বঙ্কিম স্মারকগ্রন্থ
সম্পাদক: পিনাকেশচন্দ্র সরকার
মূল্য: ৫০০.০০
প্রকাশক: বঙ্কিম-ভবন গবেষণা কেন্দ্র, নৈহাটি
অলোক রায় তাঁর রচনায় যে ভাবে আবিষ্কার করেছেন বঙ্গদেশের প্রবাদপ্রতিম ঔপন্যাসিককে তা এই সময়ের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে জেনে নেওয়া জরুরি নতুন প্রজন্মের পাঠকের: ‘বঙ্কিমচন্দ্র যে-হিন্দুধর্মের ব্যাখ্যার জন্য কৃষ্ণচরিত্র, ধর্ম্মতত্ত্ব ও শ্রীমদ্ভগবদগীতার অনুবাদ ও টীকা রচনা করলেন, তার সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ বা শশধর-ইন্দ্রনাথ-চন্দ্রনাথের হিন্দুধর্মের মিল ছিল না। ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কৃষ্ণচরিত্র গ্রন্থে শাস্ত্রের গ্রহণ-বর্জনে প্রবল আপত্তি করেছেন।... বঙ্কিমচন্দ্রের মতে, ‘‘হিন্দুধর্ম্মে অনেক জঞ্জাল জমিয়াছে— ঝাঁটাইয়া পরিষ্কার করিতে হইবে। হিন্দুধর্ম্মের মর্ম্ম যে বুঝিতে পারিবে, সে অনায়াসেই আবশ্যকীয় ও অনাবশ্যকীয় অংশ বুঝিতে পারিবে ও পরিত্যাগ করিবে। তাহা না করিলে হিন্দুজাতির উন্নতি নাই।’’ অন্যত্র ‘‘হিন্দুধর্ম্ম মানি, হিন্দুধর্ম্মের ‘বখামি’গুলা মানি না। আমার শিষ্যদিগেরও মানিতে নিষেধ করি।’’ বঙ্কিমচন্দ্রের প্রচারিত ধর্ম সেকালে তাঁর কোনো শিষ্য ও অনুগামী গ্রহণ করেছিলেন বলে মনে হয় না।’ বঙ্কিম স্মারকগ্রন্থ-এ ঠাঁই পেয়েছে এমনই আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ। যেমন বঙ্কিমের ঔপন্যাসিক হয়ে-ওঠার সময়টা, যখন পাশ্চাত্য শিক্ষা আমাদের দৈনন্দিন ও ব্যবহারিক জীবনে, ধর্মাচরণে ও সাংস্কৃতিক জীবনে, পারিবারিক সম্পর্কে ও সামাজিক পরিবেশে নানা শঙ্কা ও দ্বন্দ্ব তৈরি করছে, আর তার প্রতিক্রিয়ায় বাঙালির সৃষ্টিপ্রতিভায়ও নানামুখী প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এই প্রেক্ষিতেই প্রয়াত উজ্জ্বলকুমার মজুমদার লিখেছেন ‘বঙ্কিমচন্দ্র যে সময়ে তাঁর ঔপন্যাসিক প্রতিভায় বাঙালি পাঠককে মুগ্ধ ও বিস্মিত করতে শুরু করেছিলেন সেই উনিশ শতকের ষাটের দশক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর এক দারুণ সংকটের সময়। ইংরিজি শিক্ষা-দীক্ষার প্রাথমিক মোহ তখন কেটেছে, ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি-বিকাশের সীমাও আমরা বুঝতে পারছি।... আর এই টানাপোড়েনের কাজটি করতে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সমকালীন চিন্তা ভাবনার কিছু নক্শার কাজও জুড়ে দিয়েছেন যাতে উনিশশতকের ঔপনিবেশিক বুদ্ধিজীবীর স্বপ্ন ও সংকটের ছাপ পড়েছে। এই দ্বন্দ্বগত টেন্শনই বঙ্কিমচন্দ্রের ইতিহাসনির্ভর রোম্যান্স্গুলির প্রাণ।’ চিন্তানায়ক বঙ্কিমচন্দ্রের জন্মের পর ১৭৮ বছর অতিক্রান্ত, এটি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য-সংকলন। বঙ্কিমচন্দ্রের জীবন ও সাহিত্যকর্মের সামগ্রিক মূল্যায়নই এটি প্রকাশের উদ্দেশ্য, বিশেষত আজকের দিনেও তাঁর সাহিত্য ও জীবনভাবনা কতটা প্রাসঙ্গিক সেটা বুঝে নেওয়ার একটা প্রয়াস এ-সংকলন। বঙ্কিম-ভবনের অধ্যক্ষ পিনাকেশচন্দ্র সরকার এটির সম্পাদক হিসেবে যদিও স্বীকার করে নিয়েছেন ‘প্রতিটি রচনা সমান মানের নয়’, তবুও স্পষ্ট ভাবেই জানিয়েছেন ‘বিচ্ছিন্নভাবে গ্রন্থকেন্দ্রিক আলোচনার পরিবর্তে বঙ্কিমচন্দ্রের সমাজ সাহিত্য জীবনভাবনার সামগ্রিক প্রতিফলন ঘটে এমন লেখাই আমরা আহ্বান করেছিলাম লেখকদের কাছে।’ বিশিষ্ট জনের আলোচনায় বঙ্কিমের সাহিত্য লোকসংস্কৃতি সমাজ-সংস্কারের সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মের সম্প্রীতির ভাবনাও উঠে এসেছে, এসেছে তাঁর বিজ্ঞান বা নারী সংক্রান্ত ভাবনাও। সঙ্গে বঙ্কিমের চিঠি, নোটবুক বা তাঁর পরিবারের গানের খাতার চিত্রাবলি। যুক্ত হয়েছে তাঁর প্রয়াণে তিনটি দুষ্প্রাপ্য বঙ্কিম-স্মরণ।
নাটকসমগ্র / কেতকী কুশারী ডাইসন
সম্পাদক: সুমনা দাস সুর
মূল্য: ৩০০.০০
প্রকাশক: এবং মুশায়েরা
মঞ্চের স্তিমিত আলোয় ইলার স্বগতোক্তি: ‘সে এক জটিল উত্তাল সময়। পূর্ববঙ্গ থেকে দলে দলে কলকাতায় পৌঁছতে লাগলো আমাদের প্রসারিত পারিবারিক শাখাপ্রশাখার ছিন্ন স্ত্রীপুরুষ। খিন্ন ভিখিরিদের আর্তনাদে ছেয়ে গেলো শহরের ফুটপাথগুলি।... অন্যরা খেতে পায় না, আমি রোজ ভাত খাই— আমার পোস্ট-ফর্টিসেভেন ছেলেবেলার সেই পুঞ্জীভূত অপরাধবোধ প্রেতের মতো ফিরে আসে, আর পাথরের মতো আমার বুকের ওপরে চেপে বসে, যদি দেখি কেউ খাবারের অপচয় করছে।’ এই নাটকটি ‘মোৎসার্ট চকোলেট’ (১৯৯৮), শিল্পিত অভিনিবেশে একই রকম স্বকীয় শক্তিশালী কেতকী কুশারী-র অন্য নাটক দু’টিও— ‘রাতের রোদ’ (১৯৯০) আর ‘সুপর্ণরেখা’ (২০০২)। বারো বছরের মধ্যে রচিত এই নাটক তিনটির শেষেরটি এখনও মঞ্চস্থ হয়নি, বাকি দু’টি মঞ্চস্থ হয়েছে কলকাতা আর শান্তিনিকেতনে। ‘রাতের রোদ’ প্রথম অভিনীত হয় ম্যাঞ্চেস্টারে এক আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবে। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো বা রবীন্দ্রনাথের বর্ণদৃষ্টির সন্ধানী কেতকী কুশারীর কবি-ঔপন্যাসিকের বাইরে স্বতন্ত্র এক সাহিত্যসত্তা গ্রন্থিত হয়ে রইল তাঁর এই নাটকসমগ্র-এ। প্রতিটি নাটকের শরীরেই এই সময়ের চিহ্ন-অনুষঙ্গ, তর্কের বুনট, মঞ্চায়নযোগ্যতা পেরনো সাহিত্যের মনন। দীর্ঘকাল ইংল্যান্ড নিবাসী কেতকীকে নাটক রচনায় প্রাণিত করেছে পাশ্চাত্যের সঙ্গীতভিত্তিক অপেরা, নৃত্যভিত্তিক ব্যালে, লন্ডনের মঞ্চে-টেলিভিশনে ইয়োরোপীয় নাটক দেখার অভিজ্ঞতা, আর কলকাতায় বাদল সরকারের ‘ভোমা’। এ সব জানিয়েছেন তিনি বইটির শুরুতেই তাঁর ‘একজন অভিবাসী নাট্যকারের জবানবন্দি’তে। আর এ-বইয়ের সম্পাদক সুমনা দাস সুর তাঁর ভূমিকা-য় ব্যাখ্যা করেছেন কেতকীর শিল্প-অভিপ্রায়: ‘বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতটা তিনি তুলে ধরতে চান নাটকের মধ্যে।... ’