১৯২৬-এর ১৯ জানুয়ারি ঢাকার কিছু যুক্তিবাদী মুসলমান চিন্তাবিদ মুসলিম সাহিত্যসমাজ প্রতিষ্ঠা করে, তাঁদের বাঙালিত্বের স্বরূপ হিসেবে বাংলা ভাষাকেই মুখ্য সূত্র করতে চেয়েছিলেন, ‘‘স্পষ্ট করেই ঘোষণা করেছিলেন আমরা বাঙালি মুসলমান বটে, কিন্তু আগে বাঙালি পরে মুসলমান।’’ শিবনারায়ণ রায়ের এই ‘নজরুল থেকে তসলিমা: বিবেকী বিদ্রোহের পরম্পরা’ প্রবন্ধটির নামেই আনন্দ থেকে নতুন ভাবে প্রকাশিত তাঁর বইটির নাম: বিবেকী বিদ্রোহের পরম্পরা (৩৫০.০০)। তাতে মার্ক্স ও মার্ক্সপন্থার পুনঃপাঠ নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ। এমন আরও বিবিধ বিতর্কিত বিষয় নিয়ে রচিত প্রবন্ধাদির মধ্যে যেমন আছেন রামমোহন, তেমনই শেক্সপিয়র।
এই মুহূর্তে রিচার্ড ডি উল্ফ দুনিয়ার প্রধান মার্ক্সবাদী অর্থনীতিবিদদের এক জন। তাঁর আন্ডারস্ট্যান্ডিং মার্ক্সিজ়ম বইটি যে সময় প্রকাশিত হল, সেটাকে ধনতন্ত্রের গভীরতম সঙ্কটের মুহূর্ত বললে অত্যুক্তি হবে না। সেই ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে মার্ক্সীয় দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বোঝা যায়, আসলে এই ব্যবস্থার মূলেই রয়ে গিয়েছে তার ধ্বংসের বীজ। শোষণধর্মী ও অগণতান্ত্রিক উৎপাদন কাঠামো, যেখানে অল্পসংখ্যক লোকের হাতেই যাবতীয় সিদ্ধান্তের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা, তারাই নিয়ন্ত্রণ করে উদ্বৃত্ত উৎপাদন, আহরণ ও বণ্টনের সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটা, বাকি মানুষের কোনও অধিকারই নেই— এখানেই রয়েছে ধনতন্ত্রের আসল বিপদ। উল্ফের বক্তব্য, উন্নততর সমাজ নির্মাণ করতে চাইলে প্রথম ও প্রধান কাজ হল উৎপাদনের এই ব্যবস্থাটি পাল্টানো। এমন একটি বইয়ের বাংলা অনুবাদ (মার্ক্সবাদ/ একটি প্রথম পাঠ, অনু: অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় ও অঞ্জন চক্রবর্তী, অনুষ্টুপ, ২০০.০০) যে কতখানি প্রাসঙ্গিক, সেটা বাড়িয়ে বলা অসম্ভব।
স্কুলশিক্ষা নিয়ে আলোচনা হয়েছে প্রচুর। কিন্তু, স্কুল নিয়ে? সেই স্কুলে ছেলেমেয়েরা ঠিক কী ভাবে কী শিখছে, প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে কী ভাবে, এই প্রশ্নগুলো তুলনায় পিছনের সারিতেই থেকে গিয়েছে। স্বাতী ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা না পেলে সবাই রাগ করেন, স্টেশন গিয়ে ট্রেন না পেলে যাত্রীরা বিক্ষোভ দেখান। অথচ বহু প্রজন্মের শিশু শিক্ষা না পেয়েই স্কুলে কাটিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর, তা নিয়ে যেন কারও মাথাব্যথাই নেই।’ স্বাতী ভট্টাচার্য খোঁজ করেছেন রাজ্যের হরেক প্রান্তের স্কুলের অন্দরমহলে। স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শিক্ষকদের সম্পর্ক, ছাত্র-শিক্ষকের ভাষার ব্যবধান থেকে মিড-ডে মিলের ডিম, তাঁর লেখায় উঠে এসেছে অজস্র প্রশ্ন, এবং অনেক উত্তর। সাংবাদিকের দায়িত্ব কী ভাবে পালন করতে হয়, এই বইটি (বাঘের দুধ/ পশ্চিমবঙ্গের স্কুলে শিক্ষা ও সক্ষমতার খোঁজ, প্রতিক্ষণ, ৩০০.০০)তার উদাহরণ।
রবীন্দ্রসঙ্গীত-আলোচনায় সুধীর চক্রবর্তী পরিচিত নাম। এই বিষয়ে বেশ ক’টি বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। এলেম নতুন দেশে (সিগনেট প্রেস, ২৫০.০০) অবশ্য এক অর্থে নতুন, কারণ আগের পাঁচটি গ্রন্থই ছিল বিভিন্ন নিবন্ধের সঙ্কলন। এই বইটিতে একটিই দীর্ঘ লেখা। রবীন্দ্রনাথই এমন এক জন গীতিকার-সঙ্গীতকার, যাঁর মৃত্যুর আট দশক পরেও তাঁর গান গবেষকদের কাছে নিত্যনতুন জানালা-দরজা খুলে দিচ্ছে— এই অত্যাশ্চর্য সত্যটি মাথায় রাখলে বোঝা যায়, কেন এখনও নতুন করে রবীন্দ্রসঙ্গীত পাঠ করা প্রয়োজন। রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘নতুন দেশ’, কারণ তা ‘‘এক অজানা দেশের অচিন মনের ভাষায় রচিত অভিনব উদ্ভাসন। বিশেষ করে সেই গানের ক্রমাগ্রসর চিত্তভূমি ও নবীন উৎসার বারেবারেই নতুন, ফিরে ফিরেই নতুন।’’
কম বয়স থেকেই কবিতাপাঠ ও বুদ্ধদেব বসুর রচনাদি আন্তর্জাতিক কবিতার সঙ্গে সম্পর্কিত করেছিল তাঁকে, বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ দশ জন কবির ব্যক্তিগত জীবন ও সাহিত্যচর্চা নিয়ে নিজের নতুন বই বেরিন তরঙ্গের নিটোল মুক্তা প্রবাল-এর (সিগনেট প্রেস, ৪০০.০০) ভূমিকায় জানিয়েছেন ব্রাত্য বসু। বরিস পাস্তেরনাক পাবলো নেরুদা ভ্লাদিমির মায়াক্ভস্কি পল এলুয়ার সিলভিয়া প্লাথ গার্সিয়া লোরকা প্রমুখ যাঁদের নিয়ে লিখেছেন, তাঁদের চমৎকার মুখাবয়ব এঁকেছেন রৌদ্র মিত্র। যে হেতু গোটা বিংশ শতাব্দীর সমাজ-রাজনৈতিক ইতিহাসে লগ্ন হয়ে আছে আলোচিত এই কবিদের সাহিত্য, তাই তাঁদের জীবনেরও নিয়ামক হয়ে উঠেছিল কোনও-না-কোনও ‘ক্ষমতা’— নিজস্ব এই ভাবনার সাপেক্ষে ব্রাত্য উদ্ধৃত করেছেন উইলিয়াম গোল্ডিং-এর মন্তব্য: ‘‘মানব ইতিহাসে সবচেয়ে হিংস্র শতাব্দী হল বিংশ শতাব্দী।’’
শঙ্খ ঘোষের অসামান্য ‘ভূমিকা’ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে কাহ্ন সমগ্র সংকলন (সম্পাদনা: পিনাকী ঠাকুর শিবাশিস মুখোপাধ্যায়, পরম্পরা, ৫০০.০০)। মূলত নব্বইয়ের দশকের কবিদের কবিতাপত্রিকা ‘কাহ্ন’। শঙ্খবাবু এ পত্রিকাতেই লিখেছিলেন সেই প্রবাদপ্রতিম কবিতা— ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।’ সেখান থেকে শুরু করে আনন্দ পাবলিশার্স-এর দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু, যিনি কিনা ‘বাদল বসু’ নামে বেশি পরিচিত, তাঁর জীবনের অনেকগুলো দিন এই ‘কাহ্ন’-য় প্রকাশিত হয়েছিল। সে সব নিয়েই পথ চলা ছিল কাহ্ন-র। যে কোনও লিটল ম্যাগাজিনের মতো এরও যে কোনও সময় স্তব্ধতা আসতে পারে! এসেওছে। কিন্তু সম্পাদক সযত্নে তাকে একই ‘মলাটবন্দি’ করেছেন।
উপনিবেশ-পূর্ব বাংলার অর্থনীতির বিপুল দুর্যোগের কথা শুনিয়েছেন পিটার মার্শালের মতো ইতিহাসবিদ, ওম প্রকাশ বলেছেন ইউরোপীয় কোম্পানির বস্ত্রব্যবসা বাংলায় লক্ষ মানুষের কাজের সুযোগ তৈরি করেছিল। এ ধরনের তথ্য ও তত্ত্ব দৃঢ়তার সঙ্গে খণ্ডন করেছিলেন সুশীল চৌধুরী, তাঁর বিভিন্ন বইয়ে। সেই পথ ধরেই বিশ্বেন্দু নন্দ লিখেছেন পলাশীর পূর্বে বাংলার বাণিজ্য (কলাবতী মুদ্রা, ৫০০.০০)। মুঘল জমিদারি ব্যবস্থার আলোচনা দিয়ে শুরু করে বাঙালি ব্যবসায়ীদের সমৃদ্ধির স্পষ্ট ছবি তুলে ধরেছেন তিনি, ভেঙেছেন নানা মিথ। বস্ত্রের সঙ্গে সোরা ও আফিমের ব্যবসার কথাও তুলে ধরেছেন তিনি। সাধারণ পাঠকের উপযোগী করে লেখা বইটি নতুন চিন্তায় উৎসাহ দেবে।
সতেরো বছর আগে সুকুমার রায়কে নিয়ে একটি চমৎকার সংখ্যা প্রকাশ করেছিল কোরক। দুষ্প্রাপ্য সেই সংখ্যাটির পরিমার্জিত সংস্করণ গ্রন্থাকারে প্রকাশ পেল— নানা সুকুমার/ কোরক সংকলন (সম্পাদনা তাপস ভৌমিক, কোরক, ১৭৫.০০)। প্রথম পর্বে রয়েছে সুকুমার রায়ের সাহিত্যকীর্তি নিয়ে নানা জনের আলোচনা, দ্বিতীয় পর্বে স্মৃতিচারণ।
মৃৎশিল্পে কৃষ্ণনগরের পুতুল উনিশ শতকেই দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও কদর পেয়েছিল। আজ বৈচিত্র ও বিপণনে তা আরও সমাদৃত। শহুরে মেলায় কৃষ্ণনগর ছাড়া পাঁচমুড়া, মজিলপুর, হাটপাড়া, কুনুর ইত্যাদি জায়গার পুতুলই মূলত দেখা যায়। নতুনগ্রামের কাঠের পুতুলও মেলায় ছেয়ে থাকে। মাটি ও কাঠ-সহ গালা শোলা ডোকরা ঝিনুক শিং পাটের পুতুলের তথ্যহদিশ তো আছেই— জেলায় জেলায় পুতুলের খোঁজ, পুতুল গড়ার কৌশল, সংগ্রহশালায় পুতুলের সংগ্রহ ও চর্চার পরম্পরা নিয়ে এই বই (বাংলার পুতুল, দীপঙ্কর ঘোষ ও ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী, আনন্দ, ৫০০.০০)। অজস্র রঙিন আলোকচিত্র এবং প্রাসঙ্গিক বই ও প্রবন্ধের তথ্যপঞ্জিও অন্যতম আকর্ষণ। অখণ্ড বাংলাব্যাপী সার্বিক আলোচনার প্রেক্ষাপটে, বাঙালির জীবনসংস্কৃতিতে শিল্পরূপের পরিচয় তৈরি হয়েছে এই পুতুল চর্চায়।
‘পরিবেশ কথাটি বাঙালি মননে কবে এল?’ পরিবেশ নিয়ে বাঙালির চিন্তার পটপরিবর্তনকে নিবিড় ভাবে ধরতে চেয়েছেন মোহিত রায় (বাঘা যতীন হইতে ব্যাঘ্র প্রকল্প/ বাঙালি মননের পরিবেশ যাত্রা, আনন্দ, ৩০০.০০)। যা ছিল বৈচিত্রময়, রহস্যপূর্ণ প্রকৃতি, তার সঙ্গে ক্রমে যোগ হল ‘আবহাওয়া’-র ধারণা, আর তারপরেই এল দূষণের অনুষঙ্গ। যার সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে হয়, সেই প্রকৃতি পরিবর্তিত হল পরিবেশে, যাকে রক্ষা করতে হয়। ইন্দিরা গাঁধী, মাও জে দং বা শ্রীরামকৃষ্ণ কী ভাবে দেখেছেন প্রকৃতি তথা পরিবেশকে, কেমন করে দেখেছেন জগদীশ গুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, কিংবা গাছ কাটার প্রতিরোধে ‘চিপকো’ আন্দোলন, নিয়মগিরিতে খনি-বিরোধী আন্দোলনের শরিকেরা, অনেক যত্নে তুলে ধরেছেন লেখক। তাঁর কলম স্বচ্ছন্দ, যুক্তিও স্বচ্ছ।