নরক/ দান্তে আলিগিয়েরি
অনুবাদক: আলপনা ঘোষ
মূল্য: ৪০০.০০
প্রকাশক: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
পড়ে বা না পড়েই হোক, সাহিত্যপিপাসু মাত্রেই দান্তে আলিগিয়েরির ‘দিভিনা কম্মেদিয়া’-কে (বাংলায় ‘দিব্য মিলন’) বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলে মানেন। সাতশো বছর আগের তস্কানো ভাষার সঙ্গে এখনকার ইতালীয় ভাষার ফারাক বিস্তর, কবিতার বিষয় ও প্রতীকী ব্যঞ্জনাও দুরূহ। মূলের রস-স্বাদ গ্রহণে তাই বারবার অনুভূত হয়েছে অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা। যাদবপুরের ‘ইতালীয়-বাংলা অনুবাদমালা’ সিরিজে সম্প্রতি বেরিয়েছে ‘দিব্য মিলন’-এর প্রথম খণ্ডের গদ্য-অনুবাদ ‘নরক’। আলপনা ঘোষ মূল ইতালীয় থেকে নতুন করে অনুবাদ করেছেন। বইয়ের শুরুতে দীর্ঘ ভূমিকাটি সযত্নকৃত, তেরোশো শতাব্দীর এক কবির সমাজ ও মানসজগতের তল পেতে গেলে যা অনিবার্য। দান্তের নরকের এক বিশেষ ভূগোল আছে, আছে তৎকালীন ফ্লোরেন্সের রূপকাশ্রয়ী সমাজচিত্র। উপযুক্ত পথনির্দেশ ছাড়া পাঠকের তাতে পথ হারানোর সমূহ সম্ভাবনা। আলপনা তাই অনেকগুলি সর্গের শেষে টীকা যোগ করেছেন, বই-শেষে দিয়েছেন ব্যক্তি ও স্থান-নামের আদি ইতালীয়, অভ্যস্ত ইংরেজি ও বাংলা রূপভেদ।
বর্ধমান জেলায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের অতীত প্রসঙ্গ
লেখক: সৈয়দ শাহেদুল্লাহ
মূল্য: ৩০০.০০
প্রকাশক: নতুন চিঠি, বর্ধমান
আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের কর্তারা শুনলে হয়তো রাগ করবেন, কিন্তু আজকের বামপন্থী দলগুলোকে দেখলে গত শতকের প্রথমার্ধের বামপন্থী রাজনীতির চেহারা আঁচ করার বিন্দুমাত্র উপায় নেই। কিন্তু, সে ইতিহাস ভুলে গেলে আজকের রাজনীতিরও মুশকিল, কারণ কী ভাবে পশ্চিমবঙ্গ একদা বাম দুর্গে পরিণত হয়েছিল, তা বোঝার একমাত্র পথ সেই ইতিহাসকে জানা। সৈয়দ শাহেদুল্লাহ-র বইটির মূল প্রাসঙ্গিকতা সেখানেই। প্রায় পঁচিশ বছরের ব্যবধানে বইটি পুনর্মুদ্রিত হল। প্রাক্-স্বাধীনতা পর্বে জেলায় দলের সংগঠন থেকে স্বাধীনতার পর পার্টি নিষিদ্ধ হওয়া, খাদ্য আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন— রাজ্যে বামপন্থী রাজনীতির পায়ের নীচে মাটি পাওয়ার একটি আখ্যান এই বই। খাবারের অভাবে আত্মহত্যা করতে আসা মা-মেয়েকে কী ভাবে দু’মুঠো অন্নের সংস্থান করে দেন এক পার্টিকর্মী, কী ভাবে এক মহাজন পরিবারের ছেলে জড়িয়ে পড়েন বাম রাজনীতিতে, এমন সব গল্পে দেখা যায়, বাম রাজনীতি ঠিক কী ছিল। আজকের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে বোধ হয় ভুলগুলো খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
শালিমারে সংঘাত
লেখক: শ্রীজাত
মূল্য: ২০০.০০
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স
রায়পাড়ায় থাকেন নানান চরিত্র— গেঞ্জি কারখানার মালিক স্যান্ডো-মোহন, সোনার ব্যবসায়ী তিলু রায়, সেতারবাদক সঞ্জয় সোম, পচা ছানার মিষ্টি প্রস্তুতকারী আল্টু চৌধুরি, গায়ক কুমারকীর্তনের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের বাইক বাপি, স্ট্রাইক বাপি, লাভলি, হারু, টফি দে ও আরও অনেকে। এদের সকলকে এক মলাটে জড়ো করেছেন শ্রীজাত; খেলা জমানোর জন্য সঙ্গে আছেন ডন ছোটা মহেন্দ্র, ইন্টেলিজেন্সের হেড অনিমেষ ধর, রাশিয়ান উগ্রবাদী চাকুভিচের মতো অনেক চরিত্র ।
উপন্যাসের গৎ-টা শীর্ষেন্দুমাফিক— প্রথমে, একের পর এক নতুন চরিত্রের পরিচয় ঘটানো, তারপর তাঁদের পারস্পরিক যোগসূত্র স্থাপন এবং সবশেষে সুতো গুটিয়ে সকলকে মিলিয়ে দিয়ে গল্পের ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছনো। তবে, শ্রীজাত-র গদ্য লেখার ভাষাটা আনকোরা; তাঁর কবিতা বা সিনেমার গান থেকেও আরও ‘হালকার ওপর লাইট করে’ লেখা তাঁর জীবনের ডেবিউ উপন্যাস। আমাদের মুখের ভাষায় ব্যবহৃত ইংরাজি শব্দের বাংলা প্রতিসম খোঁজার ভড়ং তাঁর তো নেইই, বরঞ্চ উল্টে এই উপন্যাসের “টপ টু বাটাম” বাংলার বদলে যত্রতত্র ইংরাজি, এমনকী হিন্দি শব্দের ব্যবহার। পড়তে পড়তে উপন্যাসের নায়িকার মতোই বলতে ইচ্ছে করে, ‘নট ব্যাড...’!
তবে, নতুন ভাষা ইনভেন্টের জন্য নয়, ক্ল্যাপ-ক্ল্যাপ করুন, বাংলা সাহিত্যে নতুন এক চরিত্র উদ্ভাবনের জন্য; রায়পাড়ায় সকলের মাঝে মিশে থাকেন এক আন্ডারকভার এজেন্ট— বোস, বিলিতি বোস। রায়পাড়ার সকলকে নিয়ে এক বিশেষ টিম তৈরি করে চাকুভিচ আর তাঁর সঙ্গিনী আনা-কে কী ভাবে শালিমারের ডকের এই সংঘাতে নাস্তানাবুদ করলেন তিনি তাই নিয়ে এই উপন্যাস; সঙ্গে বোনাস হিসেবে মিলবে ফিল্মি বেডসিন, কিডন্যাপ, সেম-সেক্স যুগলপ্রেম। শিগগির চিত্রনাট্য লেখা হলে আশ্চর্য হওয়ার কারণ নেই ।
শ্রীজাতকে অনুরোধ, এহেন ‘বিলিতি’ উপন্যাস আরও লিখুন ।
রথ যাত্রা / চ্যারিয়ট ফেস্টিভ্যাল অব শ্রী জগন্নাথ ইন পুরী
লেখক: সুভাষ পানি
মূল্য: ১৯৯৫.০০
প্রকাশক: নিয়োগী বুকস
খ্রিস্টীয় একাদশ শতকে অনন্তবর্মা চোড়গঙ্গের হাতে পুরীর জগন্নাথ মন্দির বা শ্রীমন্দির নির্মাণের সূচনা, ভোগমণ্ডপটি পঞ্চদশ শতকের শেষে তৈরি করেন গজপতি পুরুষোত্তমদেব। মন্দির চত্বরে রয়েছে আরও অনেক দেবদেবীর অবস্থান, কোনও মন্দির প্রাচীনতর, কোনওটি তুলনায় নবীন। কিন্তু শ্রীক্ষেত্রের পৌরাণিক ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। বিষ্ণুর নীলমাধব রূপে পূজা, পরে বর্তমান রূপে জগন্নাথ সুভদ্রা বলরামের প্রকাশ এবং অবন্তীরাজ ইন্দ্রদ্যুম্নের হাতে তাঁদের পূজা প্রতিষ্ঠা তথা মন্দির সূচনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্কন্দপুরাণে বিধৃত পৌরাণিক ইতিবৃত্ত। পুরীর অবস্থানও লক্ষণীয়, ভারতের চার প্রান্তে চারটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থের তা অন্যতম। শুধু বৈষ্ণবধর্ম নয়, এখানে রয়েছে শৈব ও শাক্ত ধারাও— বলরাম বা বলভদ্র শৈব ধারা এবং সুভদ্রা শাক্ত ধারার প্রতীক। এমনকী সৌর উপাসনাও এখানে ব্রাত্য নয়। বস্তুত শ্রীমন্দিরের বহুবিচিত্র পূজাপদ্ধতির মধ্যে এত ধারার মিলনমিশ্রণ ঘটেছে যে সব আর আজ পৃথক করা কঠিন। তবু খুব নির্দিষ্ট ভাবে বোঝা যায়, আদিতে শবররা পূজা করত বলেই আজও তাদের বংশধর বলে কথিত ‘দৈতা’ সেবকদের গুরুত্ব রয়ে গিয়েছে বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে, যেমন স্নানযাত্রার পর থেকে রথযাত্রা পর্যন্ত।
‘রথযাত্রা’ জগন্নাথদেবের সব থেকে বড় উৎসব, ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় সমারোহও বটে। এ নিয়ে প্রচুর লেখাপত্র সত্ত্বেও সুভাষ পানির মতো যিনি অন্তরঙ্গ ভাবে চার দশকেরও বেশি এই উৎসবের সব দিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন তার কলমে একটি বই খুবই জরুরি ছিল। ‘নবকলেবর’ থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি আচার-অনুষ্ঠান তিনি সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন, তাঁর লেখায় রথ নির্মাণ পাঠকের সামনে স্তরে স্তরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রথযাত্রার কথা বলতে গিয়ে তিনি পরিচয় করিয়ে দেন শ্রীমন্দিরের প্রতিটি অংশের সঙ্গে, তার স্থাপত্য ভাস্কর্য আচার অনুষ্ঠান সব মিলিয়ে। পৌরাণিক যুগ থেকে আধুনিকতম পর্বে শ্রীক্ষেত্রের রূপান্তর, অন্যান্য মঠ-মন্দিরের সঙ্গে শ্রীমন্দিরের সম্পর্ক, নানা পরম্পরাবাহিত লোক-ঐতিহ্য ও লোকশিল্পের কথা সবই এসেছে আলোচনায়। আছে বহু দুর্লভ ছবি। রথযাত্রার তাৎপর্য বুঝতে চাইলে এ বই অবশ্যপাঠ্য।