পুস্তক পরিচয় ১

নাম শুনলেই রোমহর্ষণ

গোয়েন্দা-কাহিনির বেলায় এ কথাটা আরও বেশি সত্য হয়ে ওঠে, কারণ তা একটি জনপ্রিয় ‘জন্‌র’ বা সংরূপ, এবং পাঠকের রুচি, অপরাধের সমাজতত্ত্ব, গোয়েন্দাগিরির শৈলী বদলের সঙ্গে সঙ্গে তার জনপ্রিয়তার ভিত্তিও বদলে যায়, জনপ্রিয়তা কেবল জনশ্রুতিতেই টিকে থাকে।

Advertisement

পবিত্র সরকার

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share:

রহস্য: শার্লক হোমসের ‘স্পেকল্‌ড ব্যান্ড’ গল্পের প্রমথনাথ দাশগুপ্ত কৃত অনুবাদ ‘ডোরা বাঁধ’-এর অলংকরণ। ‘মালঞ্চ’, জ্যৈষ্ঠ ১৩২১ বঙ্গাব্দ

সেকালের গোয়েন্দা কাহিনি, প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড

Advertisement

সম্পাদক: অরিন্দম দাশগুপ্ত

৫০০.০০ ও ৬০০.০০

Advertisement

আনন্দ পাবলিশার্স

সংস্কৃতির যে কোনও ক্ষেত্রে উৎপাদনের যে অব্যাহত প্রক্রিয়া চলে, তাতে, যা ধ্রুপদী তকমা নিয়ে আসে তাকে বাদ দিলে, আজকের নতুন কাল বা পরশুর নতুনকে পুরনো করে দেয়। এবং উপভোক্তারাও— পাঠক হোন, দর্শক হোন, শ্রোতা হোন, তাঁরাও অনেকে নতুনকে পেয়ে পুরনোকে ভুলে যান— এমন হতেই পারে। উপভোক্তাদের নতুন প্রজন্ম হয়তো পুরনোর খবরই রাখেন না। একমাত্র সাহিত্য বা সংস্কৃতির ইতিহাসকারেরা পিপীলিকার নিষ্ঠা নিয়ে পুরনোকে নথিবদ্ধ করেন, ইতিহাসের শূন্যস্থানকে পূরণ করেন। গোয়েন্দা-কাহিনির বেলায় এ কথাটা আরও বেশি সত্য হয়ে ওঠে, কারণ তা একটি জনপ্রিয় ‘জন্‌র’ বা সংরূপ, এবং পাঠকের রুচি, অপরাধের সমাজতত্ত্ব, গোয়েন্দাগিরির শৈলী বদলের সঙ্গে সঙ্গে তার জনপ্রিয়তার ভিত্তিও বদলে যায়, জনপ্রিয়তা কেবল জনশ্রুতিতেই টিকে থাকে।

তবু তার কোনও আকর্ষণ কি থেকে যায়? ‘অতৃপ্তির দীর্ঘশ্বাস রেখে দিয়ে যায় সে বাতাসে?’ এক কালের মুগ্ধতা অন্য কাল কতটা পুনরুদ্ধার করতে পারে? যেন তারই পরীক্ষা করার জন্য বিশ শতকের প্রথম দু-দশকের কিছু জনপ্রিয় গোয়েন্দা কাহিনি উদ্ধার করে সাজিয়েছেন সম্পাদক। কয়েক বছর আগে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘দারোগার দপ্তর’ বেরিয়েছে। প্রথম খণ্ডে আছে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘রাণী না খুনি’ (‘খুনি’ বানান মূলের?), ‘শেষ লীলা’, ‘পাহাড়ে মেয়ে’, শরচ্চন্দ্র সরকারের ‘সাবাস চুরি!’, দীনেন্দ্রকুমার রায়ের ‘অজয় সিংহের কুঠি’, ক্ষেত্রমোহন ঘোষের ‘প্রতাপচাঁদ’, পাঁচকড়ি দে-র ‘গোবিন্দরাম’, ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘বাবু চোর’। দ্বিতীয় খণ্ডে আছে সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য ‘প্রণীত’ ‘দুই দারোগা’, রমানাথ দাসের ‘চুম্বনে খুন’, বিনোদবিহারী শীলের ‘খুন বা অখুন’, শরচ্চন্দ্র সরকারের ‘হরতনের নওলা’, মণীন্দ্রনাথ বসুর ‘ভীষণ প্রতিহিংসা’, কিশোরীমোহন বাগচীর ‘অদ্ভুত হত্যাকাণ্ড’, সুরেশচন্দ্র সমাজপতির ‘ছিন্নহস্ত’। সম্পাদক এঁদের সকলের নামকেই ‘শ্রী’মণ্ডিত করেছেন, আমরা একালের শ্রদ্ধাহীন প্রজন্ম তার উল্লেখ করছি না।

নাম থেকেই যদি পাঠকের যথেষ্ট রোমহর্ষণ না হয়, তা হলে বলি, এ আখ্যানগুলি যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক। পটভূমিতেও বৈচিত্র্য আছে, কলকাতা, দিল্লি, পঞ্জাব, বম্বে, রাজস্থান— নানা অঞ্চলের নানা চরিত্র ও ঘটনা পাঠকের অভিজ্ঞতাকে নানা দিকে আমন্ত্রণ করে। প্রতিটির সারসংক্ষেপ দেওয়ার কথা আমরা ভাবিনি, পাঠকের নিজেকেই সেই উদ্যোগ নিতে হবে, নিলে তিনি অপুরস্কৃত থাকবেন না, তাও বলতে পারি। ফাউ হিসেবে পাবেন একটা ‘অ্যান্টিক’ গন্ধ— ভাষাতে পাবেন “ধূপ-দীপ জ্বালিয়া রমণী একখানি তালীর উপর ধুনা রাখিয়া দীপাগ্নিতে তাহা প্রধূমিত করিলেন” জাতীয় নমুনা, আর পৌঁছে যাবেন সেই এক সময়ে যখন হাওড়ায় ইস্পাতের পুল তৈরি হয়নি, পন্টুন ব্রিজ আছে— নির্দিষ্ট সময়ে তা নৌকা চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হত। তখনও অপরাধের সঙ্গে বারবনিতাদের, কখনও কামার্তা নারীর (একজনের নামই প্রসিদ্ধ ভাবে ‘কামময়ী’) একটা যোগ প্রায় অনিবার্য ভাবেই পাওয়া যেত। তবে গোবিন্দরাম (হোমস বেহালা বাজাতেন, সে সেতার বাজায়) ছাড়া অন্য গোয়েন্দারা মোটামুটি সোজা-সাপটা দারোগা বা গোয়েন্দা, প্রচুর বুদ্ধিধারী ও ক্ষমতাশালী— কিন্তু কেউ কোনও কোনও মার্কিন গোয়েন্দার মতো নারীপ্রিয় নন, নিরো উল্‌ফের মতো বিশালদেহী ভোজনপ্রিয় নন আর মিস্‌ মার্প্‌লের মতো নারী গোয়েন্দার আবির্ভাব তখন তো সম্ভবই ছিল না। পরে গত শতকের পঞ্চাশের বছরগুলিতেই সম্ভবত প্রভাবতী দেবী সরস্বতী বাঙালি তরুণী গোয়েন্দা কৃষ্ণাকে নিয়ে আসেন। কোনও কোনও আখ্যানে পেরি মেসনের গল্পের মতো আদালত-দৃশ্যও পাঠককে আমোদিত করে।

দুটি খণ্ডেই সম্পাদক পরিশ্রমী ও সপ্রতিভ ভূমিকা যোগ করেছেন। সুকুমার সেনের দু-একটি তথ্যের তিনি সংশোধন করেছেন, যথোচিত সংযম ও বিনয়ের সঙ্গে, তা আমাদের ভাল লেগেছে। কিছু পুরনো ছবিও পুনর্মুদ্রণ করেছেন, তবে সেকালের আর্ট পেপারের অভাবে সেগুলি একটু নিষ্প্রভ। আর পাঁচকড়ি দে-র গল্পের রোমাঞ্চকর ছবি বোধ হয় ভব্যতা রক্ষার খাতিরেই দেননি। দু-একটি প্রশ্ন আমাদের তৈরি হয়েছে অবশ্য। সম্পাদক প্রথম খণ্ডের বেশিরভাগ রচনা ‘প্রণীত’ বলে নির্দেশ করেছেন, কিন্তু প্রথম খণ্ডের একটি এবং দ্বিতীয় খণ্ডের একাধিক রচনার সূচিপত্রে কোনও রচনার আগে ‘সংকলিত’ আবার কোনওটির আগে ‘সম্পাদিত’ কথাগুলি তিনি ব্যবহার করেছেন। এই আলাদা আলাদা কথাগুলির মধ্যে তফাত কী? ‘সম্পাদিত’ হলে অন্য কার রচনা কৃতিত্বধারী লেখক সম্পাদনা করেছেন? ‘সংকলিত’ মানে কি সংশ্লিষ্ট লেখক অন্য কোনও উৎস থেকে সংকলন করেছেন? তা হলে সে উৎসটি কী, এবং মূল লেখক কে? এর মধ্যে কোনওটির সঙ্গে অনুবাদ বা দেশিকরণের কোনও সম্পর্ক আছে কি না জানি না। কিন্তু ফরাসি উৎস থেকে নেওয়া ‘অজয় সিংহের কুঠী’-র বেলাতেও তো দীনেন্দ্রকুমার রায় ‘প্রণীত’ লিখেছেন। এইখানে আমাদের একটু ধাঁধা তৈরি হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় সম্পাদক লিখেছেন যে, তিনি ছাপার ভুল সহ মূল সংস্করণগুলির বানান অপরিবর্তিত রেখেছেন। এ সিদ্ধান্তে যুক্তি আছে। কিন্তু যদি এই নতুন সংস্করণে কিছু ছাপার ভুল প্রবিষ্ট হয়, সেগুলির সঙ্গে পুরনো ভুলের তফাত করব কী করে? কোন্‌টি ‘ধ্রুপদী’ ছাপার ভুল, আর কোন্‌টি ‘নব্য’— কী করে বুঝব? যেমন প্রথম খণ্ডের ৪২৮ পৃষ্ঠায় ‘আপার’ আছে ‘আপনার’ বদলে। ৬৩৩ পৃষ্ঠাতে আছে ‘আমি’ হবে ‘আপনি’। এ সব কি মূলে ছিল?

এ দুটি খণ্ড অবশ্যই একালের পাঠককেও কিছু উপভোগ্য সময় উপহার দেবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement