ভাষা, অর্থ, সত্য
সুকান্ত চৌধুরী
৪৫০.০০
আনন্দ
বইটি পড়ে গর্ব হয়। গর্ব এই কারণে যে, বাংলা ভাষায় এমন একটি বই লেখা হয়েছে। ইংরেজি সাহিত্যের অগ্রণী অধ্যাপক এ-বই ইংরেজিতে লিখতেই পারতেন, লিখলে জগৎসভায় তার স্বীকৃতি অবধারিত ছিল। আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে এই আশাও নিশ্চয়ই করব যে, নানান ভাষায় এর অনুবাদ হবে, দুনিয়ার পাঠক পড়বার সুযোগ পাবেন। আমরা আরও গর্বিত হব।
পৌনে দু’শো পৃষ্ঠার এই অষ্টাধ্যায়ীর বিষয়: সামাজিক জ্ঞানতত্ত্ব। ‘সোশ্যাল এপিস্টেমোলজি’র প্রচলিত ধারণাকে কিছুটা পরিমার্জন করে লেখক জানিয়েছেন, “সামাজিক জ্ঞানতত্ত্ব বলতে আমি বোঝাতে চাই আমাদের সমাজজীবনের পিছনে যে বৌদ্ধিক প্রক্রিয়া কাজ করে তার অনুসন্ধান— যেভাবে আমরা সমাজ ও ইতিহাসকে দেখি বুঝি (অনেকটাই সহজাত বা অবচেতনভাবে), অতএব নিজেরাও যেমন আচরণ করি ও যেভাবে সমাজকে পরিচালনা করি।” সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ আলোচনায় এসেছে, তবে বিষয়বস্তু হিসেবে নয়— সেগুলি নিয়ে আমরা ‘কী ভাবে’ চিন্তা করি সেটাই বিশ্লেষণ করেছেন লেখক।
বিশ্লেষণের তাগিদ সৃষ্টি করেছে ঘরে ও বাইরে সর্বব্যাপী মানবিক বিপর্যয়ের অভিজ্ঞতা, যে বিপর্যয় আমাদের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতিকে অবিশ্বাস্য গতিতে গ্রাস করছে। এই ‘বাইরের’ সঙ্কটের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের ‘অন্দরে অন্তরে’ এক গভীর সঙ্কট, মানবিক বিপর্যয়ের সমান্তরাল— না, সমান্তরাল নয়, অঙ্গাঙ্গি— এক মানসিক বিপর্যয়। সর্বনাশ বহুরূপে সম্মুখে হাজির, অথচ আমরা তাকে দেখেও দেখছি না। রাজনীতির মঞ্চে বিচরণশীল দানবকে ভাবছি দেবতা, অর্থনীতির পরিসরে মহালুণ্ঠনের বিশ্বজোড়া ফাঁদকে মনে করছি ভুবনগ্রামের উন্নয়ন, পরিবারের নিভৃতে হিরের আংটিকে বরণ করছি ভালবাসা বলে। আমরা সত্যকে চিনতে পারছি না, মিথ্যাকে সত্য বলে মনে করছি। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা— মিথ্যা এবং সত্যের মধ্যে তফাত করার মৌলিক বুদ্ধিই হারিয়ে ফেলছি। বৌদ্ধিক প্রক্রিয়ার এই ক্ষয়রোগের কারণ এবং গতিপ্রকৃতি নির্ণয় করার লক্ষ্য নিয়েই লেখা ভাষা, অর্থ, সত্য।
সীমিত পরিসরে এমন দিগন্তপ্রসারী বইয়ের বিশদ আলোচনার চেষ্টা করাও অসম্ভব। খুব সংক্ষেপে তার মূল কথাটির আভাস দেওয়া যেতে পারে। উপসংহারে লেখক জানিয়েছেন, “আমার সমস্ত আলোচনার মধ্য দিয়ে যে মূল ধারণাটা বইছে তা হল, মানুষ বাস করে সংকেতের আবহে। সংকেতের মাধ্যমেই আমরা বহির্বিশ্বকে নির্দেশ করি, তার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করি, তাকে জানি বুঝি বদলাই। আজকের দুনিয়ায় সব সংকেতপ্রণালীর অবক্ষয় ও অবমূল্যায়ন ঘটছে। তার ফলে আমাদের চটজলদি কিছু সুবিধা হতে পারে কিন্তু গভীর বৌদ্ধিক ক্ষতি হচ্ছে, জগৎকে আমরা কম করে বুঝছি।”
সঙ্কেত এই বইয়ের একটি মৌলিক ধারণা। আমাদের ভাষা কী ভাবে তার সঙ্কেত-ধর্ম হারিয়ে ফেলছে, সেটাই আলোচনার প্রধান লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে পৌঁছোনোর জন্য শুরুতেই আর একটি বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। তার নাম অর্থ, মানে টাকাকড়ি। পণ্যের মূল্য যখন টাকায় মাপি, তখন টাকা কাজ করে সঙ্কেত হিসেবে— মূল্যের সঙ্কেত। কিন্তু টাকা যখন পণ্য বা পরিষেবার মূল্যের সঙ্কেত না হয়ে নিজেই পণ্য হয়ে ওঠে? যেমনটা আমরা দেখছি লগ্নি-পুঁজির বিশ্ববাজারে, যার এক উৎকট রূপ দেখা গিয়েছিল এই শতকের প্রথম দশকে ‘ডেরিভেটিভস’-এর লীলায়? সেই বিধ্বংসী লীলার কাহিনি এখানে আলোচ্য নয়। কিন্তু পণ্যমূল্যের সঙ্কেত বহন না করে অর্থ নিজেই যখন পণ্য হয়ে ওঠে, তখন সে অনর্থ বাধাতে পারে— এই ব্যাপারটা এখানে বিশেষ প্রাসঙ্গিক।
তার কারণ হল, অ(ন)র্থের মতোই, আমাদের ভাষাও ওই একই পথে চলেছে। আমাদের ব্যবহৃত শব্দ, বাক্য, বয়ান, সবই উত্তরোত্তর তার সঙ্কেত-ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে নিজেই এক-একটি ব্যবহারিক বার্তা হয়ে উঠছে। আমরা এখন অনেক কথা বলছি কিন্তু বলছি না। যেমন, আজ আমাদের কাছে জন্মদিনের অগণন শুভেচ্ছা বার্তা আসে নানান পণ্য আর পরিষেবার বিক্রেতার কাছ থেকে। আমরা জেনে গিয়েছি, সে-সব নিছক শুভেচ্ছা-বার্তা নয়, সেগুলি যান্ত্রিক ভাবে পাঠিয়ে আসলে “দোকানদার বলছেন, ‘এই যে স্যর, আমাদের কথা মনে করিয়ে দিলাম। এবার পুরনো টিভিটা বদলাবেন নাকি?’” দোকানদারের বার্তা তো তবু, শুভেচ্ছার সঙ্কেত না হোক, অন্তত ব্যবসাবুদ্ধির সঙ্কেত। কিন্তু সমাজমাধ্যমের ময়দানে অষ্টপ্রহর যে ‘লাইক’ আর ‘অসাধারণ’ আর ‘ভাবা যায় না’ আর ‘সো নাইস’-এর অবিরত শোভাযাত্রা? এমনকি গুরুতর বিষয়ে আপাত-গুরুগম্ভীর মন্তব্যেও যে চিন্তাহীন, আন্তরিকতাহীন চর্বিতচর্বণের অনন্ত উচ্ছ্বাস? লেখকের তীক্ষ্ণ ভাষায়, “ভিতরের মানে উবে গিয়ে শব্দগুলি এখন ফাঁপা আওয়াজ মাত্র— সংকেত নয়, ঠাট বা ঠমক; ইংরেজিতে symbol নয়, cipher।” আমাদের শব্দ ও
বাক্যেরা তাদের শিকড় হারিয়ে ফেলছে, ‘ভাষা আমাদের সঙ্গে বেইমানি করছে।’ আমাদের বৌদ্ধিক প্রক্রিয়া, আমাদের মননপ্রণালী বিকৃত এবং দুর্বল হয়ে পড়ছে।
আর সেই বিকৃত ও দুর্বল বুদ্ধিকে কাজে লাগাচ্ছে ক্ষমতার কারবারিরা। কাজে লাগাচ্ছে তাদের মিথ্যার বেসাতি এবং আধিপত্য বিস্তার করার লক্ষ্যে। যাকে ‘পোস্ট-ট্রুথ’ বা উত্তরসত্য বলা হচ্ছে, তা এই প্রক্রিয়ারই এক চরম রূপ। বইয়ের শেষে উত্তরসত্যের প্রধান লক্ষণগুলি একটি তালিকার আকারে সাজিয়ে দিয়েছেন লেখক, যার শুরুতেই তিনি বলছেন, “উত্তরসত্য অবশ্যই মিথ্যা, কিন্তু সব মিথ্যা উত্তরসত্য নয়। উত্তরসত্যের লক্ষ্য কেবল ঠকানো নয়, অসত্য প্রতিষ্ঠার জন্য একটা অসার চিন্তাপ্রণালী লোকমানসে প্রতিষ্ঠা করা, এবং তার দ্বারা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনকে প্রভাবিত করা।” কী ভাবে তা কাজ করে, সে-খবর আজ আমাদের বিলক্ষণ জানা। ‘ফেক নিউজ়’ তো এক দিক থেকে কম বিপজ্জনক, কারণ ক্রমশই তার ‘ফেকত্ব’কে চটপট ধরে ফেলা যাচ্ছে। কিন্তু বিজ্ঞাপনী বার্তা থেকে সরকারি প্রচার (অধুনা যার সঙ্গে পণ্যের বিজ্ঞাপনের তফাত করা প্রায়শ কঠিন)— যে ভাবে আমাদের মগজে মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে এবং চারিয়ে দিচ্ছে, তার বিপদ আরও বেশি।
লেখক এর নানা নজির পেশ করেছেন। একটির কথা বলা যাক। কোভিডের ধাক্কা সামলাতে ভারত সরকার নিজের তহবিল থেকে যেটুকু বরাদ্দ করেছিল তার পরিমাণ জাতীয় আয়ের এক শতাংশ মতো। অথচ প্রচার করা হল, সরকারি সাহায্যের অঙ্কটা জাতীয় আয়ের দশ শতাংশ! ঘটনা হল, ২১ লক্ষ কোটি টাকার বরাদ্দ দেখাতে গিয়ে যেখান থেকে সেখান থেকে যা খুশি অঙ্ক নিয়ে যোগ করে দেওয়া হয়েছে। ঘটনা হল, “একটা গোরু, একটা ঘোড়া আর একটা মহিষ যোগ করলে তিনটে হাতি হয় না— কিছুই হয় না, যোগ করা অর্থহীন।” অথচ বহু লোক সেই হিসেব দিব্যি মেনে নিয়ে ‘আহা মোদী বাহা মোদী’ করেছেন। বাস্তবিকই, ‘এটা গণিতের নয়, সাধারণ যুক্তিবোধের বিপর্যয়।’ তার মূলে আছে বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষয়।
বিপদটাকে কেবল পুঁজি এবং রাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারের প্রক্রিয়া হিসেবে দেখলেই চলবে না, আমাদের চিন্তাভাবনা এবং বুদ্ধিবৃত্তিকে কী ভাবে সেই প্রক্রিয়ায় শামিল করে নেওয়া হচ্ছে, সেটা বুঝে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। তার কারণ, আমরা আমাদের বিচ্ছিন্ন অস্তিত্বে ব্যক্তিগত ‘স্বাধীনতা’র আস্বাদে যতই বিভোর হচ্ছি, ওই আধিপত্যের কারবারিরা ততই আমাদের চেতনার দখল নিচ্ছে। এই বিপদের মোকাবিলায় সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সমস্ত রণাঙ্গনেই লড়াই করতে হবে, কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে লড়াই করতে হবে মননের প্রণালীতেও। লেখক মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘নিষ্ঠাবান বৌদ্ধিক চর্চার একটা নৈতিক মাত্রা আছে।’ সেই মাত্রাটিকে পুনরুদ্ধারের নৈতিক দায় আমাদের সকলের। এই দায় অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী বইটি শেষ করেছেন একটি প্রশ্ন উচ্চারণ করে: বুদ্ধিভ্রংশ হলে আমাদের রইল কী?