আ সে আম’-এর পরিবর্তে ‘আ সে আখ পাত্তা’। ছত্তীসগঢ়ের এক জনজাতির ভাষায় অশ্বত্থ বৃক্ষপত্রকে আখ পাত্তা বলা হইয়া থাকে। শহুরে পড়ুয়াদের নিকট আম পরিচিত, কিন্তু উক্ত সামগ্রীটি জনজাতির দৈনন্দিনতায় যুক্ত। অতএব নূতন ব্যবস্থা। এহ বাহ্য। প্রজাতন্ত্র দিবসে জগদলপুরে ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেল ঘোষণা করিয়াছেন, রাজ্যের ১৯,০০০ অঙ্গনওয়াড়িতে দশটি জনজাতির ভাষা লেখাপড়ার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হইবে। সেই রাজ্যের বিদ্যালয়গুলিতে শিশুদের সরকারি ভাষায় (হিন্দি বা ইংরাজি) প্রশিক্ষিত করিয়া তাহার পর সেই মাধ্যমে লেখাপড়া শিখাইতে বিশেষ বেগ পাইতে হয়। অনেক সময় অর্থ না বুঝিয়া শিক্ষকের পাঠ পুনরাবৃত্তি করিতে থাকে ছাত্রছাত্রীদল। ভাষা না জানিবার কারণে পুনরাবৃত্তিকেই পাঠ বলিয়া মনে করে বহু শিশু। সেই স্থলে ভাষিক মাধ্যমের সঙ্কটমোচন জরুরি। এ-ক্ষণে সেই পথে অগ্রসর হইবার চেষ্টা হইল। ছত্তীসগঢ়ের ৩২ শতাংশ মানুষ তফসিলি জনজাতিভুক্ত। তাঁহারা উপকৃত হইবেন। ইহার সহিত প্রাণ পাইবে মরিতে বসা দশটি জনজাতির ভাষা।
বহুভাষিকতা ভারতের প্রাণস্বরূপ। তাহাকে স্বীকৃতি দিয়াই ১৯৫৬ সালে ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশগুলি বিভক্ত করা হইয়াছিল। সংবিধানের অষ্টম তফসিলেও ২২টি ভাষার স্বীকৃতি রহিয়াছে। ইহার পরেও রাজনীতির প্রয়োজনে বারংবার দেশ জুড়িয়া এক ভাষা প্রবর্তনের চেষ্টা হইয়াছে। স্বাধীনতার পরে দুই বার ইংরাজি তুলিয়া দিয়া কেবলমাত্র হিন্দিকে সরকারি ভাষা বানাইবার প্রস্তাব করিয়াছিল জওহরলাল নেহরুর সরকার। গত বৎসর হিন্দি দিবসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, সমগ্র দেশে একখানিই ভাষা আছে যাহা সকলে জানেন। প্রতি বারই প্রবল প্রতিবাদ হইয়াছে। প্রতিটি রাজ্যের অভ্যন্তরেও আবার একাধিক ভাষা রহিয়াছে, শিক্ষাব্যবস্থায় যাহার স্বীকৃতির সুযোগ নাই। পরিচিত যুক্তিটি হইল, উচ্চশিক্ষায় অস্তিত্বহীন ভাষাকে মাধ্যম করিলে শিশুদের ক্ষতি সাধিত হইবে। সেই যুক্তিতেই উত্তর-পূর্বের জনজাতি অধ্যুষিত রাজ্যগুলিতে হিন্দি বা ইংরাজি ব্যতীত লেখাপড়ার মাধ্যম নাই। ইহার ফলে অবশ্য বহু আঞ্চলিক ভাষার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটিয়াছে।
অতএব ভূপেশ বাঘেল যাহা করিলেন, তাহাতে দার্ঢ্যের পরিচয় আছে। শিক্ষাক্ষেত্রে লিটল ল্যাঙ্গোয়েজ বা ক্ষুদ্র ভাষাকে স্বীকৃতি দান স্রোতের বিপরীতেই সন্তরণ। বহু ভাষা-গবেষকই জানান, প্রাক্-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ পাইলে শিশুর শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ে, এবং প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের ভিতর এই পদ্ধতি বিশেষ কার্যকর বলিয়া মনে করা হয়। যেখানে লেখাপড়ার পরিবেশ নাই, সেইখানে ইতিপূর্বে পরিচিত ভাষাতেই শিক্ষাদান বিধেয়। বিশ্বের নানা বহুভাষিক দেশেই সংখ্যালঘু ভাষাকে সকল স্তরে স্বীকৃতি দিবার চেষ্টা দেখা যায়। জিম্বাবোয়েতে সরকারি ভাষার সংখ্যা ১৬। ইংরাজির সহিত সিন্দেবেলে এবং সোনা ভাষাতেও সংবাদ সম্প্রচারিত হয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় সরকারি ভাষার সংখ্যা ১১, এবং খাতায়-কলমে প্রতিটি ভাষারই সমান ক্ষমতা। ছত্তীসগঢ়ের দৃষ্টান্তটি গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গেও নেপালি বা সাঁওতালির ন্যায় ভাষাকে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যম করিবার দীর্ঘকালীন দাবিটিকে কী ভাবে যথাযথ ভাবে রূপায়িত এবং আরও প্রসারিত করা যায়, ভাবা যাইতে পারে।