পুস্তক পরিচয় ২

স্মৃতির আখ্যান যেন ইতিহাস-জিজ্ঞাসা

সিন্ধুতলে তাঁর বারংবার দুঃসাহসী অভিযান দিয়ে সেই গ্রহান্তরের পরিচয় পাওয়ার শুরু। যত দিন যাচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে সত্যিই এই পৃথিবী তার ভেতরে ধরে রেখেছে আর-একটা গ্রহকে, যাকে আমরা এতদিনেও মাত্র আবছা জেনেছি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share:

সিন্ধুবাসী/ ভারতের প্রবাল-প্রাচীরের প্রাণীরা।

সিন্ধুবাসী/ ভারতের প্রবাল-প্রাচীরের প্রাণীরা

Advertisement

লেখক: কৌশিক

৪৯৯.০০

Advertisement

নেচারিজম

স্বশিক্ষিত প্রকৃতিবিদ উইলিয়াম বিবি (১৮৭৭-১৯৬২), পরবর্তী দিনে নিউ ইয়র্ক জুলজিক্যাল সোসাইটির অন্যতম গবেষক, সমুদ্রের নিচে থাকা জগৎটির তুলনা করেছিলেন ভিনগ্রহের সঙ্গে। সিন্ধুতলে তাঁর বারংবার দুঃসাহসী অভিযান দিয়ে সেই গ্রহান্তরের পরিচয় পাওয়ার শুরু। যত দিন যাচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে সত্যিই এই পৃথিবী তার ভেতরে ধরে রেখেছে আর-একটা গ্রহকে, যাকে আমরা এতদিনেও মাত্র আবছা জেনেছি। আমাদের সৌভাগ্য, ভারতের ৭৫০০ কিমি দীর্ঘ তটরেখা অতুলনীয় সামুদ্রিক ঐশ্বর্যে পূর্ণ, যদিও জলের পর্দা সরিয়ে তা আমাদের দেখা হয় না। ইদানীং স্নরকেলিং এবং স্কুবা প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে এর কিছুটা আস্বাদ নেওয়ার সুযোগ অবশ্য তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে প্রকৃতি-নিরীক্ষক কৌশিক ওই বিচিত্র রঙিন এবং নির্ভুল ভাবে রহস্যময় জগতের প্রায় পৌনে দুশো বাসিন্দার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করালেন। প্রবাল, শামুক, অঙ্গুরিমাল, জেলিফিশ, পাখি, মাছ, সাপ এবং তিমি ইত্যাদি স্তন্যপায়ী সহ সমুদ্রের অধিবাসী প্রায় প্রতিটি প্রধান প্রাণীগোষ্ঠীর সদস্য এখানে বর্ণিত হয়েছে, রঙিন ছবি সহযোগে। সৈকতে আবিষ্ট পর্যটক কল্পনাও করতে পারেন না, তাঁর কয়েক মিটার দূরেই রয়েছে এই ধুন্ধুমার রঙের বিক্ষোভ। প্রাসঙ্গিক কিছু সংক্ষিপ্ত আলোচনা রয়েছে বইয়ের গোড়ায় ও শেষে। কৌশিক লিখেছেন: ‘এই প্রকাশনায় সেই প্রাণীদেরই বিবৃত করা হয়েছে যারা সাধারণত প্রবাল-প্রাচীরের নিকট দৃশ্যমান। যদিও এই স্বল্প পরিসরে প্রাণী-সাম্রাজ্যের সেই বিপুল ভাণ্ডারকে স্থান করে দেওয়া সাধ্যের অতীত।... ভারতের বিভিন্ন উপকূলে, প্রবাল-প্রাচীরে, আন্দামানের দ্বীপপুঞ্জে ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে সংগৃহীত হল এমন দুর্লভ ছবির সম্ভার ও অভিজ্ঞতা, যা পাঠকদের জন্য প্রকাশ করার দায়বদ্ধতা অনুভব করলাম।’ জলের নিচে আলোকচিত্র নেওয়ার প্রযুক্তিগত বাধা সামলে একক চেষ্টায় এমন ব্যাপ্তির একটি বই নির্মাণের উদ্যোগকে মুক্তকণ্ঠে সাধুবাদ জানানো দরকার। রচনাংশে অবশ্য আরও সজাগ দৃষ্টি দরকার ছিল। বর্ণনা কিছুটা খাপছাড়া, বহু বাক্য অভিপ্রেত অর্থ বহন করে না। প্রাণীগুলোর বাংলা নামকরণের চেষ্টা সমান ফলপ্রদ হয়নি। কিন্তু স্বীকার করতেই হবে, সমুদ্রবৈচিত্রের দিকে প্রাথমিক আগ্রহ জাগানোর কাজে এই পথিকৃৎ গ্রন্থটি সফল।

ভারতজোড়া কাব্যগাথা

সম্পাদক: রামকুমার মুখোপাধ্যায়

৪০০.০০

মিত্র ও ঘোষ

‘ভারতবর্ষ কোনদিকে’ আপাতসরল এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু সহজ নয় মোটেও। কতটুকু চিনি আমরা পড়শি রাজ্য, পড়শি ভাষাকে? ভারতজোড়া সাহিত্যের এক অন্তরঙ্গ রূপ ফুটে উঠেছে বইটিতে। এখানে স্থান পেয়েছে ভারতের পঁচিশটি ভাষার ষাট জন কবির বাংলায় অনূদিত তিনশো কবিতা। অসমিয়া, উর্দু, ওড়িয়া, ভারতীয় ইংরেজি, হিন্দি, কন্নড় ইত্যাদির পাশাপাশি স্থান পেয়েছে বোড়ো, ককবরক, ডোগরি, চাকমা, নাগা, নেপালি, মণিপুরি, সিন্ধি, সাঁওতালি এমনকী সংস্কৃত ভাষার কবিতাও। ভারতীয় ইহুদি নিসিম এজেকিয়েল যখন লেখেন, ‘যা কিছু দুচোখে দেখি— চারপাশে এত আয়োজন/ না থাকার বিপ্রতীপে কিছুই কি থাকে তার পরে?/ দেখার সীমানা পার— অদেখার সীমানা পেরিয়ে/ সত্য খুঁজে মরে।’ তখন তাঁর নিঃসঙ্গতা ও অস্তিত্বের সংকট আমাদের পরিচিত ভারতীয়ত্বের শিকড় ধরে টান দেয়। এই বেদনায় কোথাও যেন তাঁকে ছুঁয়ে থাকেন সিন্ধি কবি বাসুদেব মহী। ‘ইংরেজি/ দেয় আমায় জীবিকা/ হিন্দী বাঁধে আমায় দেশের সাথে/ সিন্ধি/ দেখায় আমায় স্বপ্ন।’ প্রশ্নটা ঘুরপাক খায়, স্বপ্ন দেখার ভাষায় কেন এঁরা যুক্ত হতে পারেন না দেশের সঙ্গে? সে দায় কার?

ডেটিনিউ

লেখক: অমলেন্দু দাশগুপ্ত

২২৫.০০

ঋত প্রকাশন

জেলজীবন চলছে তখন অমলেন্দু দাশগুপ্তের, লিখেছেন ‘জেলখানাতে আমাদের সপ্তাহে সাতটাই রবিবার।’ তেমনই এক রোববার চোখ মেলে দেখেন ‘‘ঘরের মধ্যে একদল সত্যাগ্রহী।... আমার খাটের সামনেই ঘরের মধ্যে সেই ভদ্রলোক। ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিলাম, মশারিটা তুলিয়া চাঁদোয়া করিয়া রাখিলাম। কাণ্ড দেখিয়া দু’চোখ আমার বিস্ময়ে যেন হাঁ করিয়া রহিল— ভদ্রলোক নৃত্যসংবলিত গান গাহিতেছেন! তিনি জেলের একখানি কম্বল বাউলের আলখাল্লার মতো করিয়া পরিধান করিয়াছেন। ব্রুকবন্ড-চায়ের বড়ো একটা কৌটা, কিছু বাখারি ও তারের সংযোগে বাউলের একতারা হইয়াছে,... তিনি গাহিতেছিলেন— ‘হে মুসাফির আর কত ঘুমাইবে? এখন জাগো। অনেক দূর যে যাইতে হইবে, সে-খেয়াল নাই নাকি? নেও, উঠো—’।’’ অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯০৩-’৫২) স্বাধীনতা আন্দোলনে ১৯২০-’২১ থেকে, তখন থেকেই তাঁর কারাবাসের শুরু। ১৯৩০ থেকে ডেটিনিউ বা নজরবন্দি হিসেবে কেটেছে আট বছর, এর পর আবার ১৯৪০-এ সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ আন্দোলনে জড়িয়ে ১৯৪৬ অবধি কারাবাস। এই সময় প্রেসিডেন্সি জেলেই তিনি লিখেছেন ডেটিনিউ। তাঁর মতো বিপ্লবীরা যে কারা-নির্যাতনকে গ্রহণ করতেন প্রায় জীবনযাপনের স্বাভাবিকতায়, সেই ব্রত বা মূল্যবোধ এক নিরুচ্চার আত্মসম্ভ্রমে ফুটে উঠেছে এ বইয়ের পাতায় পাতায়। ‘আপাতদৃষ্টিতে অত্যন্ত সরল লেখন— কিন্তু তা-ও, তার অভ্যন্তরে ধারণ করে রাখে— রাখতে পারে, প্রবলতর আঘাতের আয়ুধ।’ লিখেছেন সুমন ভট্টাচার্য, এ বইয়ের সম্পাদনা ও টীকাভাষ্য তাঁরই। অমলেন্দু দাশগুপ্তের কারাবাসের আত্মকথনে তাঁর সহযোদ্ধা ভিন্ন পথ ও মতের বন্দিদের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানের কথা, সামগ্রিক পরিবেশের নিরাবেগ বর্ণনা... তাঁর স্মৃতির আখ্যান আদতে ইতিহাস-জিজ্ঞাসাই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement