ভারতের স্বাধীনতার ৬৮-তম বর্ষপূর্তি উদযাপন উপলক্ষে গোর্কি সদনে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল, যার শিরোনাম ‘স্বাধীনতার রং’। ইংরেজিতে ‘কালার্স অব ফ্রিডম’। এই অনুষ্ঠানের মুখ্য উপজীব্য ছিল প্রবীণ শিল্পী রবীন মণ্ডলের ছবির প্রদর্শনী। ৩৮-টি সাম্প্রতিক ছবি নিয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অনেক বিদগ্ধ মানুষ শিল্পীর ছবি নিয়ে তাঁদের মুগ্ধতার কথা বলেন। সব শেষে শিল্পী নিজে বলতে উঠে রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধক গানের একটি লাইন উচ্চারণ করেন তাঁর সারা জীবনের শিল্পসাধনার প্রেরণা বা ধ্রুবপদ হিসেবে – ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক আমি তোমায় ছাড়ব না’। সমস্ত বাধা-বিপত্তির মধ্যে নিজের সাধনায় এই যে মগ্ন হয়ে থাকা, তিনি মনে করেন, এটাই তাঁকে আজকের জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে। শৈশবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তিন চার বছর গৃহবন্দি ছিলেন। হাঁটার ক্ষমতা ছিল না। স্কুলে যেতে পারেন নি। সেই বন্দিদশাই তাঁকে ছবির কাছে নিয়ে গেছে। সঙ্গে ছিল কাগজ পেনসিল। আঁকিবুকি খেলতে খেলতে সেই যে ছবির জগতে প্রবেশ করলেন, সেটাই তাঁর জীবনে ক্রমশ সত্য রূপ দিল।
আর্ট কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হলেন। ম্যাট্রিক পাশ করা হয়নি। তাই ভর্তি হওয়া গেল না। এর পর দু’বছরের মধ্যে পড়াশোনা করে ম্যাট্রিক পাশ করা। আর্ট কলেজে ভর্তি। নাইট কলেজে পড়ে বি. কম. পাশ করা। আর্ট কলেজে পাঠ অসম্পূর্ণ থেকে গেল। রেলে চাকরি। তাতে শিল্পচর্চার উপকরণ কেনার স্বাধীনতা অর্জন। তারপর জীবন ব্যাপী একাত্ম অনুশীলন। শিল্পের ভিতর দিয়ে মুক্তির দিগন্ত থেকে দিগন্তে তাঁর সঞ্চরণ।
‘স্বাধীনতা’ শব্দটি রবীন মণ্ডলের শিল্পের সঙ্গে আর একটু ব্যাপ্তভাবে যুক্ত করে নেওয়া যায়। যে আঙ্গিক তিনি ধীরে ধীরে উন্মীলিত করেছেন তাঁর শিল্পের ভিতর, তা উঠে এসেছে আদিম মানুষের শিল্পকৃতি থেকে। অরণ্যবাসী এই আদিম মানুষেরা নিয়ত স্বাধীন। তাঁদের শিল্পচর্চা সেই স্বাধীনতার স্মারক। কিন্তু সভ্যতা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এবং আমাদের দেশেও রাষ্ট্রনৈতিক স্বাধীনতা উন্মীলনের বিভিন্ন পর্যায়ে এই আদিবাসী মানুষদের স্বাধীনতা ক্রমশ সংকুচিত হয়েছে। তাঁরা তাঁদের নিজভূমিতে পরবাসী হয়ে গেছেন। এই আদিমতার আঙ্গিক দিয়ে যখন আধুনিকতাবাদী সৌন্দর্যের এক নিরিখ নির্মাণ করে তোলেন রবীন মণ্ডল, তখন তিনি যেন আধুনিক সভ্যতার মুক্তির এক দিশাও নির্দেশ করেন। ১৯৪০ ও ৫০-এর দশকে যে দুঃখের তাপে পরিশুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ উপলব্ধির দিকে অগ্রসর হয়েছে আমাদের দেশ, শিল্প নিজেও সেই অভিযাত্রারই এক শরিক। তাই বলা যেতে পারে এই দেশের, এই জীবনের মর্মস্থানে পৌঁছতেই যেন অনিবার্যভাবে আদিমতা থেকে তুলে আনতে হয়েছিল রূপনির্মাণের প্রাথমিক উপাদান।
এইখানে পাশ্চাত্য আধুনিকতাবাদের সঙ্গে তাঁর যাত্রাপথের একটা মিল। পাশ্চাত্যে ১৯০৫ সালে এক্সপ্রেশনিজম ও ১৯০৭ সালে কিউবিজমের সূচনায় আদিম শিল্পকলার প্রগাঢ় ভূমিকা ছিল, এ কথা সকলেরই জানা। রবীন মণ্ডল তাঁর শিল্পী জীবনের সূচনা পর্বে এই দুটি পাশ্চাত্য আঙ্গিককে অনুশীলন করেছেন। তারপর এই বিশ্লেষণের পথেই আদিমতার উৎসের এক স্বতন্ত্র দরজা খুলেছেন। নিজের দেশের আদিমতার ঐতিহ্যকে সমন্বিত করেছেন পাশ্চাত্যের আধুনিকতাবাদী আঙ্গিকের সঙ্গে। কোনও আখ্যান বিন্যাসের দিকে না গিয়ে একক রূপের স্বরাটত্বের মধ্য দিয়ে বিশুদ্ধ চিত্রীয় পরিমণ্ডল তৈরি করেছেন। প্রথম দিকে অস্তিত্বের নিহিত যন্ত্রণা মথিত করেই উঠে আসছিল তাঁর রূপ। মানবিক এই নির্যাতন তো স্বাধীনতারও নির্যাতন। সেই দুঃখের আঁধার থেকে শিল্পী ধীরে ধীরে আবিষ্কার করেছেন এক প্রজ্ঞার আলো। তাঁর পরিণত পর্বের ছবিতে, যে চিত্রমালা তিনি এঁকে গেছেন, তাতে আঁধার-জারিত এই আলোকেই তিনি উন্মীলিত করে গেছেন। এই প্রদর্শনীতে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের যে মুখাবয়বটি ২০১৩-তে তেলরঙে আঁকা সেই ছবিটিই হতে পারে এই অভিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।
১৯৩৫ সালে চন্দননগরে রবীন্দ্রনাথ যে আত্মপ্রতিকৃতি এঁকেছিলেন তাতেও ছিল আদিমতার অন্তর্দীপ্তির অভিঘাত। ২০১৩-তে রবীন যে রবীন্দ্রনাথের রূপকল্পনা করেছেন তাতে সভ্যতার সংকটে ব্যথিত রবীন্দ্রনাথ আছেন, কিন্তু সেই ব্যথাই রূপান্তরিত হচ্ছে স্বতন্ত্র এক প্রজ্ঞার আলোয়। এখানেই শিল্পী হিসেবে তাঁর উত্তরণ।
রবীন মণ্ডলকে নিয়ে ৩০ মিনিটের একটি তথ্যচিত্র করেছেন অরুণ চক্রবর্তী। দেখানো হল গোর্কি সদনে। অনেক বিদগ্ধ মানুষের কথা আছে সেই তথ্যচিত্রে। শিল্পীর ছবির ক্রমিক বিবর্তন আর একটু থাকলে ভাল হত।