থাৎ আইএফএ শিল্ড, ডুরান্ড কাপ ও রোভার্স কাপ জিতেছিল। ওই বছর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মুজিবর রহমানের অনুরোধে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব বাংলাদেশ সফরে গিয়েছিল। বাংলাদেশ একাদশের সঙ্গে পাঁচটি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলেছিল। এর মধ্যে দু’টি ম্যাচ ড্র হয়। তিনটি ম্যাচ জেতে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। অমিয়বাবু জানান, জেতা তিনটি ম্যাচের প্রত্যেকটিতেই তিনি গোল করেছিলেন।
অমিয়বাবুর স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের নৈশভোজ। বঙ্গবন্ধু সকল খেলোয়াড়কে একটি পালতোলা নৌকোর স্মারক উপহার দিয়েছিলেন। উপহার ছিল তসরের পোশাক আর মানপত্র। ইস্টবেঙ্গলে হয়ে খেলার সময়ে আরও দু’টি ম্যাচ অমিয়বাবুর কাছে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। আইএফএ শিল্ডে উয়াড়ির সঙ্গে শেষ ম্যাচ ছিল। সেই ম্যাচে কিছুতেই উয়াড়ির তেকাঠি ভেদ করতে পারছিল না ইস্টবেঙ্গল। অমিয়বাবু নিজে দু’টি গোল মিস করেছিলেন। তবে শেষরক্ষা হয় আকবরের গোলে। ওইদিন দু’টি গোলের সুযোগ নষ্ট করার ব্যথা এখনও মনে রয়েছে অমিয়বাবুর। অন্য স্মরণীয় ম্যাচটি ছিল কলকাতা লিগের। ক্যালকাটা জিমখানার সঙ্গে খেলা। প্রথম অর্ধে কোনও গোল হয়নি। অমিয়বাবুকে দ্বিতীয় অর্ধে নামানো হয়। আর নেমেই গোল পান তিনি। অমিয়বাবু বলেন, ‘‘তার পর আরও চারটি গোল করি আমরা। ম্যাচটি ৫-০ গোলে জিতেছিলাম। আমি ইস্টবেঙ্গলের ক্যাম্পে থাকতাম। কোনও ম্যাচ জিতলেই ক্লাবে ভাল খাওয়াদাওয়া হত। সেই দিনগুলো খুবই মনে পড়ে।’’ অমিয়বাবু জানান, তিনি ইস্টবেঙ্গলে এক বছর খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। ইস্টার্ন রেলে চাকরি করতেন। তাই ইস্টার্ন রেলের হয়ে খেলার জন্য চলে আসতে হয়।
ক্লাব একশো বছরে পা দিল। কেমন লাগছে? অমিয়বাবু বলেন, ‘‘আমি গর্বিত যে আমি এই ক্লাবের জার্সি পরে খেলার সুযোগ পেয়েছি। আমি খুব নামী খেলোয়াড় ছিলাম না। তাই শতবর্ষের অনুষ্ঠানে ডাক পাইনি। তবে এই ক্লাবের আরও শ্রীবৃদ্ধি ঘটুক, এই প্রার্থনা করব।’’
খড়্গপুরের প্রীতি ঘোষাল ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে খেলেছেন। তাঁর ময়দান অভিযান শুরু ১৯৭৬ সালে। বেহালা ইউনিয়ন ক্লাবের হয়ে। ১৯৭৭ সালে স্পোর্টিং ইউনিয়ন। পরের বছর চলে যান বিএনআর-এ। ’৭৮ সালে জুনিয়র ন্যাশনাল খেলার জন্য সুযোগ পান। ’৭৯ সালে রাজস্থান ক্লাবে খেলেন। ১৯৮১ সালে ইস্টবেঙ্গলে যোগ দেন। প্রীতি ঘোষাল লেফট উইঙ্গার ছিলেন। ওই বছর কলকাতা লিগের প্রথম ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল ইস্টবেঙ্গল এবং বাটা। প্রীতি ঘোষালের বাড়ানো পাস থেকে গোল করেন পি ডি ফ্রান্সিস। কলকাতা লিগেই উয়াডির বিরুদ্ধে খেলেছেন প্রীতিবাবু। ওই ম্যাচে ৫-২ গোলে ইস্টবেঙ্গল জিতেছিল। তিনি একটি গোল করেছিলেন। ওই বছর ইস্টবেঙ্গল ফেডারেশন কাপে হেরে যায়। প্রীতিবাবু বলেন, ‘‘আমরা হেরে গেলেও ভাল খেলেছিলাম।’’ ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের খেলোয়াড়রা আইএফএ লিগ খেলার জন্য নিয়মিত কঠোর অনুশীলন চালাচ্ছিল। এই সময় খড়্গপুরে প্রীতিবাবুর বাবাকে দুষ্কৃতীরা গুলি করে মেরে ফেলে। প্রীতিবাবুর বাবা রেল পুলিশের অফিসার ছিলেন। বাড়ি ফিরে আসতে হয় তাঁকে। বেশ কয়েক বছর বাড়ির হাল ধরতে হয়। ফলে প্রীতিবাবুর আর ইস্টবেঙ্গলে খেলা হয়ে ওঠেনি। ইস্টবেঙ্গলের ‘শতধ্বনি’তে খুব খুশি প্রীতিবাবু। তিনি বলেন, ‘‘এটা খুবই আনন্দের দিন। আমি চাইব এই ক্লাবের নাম আরও উজ্জ্বল হোক। প্রত্যেক বছর ভাল ফল করুক।’’
খড়্গপুরের আরেক বাসিন্দা প্রণব বসু ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। প্রীতি ঘোষালের মতো প্রণববাবুও লেফট উইঙ্গার ছিলেন। তবে ময়দানের জীবন শুরু জর্জ টেলিগ্রাফে খেলে। তারপর বিএনআর-এ খেলেছেন। ১৯৮৩ ও ৮৪ সালের ইস্টবেঙ্গল দলে ছিলেন তিনি। পি কে-র কোচিংয়ে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়, মিহির বসু, আলোক মুখোপাধ্যায় ও প্রশান্ত বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে খেলার সুযোগ হয়েছে প্রণববাবুর। তিনি বললেন, ‘‘ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জার্সি পরলেই জিততে হবে এরকম একটা মানসিকতা চলে আসত।’’ বেশ কয়েকটি ম্যাচের কথা আজও মনে রয়েছে প্রণববাবুর। কলকাতা লিগের একটি খেলায় সালকিয়ার সঙ্গে খেলা ছিল। প্রথম একাদশে নাম ছিল না তাঁর। খেলা শুরুর আগে তুমুল বৃষ্টি হয়। মাঠে জল জমে যাওয়ায় প্রথমে খেলা বাতিল ঘোষণা হয়। পরে ঠিক হয় খেলা হবে। কাদা মাঠে অনেক খেলোয়াড় চোট লাগার ভয়ে খেলতে নিমরাজি ছিলেন। তাতেই প্রথম একাদশে সুযোগ পান প্রণববাবু। কাদা মাঠে খেলতে নেমে হ্যাটট্রিক করেছিলেন তিনি। প্রণববাবু বলেন, ‘‘কোচ পি কে বন্দ্যোপাধ্যায় আমার খেলার খুব প্রশংসা করেছিলেন। ফেডারেশন কাপ খেলতে কেরলে গিয়েছিলাম। মফতলালের সঙ্গে খেলায় আমি ইস্টবেঙ্গলের হয়ে একমাত্র গোল করেছিলাম। দার্জিলিংয়ে গোল্ড কাপে নেপালের বিরুদ্ধে খেলায় গোল না পেলেও ভাল খেলেছিলাম।’’
প্রণববাবু জানান, এখন ফুটবলের মান অনেক নেমে গিয়েছে। আক্ষেপ করেন, ‘‘আমাদের সময় বাঙালি ছেলেরাই ভারতের সেরা ফুটবলার ছিল। কলকাতার ফুটবল দল ভারতের যে কোনও প্রান্তে গিয়ে জিতে আসত। এখন দলে বিদেশির নির্ভরশীলতা বেড়ে গিয়েছে। একটি দলে বেশ কয়েকজন বিদেশি খেলানো হচ্ছে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘ক্লাবের শতবর্ষ পালিত হচ্ছে। ক্লাবের উন্নতির জন্য ভাবনা করার লোকের অভাব দেখা দিয়েছে। এখন সবাই নিজেরটা নিয়ে ভাবতেই ব্যস্ত। এ ভাবে ক্লাবের ভাল হতে পারে না। স্বার্থ ছাড়া কাজ করবে এমন লোকজন এগিয়ে এসে হাল ধরলে ক্লাবের আরও উন্নতি হবে।’’
অমিয় ভট্টচার্য, প্রীতি ঘোষাল, প্রণব বসুর ইস্টবেঙ্গলের উত্তরসূরি পিন্টু মাহাতো। প্রায় ৩৫ বছর পর পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ছেলে পিন্টু এই বছরই ইস্টবেঙ্গলে যোগ দিয়েছেন। গত বছর মোহনবাগানের হয়ে ডার্বিতে পিন্টুর খেলা প্রশংসিত হয়েছিল। গোলও করেন। পিন্টু মোহনবাগানে ১২৫ বছরের উদযাপনে সামিল হয়েছিলেন।
এবার শতবর্ষের পা দেওয়া ইস্টবেঙ্গলের উদযাপনে। পিন্টু বললেন, ‘স্মরণীয় স্মৃতি।’’