গ্যালারি সংস্কৃতি-র ২৫-বছর পূর্তি উপলক্ষে বিভিন্ন শিল্পীর প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হচ্ছে সারা বছর ধরে। সেই ধারাবাহিকতায় একই সঙ্গে দুই কক্ষে অনুষ্ঠিত হল দুটি আলাদা একক প্রদর্শনী। একটি ছবির, অন্যটি ভাস্কর্যের। প্রথমটির শিল্পী অশোক মল্লিক। ৩০-টি ছবি নিয়ে আয়োজিত তাঁর প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘ব্ল্যাক কমেডি’। ‘পিন পয়েন্ট প্যারডি’ শিরোনামে ন’টি ভাস্কর্য নিয়ে আয়োজিত। দ্বিতীয় প্রদর্শনীটির শিল্পী নান্টুবিহারী দাস। দু’জন দুই প্রজন্মের শিল্পী। অশোক চিত্রচর্চা শুরু করেছিলেন ১৯৮০-র দশকে। নান্টু বিহারী তাঁর সৃজনের ক্ষেত্রে এসেছেন একবিংশ শতকে। দু’জনের ভাবনা ও প্রকাশভঙ্গিতে অনেকটাই ব্যবধান। তবু প্রচ্ছন্ন মিল আছে একটা জায়গায়। তাঁদের প্রতিবাদী-চেতনায়। বিপন্ন মানবতার নিহিত সংকটকে তাঁরা অনুধাবন করতে চেষ্টা করেছেন। দু-টি দশকের ব্যবধানে জীবন ও শিল্পের ভাবনায় যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে, দুটি উপস্থাপনায় তারই কিছু ঈঙ্গিত থাকে।
শিল্পী: অশোক মল্লিক।
অশোকের প্রায় সব ছবিই সাদা-কালো। মূলত কালিতে এঁকেছেন। তুলি ও কলমে প্রচ্ছন্ন এক কৌতুক পরিস্ফুট হয়েছে তাঁর প্রকাশে। কৃষ্ণবর্ণ সে কৌতুক। চারদিকে আজ অজস্র বৈভবের ছড়াছড়ি। উপচে পড়ছে সুখ। অথচ এরই গভীরে ঘনিয়ে আসছে গহন সংকট। সেই সংকটেরই বিভিন্ন প্রতীকী আলেখ্য গড়ে তুলেছেন শিল্পী। তাঁর ছবি মূলত অবয়বী। উপস্থাপনা বাস্তবতা ভিত্তিক। স্বাভাবিকতা বিশ্লিষ্ট হয়ে গড়ে উঠেছে সেই বাস্তবতা। রূপ ভেঙেছে মূলত: রেখাধৃত জ্যামিতিক কৌণিকতায়। এর সঙ্গে অভিব্যক্তিবাদী রূপান্তরণকেও মিলিয়েছেন। কিউবিজম ও এক্সপ্রেশনিজমের সংশ্লেষ ঘটেছে আদিমতার অনুষঙ্গে। পাশ্চাত্যের আধুনিকতাবাদী আঙ্গিকের এই দুটি মাত্রা আমাদের দেশে আত্তীকৃত হতে শুরু করেছিল ১৯৪০-এর দশকের পর থেকে। ১৯৮০-র দশক পর্যন্ত নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে তা প্রবাহিত হয়েছে। অশোক সে পথেই তাঁর অবয়ব-ভিত্তিক প্রতীক নির্মাণে প্রয়াসী হয়েছেন।
মুষ্টিযোদ্ধার উপস্থাপনাটিই একমাত্র ছবি যেখানে শিল্পী কালো ভিন্ন অন্য বর্ণ সামান্য ব্যবহার করেছেন। যৌবন চলে গেছে এই মুষ্টি যোদ্ধার। নিঃশেষ হয়ে গেছে তেজ। শুধু অভ্যাস বেঁচে আছে। এই আত্মকরুণাই যেন হয়ে ওঠে আজকের সময়ের প্রতীক।
কোনও এক ব্যান্ড বাদকের মৃত্যু নিয়ে একটি দীর্ঘ প্যানেল রচিত হয়েছে। ভূমিতলে শায়িত এই ব্যান্ডশিল্পীকে ঘিরে অজস্র ব্যান্ডবাদকের নিঃশব্দ কলরোল। শিল্প ও মানবিক অস্তিত্বের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের নিহিত করুণা আভাসিত হয়েছে ছবিটিতে। আর একটি ছবিতে অজস্র উচ্চবিত্ত মানুষ সমবেতভাবে উচ্চকিত হাসছে। যেন লাফিং-ক্লাবের অনুশীলন। উপর থেকে ঝুলে আছে বিশ্বের বিভিন্ন সম্ভ্রান্ত শহরের প্রতীকগুলো। প্রবহমান জীবনের অন্তরালবর্তী এরকম বিপন্ন করুণা উন্মীলিত হয়েছে অন্যান্য ছবিতেও।
নান্টুবিহারী দাস ভাস্কর্যের আঙ্গিকে যে বিবর্তন এনেছেন সাম্প্রতিক কালে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তা বিশেষ স্বীকৃতি পেয়েছে। তাঁর রচনার বিষয় মূলত শৈশব। সমস্ত বিশ্বব্যবস্থা যেখানে চরম সংকটের মুখোমুখি – সেখানে শিশুর খেলার জগতের উপরেও কালো ছায়া নেমে আসে। এক দিকে অস্বাভাবিক স্ফীতি, আর এক দিকে কণ্টকাকীর্ণতা- এই দুইয়ে মিলে শৈশব-সারল্যকে তীব্রভাবে বিদ্রুপ করে।
নান্টুর প্রতিটি রচনাই অত্যন্ত পরিশ্রমী ও নিবিষ্ট নিপুণতায় করা। প্লাস্টার বা ফাইবার গ্লাসে মূর্তির প্রাথমিক কাঠামোটি করে তার উপর সমস্ত অবয়বের উপরিতল ঘিরে এক একটি করে লোহার পিন বিদ্ধ করেন শিল্পী।
এই আপাত-সৌন্দর্যের গভীর থেকে নিষ্কাশিত হতে থাকে এক বিপন্ন বাস্তব। যে শিশুটি নিষ্পাপ তাকিয়ে আছে, খেলছে বা কোনও দেয়াল বেয়ে উঠছে, তার এই খেলার সারল্য ওই কাঁটার দাপটে ভেঙে খান খান হয়ে যায়। জাদুবাস্তবতার এই বিশেষ ধরনের মধ্য দিয়ে শৈশবের প্রতীকে নান্টু বিহারী এই সময়ের তীব্র সংকটকে তুলে ধরতে চেষ্টা করেন।